ঢাকায় বাংলাদেশী-আমেরিকান ব্লগারকে ছুরিকাঘাতে খুন

Avijit Roy, Image Credit: Tanmoy Kairy

অভিজিৎ রায়। ছবি তন্ময় কৈরির সৌজন্যে

২৬শে ফেব্রুয়ারী ২০১৫ বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের নিকটে অভিজিৎ রায়-কে এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাতে খুন করা হয়ছে। অভিজিৎ একজন বাংলাদেশী-আমেরিকান লেখক ও ব্লগার এবং মুক্ত মনা (মুক্ত চিন্তাকারী) ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যেখানে ২১শে বইমেলা তথা জাতীয় বই মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল তার নিকটে অজ্ঞাত পরিচয় হামলাকারীরা যখন তাদেরকে ছুরিকাঘাত করে তখন তার স্ত্রী ব্লগার রাফিদা আহমেদ বন্যাও মারাত্মকভাবে যখম হয়।  রায় বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু পরবর্তিতে আমেরিকায় যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। তিনি তার একটি নতুন বইয়ের প্রকাশনার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য মাত্র তার মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত, এই খুনের ব্যাপারে কাউকেই গ্রেফতার করা হয় নি, যার ফলে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বেশ প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে:

আমার ফেইসবুক পাতা থেকে প্রাপ্ত (সংবাদ)। ঢাকায় বাংলাদেশী ব্লগার অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে মারা হয়েছে। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কাণ্ডারি ছিলেন।

লেখক অভিজিৎ রায়, যিনি নাস্তিক্যবাদ নিয়ে লিখতেন, তাকে কুপিয়ে মারা হয়েছে ফেসবুকে ইসলামি মৌলবাদীদের হুমকির পরে।

ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী লেখক অভিজিৎ রায়কে আজকে চরমপন্থিরা খুন করেছে বাংলাদেশে – খবরটা শুনে আমি খুবই বিপর্যস্ত।

উগ্র মৌলবাদের আরেক শিকার। ডঃ অভিজিৎ রায়কে ইসলামি মৌলবাদীরা খুন করেছে বাংলাদেশে।

নিজেকে একজন নাস্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করা রায় বিজ্ঞান, সমাজ এবং দর্শনসহ অনেক বিষয়ের উপর লিখেছেন। তিনি তার বই ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’, সমকামিতা, অবিশ্বাসের দর্শন এবং শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইগুলোর জন্য পরিচিত। তার লেখা ও ব্লগগুলো ধর্মীয় চরমপন্থীদের ক্রোধের উদ্রেক করেছে, এবং তিনি নিয়মিতই বিভিন্ন মৌলবাদী গোষ্ঠী থেকে হুমকি পেয়ে আসছিল। প্রায়শই ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরুদ্ধে কথা বলতেন তিনি ঠিক যেমন বাংলাদেশের আরও অনেক ব্লগার করে, এবং সকল ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনামূলক চিন্তার প্রসার করতেন। ডিসেম্বর মাসে একটি অনলাইন সংবাদপত্র BDNews24 প্রতিবেদন প্রদান করে যে শফিউর রহমান ফারাবী নামক ব্লগার ফেসবুকে একটি হুমকিমূলক উক্তি করেছে, যাতে লেখা ছিল: 

অভিজিৎ রায় আমেরিকাতে বাস করে, তাই তাকে এখনই হত্যা করা সম্ভব নয়। সে দেশে ফেরত আসলে তাকে হত্যা করা হবে।

আক্রান্ত জুটির সারা শরীরে রক্ত মাখা ভীতিকর ছবি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। এরকম একটি ছবিতে (সতর্কবার্তা: ভীতিকর বিষয়বস্তু) রাফিদা আহমেদ বন্যাকে তার স্বামীর মাথা ধরে থাকতে দেখা গেছে আর মানুষ দাড়িয়ে তা দেখছে। এরকম একটি ছবি প্রকাশ করা একটি টুইটার একাউন্ট থেকে লেখা হয়েছে, ‘হতে পারে এটি অভিজিৎ রায়-এর রক্তাক্ত স্ত্রীর হাতে তার স্বামীর মাথা। #শিরোচ্ছেদ সে বিগত ৩/৪ বছর যাবত শীর্ষ লক্ষ্য হিসেবে ছিল।’ এই একাউন্টটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে মনে হয় উৎফুল্লও হয়েছে: 

এই টুইটার ব্যবহারকারী ব্লগারদের একটি ‘মৃত্যু তালিকা'র কথা উল্লেখ করেছে যাদেরকে হেফাজত এর মতো ইসলামীক দলগুলো নাস্তিক বা ধর্ম অবমাননাকারী হিসেবে লেবেল লাগিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশের কারণে দুই বছর আগে ব্লগার আহম্মেদ রাজীব হায়দারকে ঢাকাতে তার বাড়ীর সামনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার নাম ঐ তালিকায় উঠে এসেছিল, অভিজিৎ এর নামও সেখানে ছিল। বাংলাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান, মানে হলো যে সেখানে কোন শরীয়া আইন বা ধর্মঅবমাননা আইন বিদ্যমান নেই। যারা নিজেদেরকে নাস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরও অন্যান্য নাগরিকদের মতো একই অধিকার আছে। যদিও বাংলাদেশের ফৌজদারী আইনের (১৮৬০)  ২৯৫এ অনুচ্ছেদের অধীনে যে কোন ব্যক্তির যদি ‘ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত’ করার ‘ইচ্ছাকৃত’ বা ‘দ্বেষপূর্ণ’ উদ্দেশ্য থাকে তবে সে কারাদণ্ডের জন্য দায়ী হবে। সরকারী আলস্য এবং পুলিশের অকার্যকারীতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামী দলগুলোকে যথেষ্ট পরিমাণে দায়মুক্তি প্রদান করেছে। ফেব্রুয়ারীর ১৬ তারিখে আর একটি হত্যা তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং তা ফেসবুক এ প্রকাশ করে অভিজিৎ এর বই প্রকাশকদের হুমকি প্রদান করা হয়। এই তালিকার লেখক সালমান আহমেদ, নামের একজন ব্যবহারকারী লিখেছে:

আসুন এমন কিছু প্রকাশকে দেখে নেই যারা কথিত মুক্তমনা ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের বইগুলোকে নিয়মিত প্রকাশ করে যাচ্ছে । এরাও লেখকদের মত সম অপরাধী, প্রথমে এদেরকে আঘাত করুন ,এদের স্টল জ্বালিয়ে দিন,এদের অফিসে ককটেল,বোমা যাই পান তাই দিয়ে হামলা করুন ।

বাংলাদেশে নাস্তিকদের নিরাপত্তার অভাবের উপর মতামত দিয়ে চিকিৎসক এবং সক্রিয় কর্মী পিনাকী ভট্টাচার্য্য ফেসবুক-এ লিখেছেন:

বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ টার্গেট একজন নাস্তিক। নাস্তিক মানেই আক্রমন যোগ্য, হত্যা যোগ্য। নাস্তিক কে প্রকাশ্য হুমকি দেয়া হত্যা করা যেন কোন অপরাধ নয়। নির্মম মৃত্যুই যেন তাঁদের প্রাপ্য।

সাংবাদিক পলাশ দত্ত পুলিশকে অভিজিৎ রায়-এর বিদ্যমান হুমকির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে:

তাহলে আমরা এভাবেই চলতে থাকব? আমাদের দেশের আইন-কানুনও এভাবেই চলতে থাকবে? একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেইসবুকে ‘হত্যার হুমকি’ দেয়ার অপরাধে কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের সাত বছরের কারাদাণ্ড হবে। আর অন্যদিকে একজন লেখককে হত্যার হুমকি দিয়েও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী ফারাবি শফিউর রহমান। এবং তার হুমকিমতোই দেশে এসে বৃহস্পিতবার রাতে খুন হবেন কুসংস্কার ও মৌলবাদবিরোধী লেখক অভিজিৎ রায়।

এমনকি ২০১৩ সালেরও আগে প্রখ্যাত লেখক হুমায়ুন আজাদও ২০০৪ সালে ফেব্রুয়ারীর বই মেলার বাইরে লক্ষ্যণীয়ভাবে একই উপায়ে আক্রান্ত হয়েছিল। এই মাসের শুরুতে বিংশ শতাব্দীর ইরানী যুক্তবাদী ও রাজনীতিবিদ আলী দশ্তীর লেখা মহনবী মুহাম্মদের জীবনের উপর একটি বিতর্কিত বইয়ের বাংলা অনুবাদের প্রকাশক তার কর্ম বাংলাদেশের জাতীয় বই মেলাতে প্রদর্শন করার পর মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিল। 

আন্তর্জাতিক অপরাধের দায়মুক্তি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশেষজ্ঞ, সক্রিয় কর্মী এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল আন্তর্জাতিক অপরাধ কৌশল ফোরাম (আইসিএসএফ) একটি বিবৃতিতে লিখেছে:

অভিজিৎ রায়ের এই পূর্বপরিকল্পিত হত্যা মুক্ত ও প্রগতিশীল চিন্তাসমূহকে চিহ্নিত করে পর্যায়ক্রমিক এবং পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করার একটি অংশ যা নিয়মিত বিরতী দিয়ে বাংলাদেশে ঘটে চলেছে, বিশেষভাবে দশ বছর আগে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের উপর ঘৃণ্য আক্রমণের পর থেকে। বাংলা নববর্ষ উদ্য়াপনের সময় উদিচীর উপর বোমা হামলা, এবং সারা দেশে ২০১৩ সালে বিভিন্ন ভাষা স্মতিস্তম্ভের উপর আক্রমণের মতো প্রগতিশীল প্রতিকৃতির উপর বড় রকমের আক্রমণ ছাড়াও ধর্মীয় চরমপন্থীরা বিগত বছরগুলোতে অনেক ব্যক্তির উপর জঘন্য আক্রমণ চালিয়েছে। 

২০১৩ সালে হায়দারের সহিংস মৃত্যু সেসময় হাজার হাজার সক্রিয় কর্মীদের দ্বারা দেশব্যাপী প্রতিবাদের আলোড়ন ঘটিয়েছে, এবং পাঁচজন এখনো তার হত্যার জন্য বিচারাধীন রয়েছে। তারপর থেকে অভিজিৎ ছাড়াও অন্যান্য ব্লগাররাও আক্রান্ত হয়েছে। আজকে পর্যন্ত সকল বিচারই অসমাপ্ত রয়েছে। 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .