তাজিকিস্তান: গরীব দেশে মাদক অর্থনীতি

কখনো কখনো স্থানীয় সংবাদপত্রের ওপর কড়াকড়ি থাকায় বিদেশী ম্যাগাজিনে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ হলে তা সমাজে আলোড়ন ফেলে। ইকোনমিস্ট পত্রিকায় তাজিকিস্তানের ওপর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হলে সেখানকার সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটে দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের দূর্নীতি এবং মাদক ব্যবসায়ে জড়িত থাকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়।

নিবন্ধটির শিরোনাম ছিল: তাজিকিস্তানে মাদক: নেশাগ্রস্ত। এখানে দাবি করা হয়েছে, দেশটির স্থিতিশীলতা নির্ভর করছে এই এলাকার মধ্যে দিয়ে অবাধ মাদক সরবরাহ করতে দেয়ার মধ্যে। ১৯৯০ সালে সাত বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে মধ্য এশিয়ার এই ছোট্ট দেশটির আফগানিস্তানের সাথে রুদ্ধ সীমান্ত রয়েছে, যেখান দিয়ে আফগান হেরোইন রাশিয়ায় পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এর ফল স্বরূপ দেশটি পরিণত হয়েছে “মাদক পাচারের মাল্টি মিলিয়ন ডলার নেটওয়ার্ক স্বর্গ” হিসেবে। এবং ক্রমাগত দারিদ্র্য বাড়া সত্ত্বেও দেশটির রাজধানী “নগদ টাকা, ফ্ল্যাট বাড়ি আর দামি গাড়িতে ঠাসা”।

আফগানিস্তান লাগোয়া তাজিকিস্তানের দক্ষিণের একটি সীমান্ত চৌকি।

আফগানিস্তান লাগোয়া তাজিকিস্তানের দক্ষিণের একটি সীমান্ত চৌকি। ছবি আলেক্সজান্ডার সোদিকভ (২০০৯)

ইকোনমিস্টের ভাষ্যমতে, আগে যারা মাদক পাচারের বিরোধীতা করতেন সেইসব সরকারি কর্মকর্তারাই এখন মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এরা স্থানীয় নিরাপত্তার দেখভালও করেন। এর ফলে সরকার মাদক ব্যবসায় তাদের ভূমিকা সরকার না দেখার ভান করে। ইকোনমিস্ট দাবি করেছে, তাদের এই বোঝাপড়ায় কোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ করতে গেলে দেশটির ১৯৯০ সালের গৃহযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতা আবার হবে।

নিবন্ধটি ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখে প্রকাশিত হলেও তাজিকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের কাছে পৌছায় মে মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় পত্রিকাগুলো এটির অনুবাদ এবং পুন:মুদ্রণ প্রকাশ করলে।

রেডিও ওজডি নিবন্ধটির সংক্ষিপ্তসার করে প্রকাশ [তাজিক ভাষা] করলে তাজিক কর্মকর্তা এবং বিশেষজ্ঞরা এর সমালোচনা করেন। একজন পাঠক মন্তব্যের ঘরে পরামর্শ দেন, ম্যাগাজিনটি যে দাবি করেছে, তা “ভুয়া” অথবা অতিরঞ্জিত। তবে অন্য পাঠকরা তার মূল্যায়নের বিরোধীতা করেন:

Инсон: Рост гуфтаст ин “Economist”. Кучояш дуруг аст??? Ягон гапи хато нагуфтааст, биёед аз руи инсоф гап занем.

ইনসন: ইকোনমিস্ট সত্য কথাটাই তুলে ধরেছে। আপনি কোথায় মিথ্যে খুঁজে পেলেন? সবটাই সত্যি। আমাদের নিজেদের কাছে সত্ থাকা উচিত।

Махмуд: Ин мачалла магзи хакикати гапа гуфтааст.

মাহমুদ: ম্যাগাজিনটি মূল ইস্যুটা তুলে ধরতে পেরেছে।

বেশিরভাগ সংবাদ ওয়েবসাইটে আলোচনা নিবদ্ধ আছে হেরোইন ব্যবসায় সংঘটিত দূর্নীতি নিয়ে। সরকারি কর্মকর্তা বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল গাড়ি, বাড়ির মালিক হওয়া নিয়ে তাজিকিস্তানের জনগণের সন্দেহ আছে। অথচ তাদের এই বিলাসতার বিপরীতে দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে।

রাভসান_১৯৮০ টপটিজেডটকম-এ [রাশিয়ান ভাষায়] পরামর্শ দিয়েছেন:

Ну конечно весь наркооборот контролируется людьми, связанными с государством! И руководители страны и правоохранительных органов смотрят на это сквозь пальцы. Иначе почему никто не спрашивает у работников МВД, прокуратуры и АКН откуда у них шикарные автомобили и дорогие квартиры несмотря на мизерные зарплаты?

অবশ্যই মাদক ব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের সাথে সরকারের যোগাযোগ রয়েছে। দেশটির নেতৃত্ব এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেটা দেখেও না দেখার ভান করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় [পুলিশ], প্রসিকিউটর অফিস, মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কর্মকর্তারা এতো কম বেতনে কিভাবে দামি গাড়ি-বাড়ি করেন, সে প্রশ্ন কেউ করে না।

রেডিও ওজডির ওয়েবসাইটে আরো একজন মন্তব্যকারী একই ধরনের অভিমত দেন:

Мачаллаи бритониёи бисёри бисёр Точикистони азизи дилу дидаи моро сад дар сад дуруст фахмидааст. Хамаи кормандони сохибвазифаи ватани мо кариб 99 фоизашон ба ришвагири машгуланд, кадом коргари имрузаи точик бо музди мехнати таинкардаи имрузаи давлат сохиби хонаву дар сохиби мошинхои аз 50 то 100 хазордоллара мегардад? Ягонтаашон сохиб намешуд, на прокурор на суд на полис на дигару дигар… Ана хамин сохторхои гуфташуда ва чанд сохторхои дигар сохиби хамаи нушу неъмати зиндаги хастанд… Вой бар холи мардуми камбагал, бовар кунед, кариб ки нони хурдан надоранд,

ব্রিটিশ এই জার্নালটি তাজিকিস্তানের অবস্থার খুব ভালো মূল্যায়ন করেছে। দেশটির ৯৯% এর বেশি সরকারি কর্মকর্তা দূর্নীতিগ্রস্ত। তা না হলে তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বেতনে কিভাবে সম্ভব ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলারে গাড়ি বাড়ি কেনা? শুধু রাষ্ট্রীয় বেতনে প্রসিকিউটর অফিস, আদালত, পুলিশ অথবা এ ধরনের কোনো সংস্থার একজন কর্মচারীর পক্ষে এগুলোর ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব না। এই কর্মচারীরা তাদের মর্জিমতো সবকিছুই করতে পারে। একজন দিন এনে দিন খাওয়া দরিদ্র লোকের পক্ষে এগুলোর দেখা পাওয়া দুষ্কর।

মাদক ব্যবসার দূর্নীতি কী কার্যকরভাবে রোধ করা যায়? এজন পাঠক মনে করেন, আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ দরকার:

Ravshan_1980: Я думаю, что необходимо заставить наших чиновников предоставлять налоговые декларации и объяснять откуда у них автомобили и дома.

আমি মনে করি, সরকারি কর্মকর্তাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করা উচিত। এতে তারা ব্যাখ্যা করবেন গাড়ি-বাড়ি কেনার টাকা তারা কোথায় পেলেন।

আবার অন্য আরেকজন পাঠক মনে করেন, মাদক পাচার বন্ধ করা অসম্ভব। কারণ এ ব্যবসার সাথে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত। তারা একই সঙ্গে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ।

Мохира: Проблема в том, что наши правоохранительные органы – на всех уровнях – крышуют наркобизнес и живут за его счет. Эти же органы являются фундаментом нынешнего режима. Лишение правоохранительных органов денег, которые они получают за крышевание преступности, означало бы разрушение фундамента нынешнего режима. Все взаимосвязано.

মহিরা: প্রকৃত সমস্যা হলো, আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সব স্তরের লোকজন মাদক পাচারকারীদের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তাদের খরচে নিজেদের জীবনও চালায়। এই সংস্থাগুলো শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে শাসনব্যবস্থার এই ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। সবকিছুই একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত।

সম্প্রতি তাজিকিস্তানের একজন উচ্চ পদস্থ মাদকবিরোধী কর্মকর্তা স্বীকার [রাশিয়ান ভাষায়] করেছেন যে, দেশটির “উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার সহযোগিতা ছাড়া কোনো মাদক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে না”। ফেব্রুয়ারি ২০১২-এ কর্তৃপক্ষ দূর্নীতি এবং মাদক চোরাচালানের অভিযোগে একজন হাই প্রোফাইল ব্যক্তির গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়। এ থেকে বোঝা যায়, সরকার দীর্ঘমেয়াদে সিরিয়াসভাবেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এ মাসে একটি খবর বেরিয়েছে, জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ অধিদপ্তর (ইউএনওডিসি) আনুমানিক হিসাব দিয়েছে, বছরে ৭৫ থেকে ৮০ টন আফগান হেরোইন এবং ১৮ থেকে ২০ টন অপিয়াম তাজিকিস্তান হয়ে অন্য দেশে গেছে। এর মানে হচ্ছে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কিলোগ্রাম হেরোইন এবং ৫০ কিলোগ্রাম আফিম দেশটিতে ঢুকেছে। এর অল্প অংশই আটক করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়েছে, অনেক সরকারি কর্মকর্তা এই ব্যবসার সরাসরি জড়িত অথবা অন্যভাবে ঘুষ নিয়ে থাকে। ইউএনওডিসি’র হিসাবমতে, ২০১০ সালে মধ্য এশিয়ার মাদক ব্যবসা থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার তাজিক পাচারকারীর কাছে গেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে:

মাদক থেকে আসা অর্থ দুশানবে এবং এই প্রদেশের সম্পত্তির মূল্য আকাশছোঁয়া করেছে। অন্য লক্ষণগুলো হলো বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মধ্য দিয়ে শান-শওকতের প্রকাশ। এই বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ির মালিকানার পেছনে সরকারি কর্মকর্তারা রয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .