চীন: চালে রাসায়নিক মিশ্রণ পাওয়া গেছে

চালের মধ্যে অত্যাধিক মাত্রায় বিষাক্ত ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে চীনে। খাদ্য কেলেংকারীর সর্বশেষ এ ঘটনায় চীনের সাধারণ মানুষের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির ভোক্তারা এ নিয়ে ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।

গত ১৬ মে গুয়াংজু খাদ্য এবং ঔষধ প্রশাসন জানায়, তারা স্থানীয় বাজার থেকে ১৮টি চালের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে ৮টিতেই অত্যাধিক মাত্রায় ক্যাডমিয়াম পাওয়া গেছে। সবচে’ বেশি বিষাক্ত চালগুলো এসেছে দক্ষিণের প্রদেশ গুয়াংজু থেকে। গুয়াংজু চীনের সর্বোচ্চ চাল উত্পাদনকারী প্রদেশ।

রাষ্ট্র চালিত পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসকে দেয়া সাক্ষাত্কাররে বেইজিংয়ের চীন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ফান জিহং চালে ক্যাডমিয়াম মিশ্রণের কারণ প্রসঙ্গে বলেন, “চাল যেখানে জন্মায়, ক্যাডমিয়াম সাধারণত সেখানকার মাটি থেকে আসে। তবে এই মাটি দূষণের ঘটনা ঘটে খনি এবং রাসায়নিক বর্জ্য থেকে।”

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে খাদ্য ভীতি বা কেলেংকারীর ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। এ তালিকায় নতুন সংযোজন হলো চাল। গত মাসেই সাংহাই এবং জিয়ানসুতে ইঁদুর এবং শেয়ালের মাংসকে শুকরের মাংস হিসেবে বিক্রির ঘটনা প্রকাশ পায়।

গত এক দশক ধরে চালের দূষণ চীনে একটি সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১১ সালে নানজিং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দেশে বিক্রিত চালের প্রায় ১০% এর মধ্যে অত্যাধিক মাত্রায় ক্যাডমিয়াম রয়েছে। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের ৭০% পর্যন্ত কৃষিজমি কঠিন ধাতু এবং রাসায়নিক সারের জন্য দূষিত হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সরকারি কর্মকর্তারা এই দূষণ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন না। গত বছর, বেইজিংয়ের একজন আইনজীবী চীনের জমি দূষণের তথ্য প্রকাশ করার জন্য আবহাওয়া কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন। “রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা'র দোহাই দিয়ে কর্তৃপক্ষ সে অনুরোধ প্রত্যাখান করে।

একজন চীনা অধিবাসী কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপল'স ডেইলি থেকে একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে:

Map of China's rice pollution is widely shared on Weibo. (Image from Weibo)

চীনের চাল উৎপাদনকারী অঞ্চলের মানচিত্র। ছবিটি উইবুতে বিপুল সংখ্যক বার শেয়ার হয়েছে। (ছবি উইবু থেকে নেয়া)

যেসব খাদ্যে ক্যাডমিয়াম আছে সেগুলো “দীর্ঘমেয়াদী বিষাক্ত” খাদ্য যা সাধারণ পরিস্থিতিতে বড়ো ধরনের কোনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা ঘটায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ খাদ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। যার ফলে তারা নিয়ম ভাঙ্গে। আইনুযায়ী শাস্তির দেয়ার বদলে তারা তাদের পদ ধরে রাখতেই সচেষ্ট থাকে।

চালে ক্যাডমিয়াম পাওয়ার প্রেক্ষিতে চীন সরকারের মুখপাত্র বলে পরিচিত সিনহুয়া দ্রুত একটি লেখা দেয়, যার শিরোনাম ছিল “সারাবছর-ই এক জায়গার চাল না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।” এই প্রতিবেদনে চালে ঝুঁকি কমাতে জনগণকে চালে বৈচিত্র্য আনার পরামর্শ দেয়া হয়।

এই পরামর্শ অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। চীনের জনপ্রিয় মাইক্রোব্লগ সাইট সিনা উইবুতে “বলিন” নামের একজন ব্যঙ্গ করে লিখেন:

পিপল'স ডেইলি আমাদের বলে, বিষাক্ত খাবার বিক্রি করা আইনসিদ্ধ। সব ধরনের বিষাক্ত খাবার খেয়ে, আমরা একটিমাত্র বিষাক্ত খাবারে মরবো না বোধহয়।

“লুই উয়েনকি একজন লেখক। বাস করেন সাংহাইয়ে। তিনিও এর প্রতিধ্বনি করেছেন:

তার মানে কী, ব্যালেন্স করার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরনের দূষণ মেইনটেইন করতে হবে?

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবাদী ডং লিয়ানজি:

শুধু ক্যাডমিয়াম মিশ্রিত চান নয়, সিসা এবং আর্সেনিক মিশ্রিত চালও বাজারে পাওয়া যায়। এর কোনো কোনোটি মধ্যে একই সঙ্গে দুই/তিনটি অত্যাধিক মাত্রায় রাসায়নিক পাওয়া যায়। দুষিত চাল শুধুমাত্র হুনান প্রদেশে নয়, হুবেই, জিয়াংসি, গুয়াংসি, গুয়াংডং, হেনান, হেবেই এবং অন্যান্য প্রদেশে পাওয়া যায়। এটা শুধুমাত্র কয়েক হাজার টন নয়, মিলিয়ন মিলিয়ন টনে পাওয়া যায়। অনেক জায়গাতেই অনেক বেশি দুষিত চাল পাওয়া যায়। তাহলে আমরা এটা পালাক্রমে কীভাবে খাবো? এই সিস্টেমের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যার ট্র্যাক রাখতে পারেন না অথবা সত্যি কী হয়েছে তা নিয়ে বলতে পারেন না। তারা শুধুমাত্র করদাতাদের টাকা ব্যবহার করছেন। আর জনগণের মনোযোগ অন্য দিকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের পেশাগত নৈতিকতা কী বলে?

অনলাইন ব্যক্তিত্ব এবং সমাজ সমালোচক “জিউ মানজি” পরামর্শ দিয়েছেন, চালের মধ্যে কী পরিমাণ বিষাক্ত উপাদান রয়েছে, তা প্যাকের গায়ে উল্লেখ করার কথা বলেছেন:

সাম্প্রতিক সময়ে চালে ক্যাডমিয়াম থাকার বিষয়টি দেখা যাচ্ছে। আর এই চাল দূষণ দেশজুড়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমি চাল, আটার প্যাকে কী পরিমাণ বিষাক্ত উপাদান আছে তা উল্লেখ করার পরামর্শ দিচ্ছি। আমদানিকৃত বিদেশী গুঁড়া দুধের ছবি আমরা সত্যি সত্যি আবার দেখতে চাই না। গুঁড়া দুধ আমরা বহন করে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু চাল, আটা বাইরে থেকে নিয়ে আসা কষ্টকর। প্যাকের ওপরে এই তথ্য প্রিন্ট করা থাকলে আমরা নিরাপদ বোধ করবো। কেউ কি আমার আইডিয়া সমর্থন করেন?

“বেইয়ু জিজু মেংজিয়ান জিলভ” নামের একজন অনলাইন ব্যবহারকারী অভিযোগ করেছেন:

যেখানে পানি, বায়ু এবং খাবার-দাবার বিষাক্ত হয়ে গেছে, সেখানে আপনি দূষণমুক্ত খাবার পেতে পারেন না। কিন্তু বিষাক্ত খাদ্যে কী পরিমাণ থাকলে চীনের সাধারণ মানুষ বিষ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, সেটার জন্য আমরা লড়াই করতে পারি।

কেইজিংয়ের ধারাভাষ্যকার ইয়ে ট্যান, খাদ্য নিরাপত্তা ইস্যুতে আরো বেশি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য হুনান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। যদিও চীনের চাল উত্পাদনকারী অঞ্চলসমূহের ম্যাপ দেখলে বোঝা যায়, এই সমস্যা একমাত্র হুনান প্রদেশের নয়, চীনের একটা বড়ো অংশ জুড়ে এই সমস্যা দেখা যায়:

হুনান সরকার জনগণকে যথাযথ তথ্য দিয়ে এই সমস্যার সমাধানের জন্য কাজ করতে পারে। প্রকৃত তথ্য ও স্বীকৃতি ছাড়া ভোক্তারা বিষাক্ত মাটিতে জন্মানো চাল থেকে বিষমুক্ত মাটিতে জন্মানো চালের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না। তাদের জন্য সবচে’ সহজ পথ হচ্ছে হুনানের চাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। যদি তথ্য জনগণের কাছে সহজলভ্য হয়, তাহলে তারা হুনান প্রদেশের চালকে বিষাক্ত এবং নিরাপদ এই দু'ভাগে সহজে ভাগ করে ফেলতে পারে। আর যদি তথ্য সহজলভ্য না হয়, তবে হুনান সুনামের জটিলতায় ভুগবে। দেশের চাল উৎপাদনের মোট কৃষিজমির ১৩% হুনানের, যা নষ্ট হয়ে যাবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .