ভারতঃ স্বামীদের, গৃহকর্মের জন্য গৃহিণীকে অর্থ প্রদান করতে হবে?

ভারতের কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি খসড়া আইনের কথা বিবেচনা করছে, যদি সংসদে পাস হয়, তাহলে উক্ত আইনের ভিত্তিতে গৃহকর্ম বাবদ মাসিক আয়ের একটা অংশ স্ত্রীদের প্রদান করতে স্বামীরা আইনত বাধ্য থাকবে।

মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী, এই বিষয়ে এমন এক কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে যা কিনা গৃহস্থালী কাজের অর্থনৈতিক মুল্য নির্ধারন করবে এবং সাথে গৃহকর্মে দেওয়া শ্রমের এই ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে অর্থনীতিতে নারীদের (গিন্নিদের) অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হবে।

প্রস্তাবিত এই আইনে আশা করা হচ্ছে যে গৃহকর্মের সাথে জড়িত নাগরিকদের “গৃহ প্রকৌশলী” (হোম ইঞ্জিনিয়ার) হিসেবে অভিহিত করা হবে। নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাথ বলেছেন, এই অর্থের পরিমাণ হবে স্বামীদের মাসিক আয়ের ১০ থেকে ২০ শতাংশের মাঝামাঝি একটি অংশ। তবে এটিকে গিন্নিদের গৃহকর্ম বাবত মাসিক আয় বিবেচনা করা যাবে না, তার বদলে একে একটা সম্মানী বা এ রকম কিছু হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যখন মন্ত্রী এই আইনকে নারীর ক্ষমতায়নের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া হিসেবে দেখছেন, তখন এই প্রস্তাব একই সাথে অনলাইন এবং অফলাইনে (বাস্তব জগতে) উত্তপ্ত এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

A woman washing clothes. Image by Neil Moralee CC BY-NC-ND 2.0

একজন বধূ কাপড় ধুচ্ছে। ছবি নেইল মোরালি-এর সিসি বাই এনসি এনডি ২.০।

অনেকে মনে করে যে, ঘরের কাজ, যাতে কখনো বেতন দেওয়া হয় না, তার জন্য একটা অর্থ মূল্য নির্ধারণের বিষয়টি ধারণাগত ভাবে সঠিক এবং তা একটা ভালো প্রচেষ্টা, যদিও এই সব কাজের ভিত্তিতে স্বামীকে তার বেতনের একটি সুনিদিষ্ট অংশ স্ত্রীকে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রদান করানোর এই প্রচেষ্টা হয়ত ভুলভাবে এগুবে।

অন্যরা বিস্মিত যে দৈনন্দিন ঘরের কাজের “মূল্য নির্ধারণ” কি ভাবে সম্ভব এবং কি ভাবে এ রকম একটি আইন প্রয়োগ করা সম্ভব হবে- এখন এই বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এসে হাজির হচ্ছে নিঃসন্দেহে যা এর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে।

এবং ঘটনা হচ্ছে ইতোমধ্যে প্রশ্ন উত্থাপন করা শুরু হয়েছে। লর্ডরাজ জিজ্ঞেস করেছে :

  • আপনারা কি স্বামী স্ত্রীর সর্ম্পকের মাঝে মালিক কর্মচারীর সর্ম্পক স্থাপন করার পরামর্শ প্রদান করছেন?
  • এখানে কে শ্রম ঘন্টা এবং পেশার বৈশিষ্ট্যাবলি নির্ধারণ করবে?

একটি উন্মুক্ত সংবাদ প্লাটফর্ম গ্রাউন্ড রিপোর্ট-এ, ডি চৈতন্য এই বিষয়ে আরো কিছু প্রশ্ন চিহ্নিত করেছেন, যা নাগরিকরা (নারী এবং পুরুষ উভয়ে) এই প্রচণ্ড বিতর্কিত বিষয় নিয়ে করতে শুরু করেছে। যেমন এর উদাহরণ হচ্ছে:

  • যদি ঘরের প্রতিদিনের কাজ গৃহকর্ত্রীর বদলে গৃহকর্মীর উপর ন্যস্ত থাকে, তাহলে গৃহকর্মীকে কোন জায়গা থেকে দেখা হবে? সে ক্ষেত্রে গৃহকর্মী কি গৃহকর্ত্রীর স্থানে চলে আসছে না? (আর এই ধরনের ঘটনায় ) কে এই ১০ অথবা ২০ শতাংশ আয়ের বৈধ দাবীদার বলে বিবেচিত হবে?
  • যদি আয়ের ১০ বা ২০ শতাংশ স্ত্রীর নামে জমা করা হয়, তাহলে যদি স্ত্রী তার স্বামীর কাছে নিজের প্রাপ্য দাবী তুলে ধরে অথবা ভরণপোষণের জন্য স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে, সে ক্ষেত্রে ভরনপোষণের জন্য দাবী করা অর্থের ব্যাপারটির কি হবে?
  • এই আইন কি স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝে নতুন এক অর্থনৈতিক লড়াইয়ের সুত্রপাত ঘটাবে? দণ্ডবিধির ৪৯৮-এ ধারা, ভরণপোষণ আইন, ঘরোয়া নির্যাতন বিরোধী আইন, ইত্যাদি আইনের মত, কতিপয় স্ত্রী কি এই আইনেরও অপব্যবহার করবে?

ব্লগার সুরিয়া মুরালি নিজেও বিস্মিত যে, এই অবস্থায় সরকার কি ভাবে এই রকম একটি আইন প্রয়োগের প্রস্তাব করতে পারে। ভদ্রমহিলা তার ব্লগে বলছেন :

আমি সকল ভাবে নারীর ক্ষমতায়ন এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে…(কিন্তু) এই সমস্ত আইন প্রণেতারদের কাছে আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, কি ভাবে তারা এই প্রস্তাব প্রয়োগ করার পরিকল্পনা করেছে? যদি তারা এ ভাবে কাজটি করে যে স্বামীকে তার স্ত্রীর ঘরের কাজের সম্মানী বাবদ বেতনের একটা অংশ প্রদান করতে হবে, সে ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কি ভাবে উন্নত হবে বা কি ভাবে তা নারীদের স্বাধীন করবে এবং কি ভাবে এর মধ্যে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবে তা আমার নজরে আসছে না। এতে গৃহস্থালীর মোট আয়ের পরিমাণ একই থাকবে, এর অর্থনীতির কোন পরিবর্তন ঘটবে না। আমার বিশ্বাস, যে সমস্ত স্বামীরা অত্যন্ত দায়িত্ববান, যে ভাবে হোক ঘর চালানোর জন্য তারা তাদের মাসিক বেতনের একটা অংশ স্ত্রীকে প্রদান করে থাকে… যদি ঘটনা এই রকমটি না হয়, সেক্ষেত্রে প্রস্তাবিত এই ধরনের প্রকল্প সেই সব স্বামী-স্ত্রীর গৃহস্থালীর হিসেবের ভারসাম্যে কোন রকম উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হবে না।

আইদিভাতে, আর্চনা জয়কুমার প্রশ্ন করেছে:

এই সমস্ত বিষয়গুলো স্ত্রীকে কেবলই কি এক গৌরবান্বিত ক্রীতদাসীতে পরিণত করছে না?

সুপারি.অর্গ-এ, সুনিতা এই বিষয়ে উপর চিন্তাধারার সাথে একমত এবং সে প্রস্তাবিত এই আইনকে সরকারের এক “পরিবার ভাঙনের উদ্যোগ” হিসেবে অভিহিত করেছেন। ব্লগার লর্ডরাজ তার লেখার উপসংহার টেনেছেন এভাবে যে:

নারী “উন্নয়ন এবং কল্যাণের” নামে আপনারা যা করছেন তা হচ্ছে পুরুষের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রচারণা।

পুরুষদের দাবী আদায়ে নিয়োজিত দলসমূহের এই বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ভিকি নানজাপ্পা উল্লেখ করেছেন:

পুরুষ অধিকার দলসমুহ, স্বামীর আয়ের একটি অংশ তার স্ত্রীকে প্রদানের প্রস্তাবিত এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করেছে। “সেভ ফ্যামিলি ফাউন্ডেশন” (পরিবার রক্ষা সংস্থা) নারী এবং শিশু কল্যাণ মন্ত্রী কৃষ্ণা তিরাথকে একটি চিঠি লিখেছে, যে চিঠিতে তারা দ্রুত এই প্রস্তাব অপসারণের দাবী জানিয়েছে। সারা দেশে ভিন্ন ভিন্ন ৪০টি পুরুষ সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে এমন একটি ফাউন্ডেশন, এই প্রস্তাবকে একপেশে হিসেবে অভিহিত করেছে।

মনে হচ্ছে দি কার্সড ইনডিয়ান মেল নামক ব্লগার ইতোমধ্যে এর চাপ অনুভব করছেন। তিনি আর্তনাদ করছেন:

যখন এই রকম একটা অর্থ প্রদান করা হবে, তখন এই বিষয়টি আর বিস্ময়কর থাকবে না যে অনেক স্ত্রী হয়ত ঘরে অলস হয়ে বসে থাকবে এবং ভারতীয় বিচার বিভাগের আশীর্বাদে বিনে আয়েসে তাদের স্বামীদের একটা অংশ পেয়ে যাবে। আর এই সকল কিছু করা হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়নের নামে।

তবে, নানাবিধ কারণে অন্যরা এই প্রস্তাবের প্রতি বেশ খানিকটা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিফেন্স ফোরাম ইনডিয়ার এক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, দৃশ্যত ইউসুফকে এই বিষয়টি আনন্দিত করেছে। সে লিখেছে :

প্রকৃতপক্ষে এই সংবাদটি যেন সঙ্গীত হয়ে আমার কানে প্রবেশ করেছে। আয়কর বাঁচানোর আরো কিছু উপায় আমাকে প্রদান কর।:-)

ব্লগার সুরিয়া মুরালি একটি প্রস্তাব প্রদান করেছেন, যাকে তিনি এই বিষয়ে আর বাস্তববাদী এক সমাধান বলে মনে করেন, কখনো কখনো যা সংসারে “মালিক- কর্মচারীর” মত এক উঁচুনিচু সর্ম্পকের বাইরেও নারীদের জন্য সত্যিকার সুবিধা প্রদান করবে। তিনি পরামর্শ প্রদান করেছেন:

সরকারকে এমন এক পন্থা বের করতে হবে যার মধ্যে দিয়ে সরকার গৃহ কর্মের অর্থনৈতিক মান মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয় এবং তার ভিত্তিতে সরকার নিজে গৃহিণী /গৃহসজ্জা নির্মাতাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। এই ঘটনায় মাঝখান থেকে স্বামীকে আর অর্থ প্রদান করতে হবে না এবং যারা গৃহিনীদের ক্ষমতায়ন চান, এই ঘটনায় তাদের সাথে গৃহিণীদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। আমার মতে এই ঘটনা কেবল নারীদের ক্ষমতায়নই ঘটাবে না, একই সাথে তা গৃহস্থালীর সাধারণ মানেরও উন্নতি ঘটাবে যা অন্যথায় গৃহিণীদের কায়ক্লেশে চালাতে হয়। এইভাবে একই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং নারীর ক্ষমতায়ন, দুটো লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব।

ইনফোকুইনবি এই বিষয়ে একমত এবং সাথে যোগ করেছে :

গৃহিণীদের জন্য “বেতন” প্রদানের আইন তৈরীর বদলে নারী ও শিশুদের জন্য অন্য ধরনের কিছু প্রকল্প হয়ত চালু করা যেতে পারে, যেমন বিধিবদ্ধ-সর্বনিম্ন অর্থ প্রদান/ আবশ্যক জীবন বীমা, চিকিৎসা বীমা, বিনিয়োগ ইত্যাদি।

মন্ত্রীর এই প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কি ঘটে তা দেখার জন্য আমরা যখন অপেক্ষা করে আছি, তখন মনে হচ্ছে, স্বামীদের “গৃহ প্রকৌশলী” হিসেবে পরিচিত তার গৃহিণীকে বাধ্যতামূলক ভাবে “সম্মানী” প্রদানের বিষয়কে ঘিরে যে বিতর্ক। তার সমাপ্তি ঘটতে এখনো অনেক সময় বাকী।

থাম্বনেইল ছবিটি টড বারমেন-এর (দিআর্টডোন্টস্টপ.অর্গ থেকে নেওয়া) সিসি: বাই এনসি-এসএ ২.০

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .