বাংলাদেশ: ব্লগাররা নকল তাজ মহল কেলেন্কারীর উদঘাটন করেছেন

The original Taj Mahal at Agra, Indiaআপনি যদি আগ্রার (ভারত) তাজ মহল দেখতে যেতে না পারেন তাহলে তাজ মহল আপনার সাথে দেখা করতে আপনার দেশে আসবে।

গত কয়েকদিন ধরে প্রচার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের একটি আজব আর মজার খবর পড়ছি। এটা প্রথমে এএফপি জানিয়েছে আর তারপরে দ্রুত বাংলাদেশ, ভারত আর আন্তর্জাতিক বাজারের সংবাদ মাধ্যমগুলো এটা তুলে ধরেছে (এর মধ্যে কয়েকটার লিঙ্ক , , , , , )।

Bangladeshi Taj Mahalখবর হলো এটা: বাংলাদেশের একজন ধনী চলচ্চিত্র নির্মাতা আগ্রার ঐতিহাসিক তাজ মহলের ‘হুবহু নকল’ করেছেন রাজধানী ঢাকার ৩০ কিমি বাইরে একটা ছোট শহর সোনারগায়ে। দৃশ্যত: আহসানুল্লাহ মনি নামে এই ধনী ব্যক্তি আগ্রায় ভ্রমণের সময়ে এই ঐতিহাসিক ভবনের প্রেমে পড়েন আর সিদ্ধান্ত নেন এর হুবুহু একটা প্রতিরুপ তার দেশে বানাবেন যাতে তার দেশের মানুষ আগ্রায় যাওয়ার খরচ বাঁচিয়ে মূল ভবন দর্শনের সাধ মেটাতে পারেন।

জনাব মনি মিডিয়াকে যা জানিয়েছেন তা হলো (আর মিডিয়া তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করেছে) তার ৫ বছরের একটু বেশী সময় লেগেছে (আসলটা নির্মাণ করতে ২০ বছরের বেশী সময় লেগেছিল) এই মুর্তিমান সাইজের নকল তৈরি করতে আর এটা নির্মান করতে ব্যায় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা (৫৮ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার)। প্রচার মাধ্যম আরো জানিয়েছে যে শত শত ডিজাইনার আর কর্মীকে এই প্রোজেক্টে ব্যবহার করা হয়েছে (আসলটায় প্রায় ২০,০০০ লোক লেগেছিল) আর খুঁটিনাটির প্রতি দৃষ্টি দেয়ার লক্ষ্যে একদল আসলে আগ্রায় গিয়ে মূল ভবনটি ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে এনেছে। শোনা গিয়েছিল যে চোখ ধাঁধানো আসলটার নকল করতে গিয়ে ১৬০ কেজি (৩৫৩ পাউন্ড) পিতল, মার্বেল আর গ্রানাইট ইতালি থেকে আমদানী করা হয়েছে আর এই নির্মাণে ব্যবহারের জন্য বেলজিয়াম থেকে হীরে আনানো হয়েছে।

Taj Mohol close shotবর্ণনার এই অতিরন্জন মানুষের মধ্যে সাথে সাথে গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে আর তার পরেই ঢাকাতে ভারতের হাই কমিশনের দৃষ্টি এই দিকে আকৃষ্ট হয়। তারা তাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছিল হঠাৎ করে তাদের নাকের ডগায় নকল একটা ‘তাজ’ তৈরি হয়েছে বলে। মজার ব্যাপার হলো যখন পড়শীদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে তখনই প্রচার মাধ্যমগুলো কঠিন কিছু বাক্যসহ উস্কানীমূলক কিছু প্রতিবেদন দিয়েছে যেমন, “বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে যখন যানা যায় যে একজন চিত্র পরিচালক তাজ মহলের হুবহু নকল নির্মাণ করছেন।” ‘কূটনৈতিক হৈচৈ’, ‘ভারতের রাগ’ আর অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে প্রচার মাধ্যমে অনেক কিছুই লেখা হচ্ছে। এইসব প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কারো কারো কাছ থেকে মন্তব্য এসেছে যে কোন বাংলাদেশী যদি আসলেই তাজকে পুন:নির্মান করে থাকেন, ভারত এই নিয়ে সমস্যা করতে পারেনা কারন ঐতিহাসিক স্থাপত্যের কপিরাইটের নিয়ম নেই। মিডিয়ার মাত্র কয়েকটি পরে জানিয়েছিল যে ভারতীয় হাই কমিশন বিষয়টা তদন্ত করে জানিয়েছে যে দর্শকরা প্রভাবিত হবে না কারন আসলটার জৌলুস নকলটিতে আসা সম্ভব না।


প্রচার মাধ্যম গুলো যখন ওই মুখরোচক সংবাদ নিয়ে দারুণ সময় কাটাচ্ছিলো, শত শত বাংলাদেশের মানুষ ভীড় করেছিল এই নতুন বিষ্ময় দেখার জন্য, যা তাদের দোড় গোড়ায় আনা হয়েছে। কিছু বাংলা ব্লগারও ওখানে গিয়েছিলেন দেখতে যে কি নিয়ে এই হৈচৈ। কিন্তু তখনই আসলে জানা যায় যে এই পুরো ব্যাপারটিই একটা দৃষ্টি আকর্ষণের ধান্ধা, আর তাজের নামে টাকা বানানোর একটা কৌশল।

ব্লগার ঝড়ো হাওয়া তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন:

মদনপুর বাসস্টান্ড নেমে দেখি টেমপুওয়ালারা ’তাজমহল’ বলে চিল্লাইতেছে। কেউ ভাড়া চাচ্ছে ৩০/- টাকা, কেউ ৪০/- টাকা। আধঘন্টা টেম্পু দিয়ে চলার পর একগ্রামে এসে থামলাম। সামনে বিশাল জ্যাম আর হাজার হাজার মানুষ। সবাই তাজমহল দেখতে আসছে। অপেক্ষা না করে নেমে হাটা দিলাম। প্রায় দুই কিলো হাটার পর তাজমহল কম্পাউন্ডে আসলাম, প্রবেশ মুল্য ৫০/- টাকা। কোন ব্যাপার না, আগ্রা গেলে আরো খরচ হইতো। তাড়াতাড়ি টিকেট কেটে ভিড় ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম।তাজমহলের চেহারা দেইখা মুখটা অটোমেটিক হা হয়ে ’শালা’ শব্দটা যে কেমনে বের হয়ে আসলো বুঝবার পারি নাই। আমার ঢাকাইয়া বন্ধুটি মুখ আর আটকাইয়া রাখা গেলো না। সে গাইল শুরু করলো- (গালি)রা টয়লেটের টাইলস লাগাইছে, মালিক পক্ষের সব (গালি)’রা ভাগছে, একটারে ডাইকা আইনা যে পাবলিক গাইলাইবো সেই উপায় নাই, (গালি)রা এই ঈদের দিনে পাবলিকরে ’বাকরা’ টুপি লাগায় দিলো … ইত্যাদি ইত্যাদি।

ঝড়ো হাওয়া আরো লিখেছেন যে অসম্পূর্ণ ও বাজেভাবে ডিজাইন করা একটা নির্মাণ মিডিয়ায় হৈচৈ ফেলে উদ্বোধন করে এই প্রকল্পের উদ্যোক্তারা এই ঈদ মৌসুমে তাদের দ্রুত টাকা বানানোর কৌশল নিয়েছিল এটা ফাঁস হয়ে গেছে।

বিবর্তনবাদী নামে আর একজন ব্লগার সেখানে গিয়েছিলেন এবং খুবই অখুশী হয়েছেন হলুদ সাংবাদিকতার শিকারে পরিণত হয়ে; তিনি তার ব্লগে লিখেছেন:

কিছুই দেখবার মত নাই। শুভ্র তাজমহলের সোকলড রেপ্লিকা বানিয়েছে সাদার মাঝে নানা রঙ্গের টাইলস দিয়ে। সংবাদপত্রে কত কিছুই না পড়লাম। খরচ ৪০০ কোটি টাকা, ইতালি থেকে আনা মুল্যবান পাথর ও টাইলস, বেলজিয়াম থেকে আনা ১৭২ টি হীরক খন্ড, গম্বুজের উপরে চারমন ওজনের ব্রোঞ্জ, কোথায় এসব??? ৪০০ কোটি টাকা কি পান্তা ভাত নাকি! নর্মাল ইট-সিমেন্টের একটা স্ট্রাকচারের উপরে দেশী টাইলস্ (আমার বন্ধু বাড়ির কাজকর্ম ভাল বোঝে, তার মতে টাইলস গুলো দেশী) বসানো। এমন কি টাইলসের কাটাও ঠিক মত হয় নাই, আনাড়ি হাতের কাজ। এখনও ফিনিশিং সম্পূর্ণ হয় নাই। ইতালির পাথর যদি পরে বসাবার ইচ্ছাও থাকে তবে কোথায় বসাবে? দর্শনার্থীরা সবাই বিরক্ত এবং নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন…প্রায় ১০ মিনিট দেখবার পরেই বুঝতে পারলাম আমাদের জন্য ভেতরে আর কিছুই নেই। বেরিয়ে হাটা ধরলাম। পথে অনান্য দর্শনার্থীদের সাথে কথা হল, সবার একই উত্তর “ভূয়া”।

এই ব্লগার একটা ভিডিও পোস্ট করেছেন যেখানে দেখা যাচ্ছে দর্শনাথীরা তাজ দেখছেন আর তাদের হতাশা ব্যক্ত করছেন:

প্রথম বাংলা আহসানুল্লাহ মনির ওই উদ্যোগ সম্পর্কে জনগণের প্রতিক্রিয়াকে তার নিজের কথায় ব্যক্ত করেছেন:

পাগল হিন্দি সিনেমা নকল করতে করতে, মাথা আওলাইয়া গেছে। দেখছে। ভাল আয় রোজগার। এখন তাজ মহল নির্মান করছে।

পাঁজি যে টাকা খরচ করেচে, সেই টাকা যদি দেশের হত-দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগাত তাহলে হত গরীবের উপকার।

বিবর্তনবাদী সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন তাদের অতিরন্জিত প্রতিবেদনের সাহায্য নিয়ে এইসব প্রতারকদের সহায়তা করার জন্যে। তিনি বলেছেন:

অবাক লাগল এই যে দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা গুলো কিভাবে কোন রকম খোজ খবর ছাড়াই ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ, ১৭২ টি হীরক খন্ড, ইতালির টাইলস/পাথরের ভূয়া খবর ছাপালেন। ৪০০ কোটি টাকা কি কম? এত টাকার বিনিয়োগে, একটি বিখ্যাত স্থাপনার রেপ্লিকা তৈরি ব্যাপারে তারা কি সরোজমিনে একবারও ঘুরে দেখে আসবার সময় করতে পারলেননা। ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জের, সোনারগাঁয়ের পেরাবো গ্রামে যেতে বড়জোর এক দেড় ঘন্টাই লাগত!! এই দেশে কি খবরের অভাব আছে? নাকি টাকা দিলেই খবর ছাপানো যায়। খুব বেশী হলে এই স্থাপনাতে ৩/৪ কোটি টাকার মত খরচ হয়েছে।

ব্লগার রায়হান প্রথম সারীর বাংলা দৈনিক প্রথম আলোর নিউজ ডেস্কে ফোন করেছেন, যারা ‘তাজ’ এর ব্যাপারে প্রতিবেদন ছেপেছিল বিত্ত-বৈভবের বিবিধ ব্যাখ্যাসহ, আর জিজ্ঞাসা করেছেন যে তাদের প্রতিবেদক নিজে কি ওই স্থানে গিয়ে দেখে এসেছেন আর যদি না গিয়ে থাকেন, তারা কি করে নিজেরা যাচাই না করে একটা জিনিষ ছাপাতে পারলেন। তিনি জানান যে এর উত্তরে নিউজডেস্ক জানিয়েছে যে তারা কেবলমাত্র এএফপি এর সংবাদের উপরেই রিপোর্ট করেছেন। যখন তিনি ওই ব্যক্তিকে বাস্তবতা সম্পর্কে জানান তখন তিনি জানান যে অবশ্যই তারা একজন সাংবাদিককে ওখানে পাঠাবেন আর এই ব্যাপারে আর একটি প্রতিবেদন দেবেন।

বাংলাদেশী ব্লগাররা ওই স্থানে সরেজমিনে গিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা পোস্ট, ছবি আর ভিডিও এর মাধ্যমে জানানোর পরেই কেবলমাত্র আমরা ‘নকল তাজ’ এর আসল গল্প জানতে পারছি।

আসল তাজ মহলের ছবি উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত। অন্যান্য ছবি তুলেছেন বিবর্তনবাদী, অনুমতিক্রমে ব্যবহৃত।

1 টি মন্তব্য

  • zia

    ami bojlam na apne eto rege asen keno?jodi ek jon replika toiri korte chaise tate apnar problem ki?ek jaigay likchen je
    bangladesher manus gorib ,ami mani je BD er manush gorib ,tara agra giye taj dekte pare na bole ekhane (BD te) taj banaiche ,eita to apnar khusi hoyar kotha je jara gorib tader ekta shok puron hoise.sadharon manush er kotha mone kore hok r bebshar koha mone korei hok ,ek ta jinish je ora banaiche otake apnar aprisiate kora ochit.sutorang sob kisu te dosh na dore asen amrA samner dike egye jai.

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .