ভারতঃ নতুন প্রণীত তথ্য প্রযুক্তি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

২০১১ সালের এপ্রিল মাসে ভারতের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় অনেকটা নীরবে তথ্য প্রযুক্তি বিধিমালা ২০১১ (মাধ্যমিক পর্যায়ের নির্দেশীকা) জারি করে, ওয়েবের “অপমানজনক”, “হয়রানি”, “ধর্ম নিন্দা” অথবা “ঘৃণা” ছড়ানোর উপাদান নিয়ন্ত্রণের জন্যে। দি সেন্টার অফ ইন্টারনেট অ্যান্ড সোসাইটির ব্লগে রিশাভ দারা উল্লেখ করেন যে এই বিধি ইন্টারনেটে মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এক তীব্র প্রভাব ফেলবে।

উপরন্তু, ভারত সরকার নিয়ন্ত্রণের এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানিয়েছে যাতে ভারত-ভিত্তিক আপত্তিকর বিষয়গুলো বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্ক সাইট যেমন ফেইসবুক, গুগল এবং ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। সংবাদের সূত্রানুসারে একই সাথে সরকার চাইছেন যেন আন্তর্জাতিক এই সব প্রতিষ্ঠানগুলো ভারতে তাদের সেবা প্রদান কেন্দ্র (সার্ভার) স্থাপন করে যাতে স্থানীয়ভাবে এই সমস্ত উপাদান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

“আপত্তিকর” বিষয়বস্তুর উপস্থিতির জন্যে আমরা ইতোমধ্যেই বেশকিছু বিষয় অনলাইন থেকে সরিয়ে নেওয়ার মত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি। বিনয় নাইডু জানাচ্ছে, কিভাবে মুম্বাই পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগ কার্টুনিস্ট অসীম ত্রিবেদির কার্টুনএগেনেইস্টকরাপশন (www.cartoonsagainstcorruption.com) নামক ওয়েবসাইট-এর উপর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। মূলত অসীম ত্রিবেদির কার্টুন জাতিকে হেয় করেছে, এমন এক অভিযোগের পর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়:

এই ঘটনায় না ছিল কোন আইনগত বিজ্ঞপ্তি, না ছিল কোন আদালতের আদেশ, না ছিল কোন আগাম সতর্কবার্তা, এমনকি আপত্তিকর বিষয়গুলো সরিয়ে ফলার অনুরোধ জানিয়ে কোন চিঠি/ই-মেইল ও প্রদান করা হয়নি। এবং বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি হল মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধরন। এরপর থেকে, অসীম ত্রিবেদি তার ব্লগ কার্টুনএগেনেইস্টকরাপশন.ব্লগস্পট.ইন www.cartoonsagainstcorruption.blogspot.in-এর মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, যে ব্লগটি এখন অনেকটাই সরকারি নজরদারির মাঝে রয়েছে।

ফেসবুকে অসীম ত্রিবেদি এবং সাংবাদিক অলক দীক্ষিতের ‘সেভ ইউর ভয়েস’ নামক প্রচারণা।

ফেসবুকে অসীম ত্রিবেদি এবং সাংবাদিক অলক দীক্ষিতের ‘সেভ ইউর ভয়েস’ নামক প্রচারণা।

এই ধরনের হুমকির বিষয়ে ইন্ডিব্লগার.ইন (Indiblogger.in)-এর আলোচনা ফোরামে “ইন্টারনেট সেন্সরশিপ” নিয়ে আরো কিছু মন্তব্য প্রদান করা হয়:

ব্লগার অমৃত হাল্লান লিখেছেন:

অকপটে বলা যায়, ইন্টারনেট উক্ত ব্যক্তিদের নোংরামি প্রকাশ করে তাদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে উইকিলিকস-এর পর, টুইটার এবং ফেসবুক-এ বাঁধাহীন আলোচনা, এবং সামাজিক নেটওয়ার্ক সমর্থিত গণজাগরণের ঘটনার পরে। আর এ ক্ষেত্রে শুধু সরকার নয়, সকল সংস্থা, হতে পারে আমলাতন্ত্র, গতানুগতিক মূলধারার গণমাধ্যম এবং পুরোনো ব্যবসায়িক ধারা, যা নাগরিকদের একে অপরের সাথে যোগাযোগ অক্ষমতার সুযোগে সমৃদ্ধি লাভ করে; এসব প্রতিষ্ঠান, ইন্টারনেটে অবাধ তথ্য প্রবাহের টুটি চিপে ধরতে চায়। সুনির্দিষ্টভাবে এ কারণে নতুনভাবে সরকারি সেন্সরশিপ আরোপের বিষয়ে টিভি চ্যানেলগুলো কোন হৈচৈ করছে না।

অমৃত, সরকার কর্তৃক ঘোষিত নতুন তথ্য প্রযুক্তি নির্দেশাবলী আনুযায়ী হুমকির একটি তালিকা করেন যা অরওয়েলের দুনিয়ার সৃষ্টি করবে (জর্জ অরওয়েল এক ব্রিটিশ লেখক) ।

ইন্টারনেট ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট, আনিয়া কোভাসের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করেছে, যা এই ধরনের নিয়মের পেছনের কারণ সম্পর্কে জানায়:

জন্মলগ্ন থেকে, স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সেন্সরশিপ চালু হয়েছে একই সাথে ভারতে অসাধারণ বৈচিত্র্যময়তা থেকে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তির হাতিয়ার হিসেবে এবং একক সামাজিক, নৈতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে।[..]

কিন্তু যদি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের আবির্ভাবে ইতোমধ্যে এই কৌশল নাজুক হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে ইন্টারনেট নিঃসন্দেহে স্পষ্ট করেছে যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে, যে এই ধরনের সেন্সরশিপ একেবারে অচল।[..]

ভারতের সেন্সরশিপের ব্যবহার, জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করার একটি উপায়, যা নিঃসন্দেহে একটা পর্যায়ে এসে বিলুপ্ত হতে থাকে এবং নিরব হয়ে যায়, স্বয়ং ভারতীয় সমাজের বিশাল বৈচিত্র্যময়তায় সেন্সরশিপ সবসময় বিদ্যামান পরিস্থিতিকে সুবিধা প্রদান করে এবং ভারতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি ব্যতিক্রম নয়।

ইন্টারনেট ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট এর ভিডিওটিতে নতুন তথ্য প্রযুক্তি আইনের প্রভাব তুলে ধরছে:

এই ঘটনায় ভারতীয় নেটনাগরিকরা অলসভাবে বসে নেই। “ভারতীয় সংসদের সদস্যরা: ইন্টারনেটের স্বাধীনতা রক্ষায় এই ধরনের আইনের বিলোপ সাধনের গতিকে সমর্থন করুন# স্টপআইটিরুলস” নামক এক শিরোনামে একটি পিটিশন (আবেদন) ওয়েবে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ক্রমশ আরও অনেক নাগরিক এতে স্বাক্ষর করছে। গত ২২শে এপ্রিল তারিখে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এবং ফোরাম একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যা বলছে:

এই বিধিমালার সম্ভাব্য ক্ষতিকারক প্রভাবের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে, মাননীয় সাংসদ সদস্য, শ্রী পি. রাজীভ পূর্বোক্ত বিধিমালা বাতিল করার জন্য সংসদে একটি বিধিবিদ্ধ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এই উত্থাপিত প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে রাজ্যসভায় বাজেট সংক্রান্ত দ্বিতীয় অধিবেশনের আগে, যা কিনা ২৪শে এপ্রিল ২০১২ তারিখে শুরু হবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রস্তাব বাতিলকরণ সমর্থন করার জন্য সকল সাংসদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে । সংশোধিত তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) নিয়মাবলী-কে “অসাংবিধানিক” উল্লেখ করে ইতোমধ্যে কেরালা অঙ্গরাজ্যে জনস্বার্থ একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এই বিষয়ে আরো বেশ কয়েকটি প্রচারণার একটি তালিকা:

  • ইন্টারনেট ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ব্লগারদের উপর আরোপিত সেন্সরশিপের বিষয়ে দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে, যার নাম “মেক ব্লগ নট ওয়্যার” [ব্লগ লিখ যুদ্ধ নয়]।
  • অসীম ত্রিবেদি এবং সাংবাদিক অলোক দীক্ষিত ফেসবুকে একটি প্রচারণা শুরু করেছে, ““সেভ ইউর ভয়েস” [ আপনরা কণ্ঠকে রক্ষা করুন] শিরোনামে, যা অনেক প্রতিবাদের ঘটনা উল্লেখ করেছে।
  • একটি টাম্বলার সাইট “ডোন্ট সেন্সর মি” [আমাকে সেন্সর করবেন না] এই প্ল্যাকার্ড ধারণকারী কয়েকজন ব্যক্তির ছবি প্রকাশ করে।
'ডোন্ট সেন্সর মি'- ছবি প্রাণেশ-এর।

‘ডোন্ট সেন্সর মি’- ছবি প্রাণেশ-এর। http://dontcensormeindia.tumblr.com/ এর সৌজন্যে পাওয়া।

আইটি বিধিমালার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন অংশে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে। ২১শে এপ্রিল তারিখের একটি প্রতিবাদ সম্পর্কে আশফাক সংবাদ প্রদান করছে:

এই অস্পষ্ট আইনের বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রদর্শনের জন্য ভারতের কর্নাটক রাজ্যের বিনামূল্যে সফট্ওয়্যার প্রাপ্তি আন্দোলন [ফ্রি সফট্ওয়্যার মুভমেন্ট কর্নাটকা বা এফএসএমকে] একটি প্রতিবাদের আয়োজন করে। ব্লগার, ছাত্র, শিক্ষক, আইটি পেশার সাথে যুক্ত কর্মী,আলোকচিত্রী শহরের কেন্দ্রে একত্রিত হয়, তারা উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিয়ে এবং ব্যানার হাতে নতুন নিয়মের প্রতি তাদের আপত্তি প্রদর্শন করে।

কর্নাটক-এ বিক্ষোভ।

কর্নাটক-এ বিক্ষোভ। ছবি জাস্ট এ্যানাদার কোইনসিডেন্স-এর আশফাকের সৌজন্যে। আরও ছবি দেখতে এই ছবিটির উপর ক্লিক করুন।

হর্ষিথা তার অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছে:

তরুণ, প্রাণবন্ত এবং উচ্ছল তারুণ্য, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং ব্লগারদের এক গণ জমায়েত তাদের মতামত প্রদান করে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন এই আমি, যুক্ত হবার শক্তি অনুভব করেছি, একটি গৌরবময়তার শ্বাস, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম। ইন্টারনেটকে রক্ষার জন জনতা প্রাণের উচ্ছ্বাসে গেয়ে উঠেছে, হাতে প্ল্যাকার্ড বহন করেছে এবং উচ্চকণ্ঠে স্লোগান দিয়েছে।

আমি সত্যিই আশা করি যে এই বিলটি পাস না করে ভারত সরকার গণতন্ত্রকে সচল রাখবে। আসুন সবাই, সমাজের উন্নয়নের এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা জন্যে লড়াই করি।

খাঁচায় বন্দী স্বাধীনতা নামক প্রচারণা। ছবি “সেফ ইয়োর ভয়েস” নামক প্রচারণার সৌজন্যে। এ ধরনের আরও ছবি দেখতে চাইলে ছবিটিতে ক্লিক করুন।

“খাঁচায় বন্দি স্বাধীনতা”, শিরোনামে আপনার সেফ ইয়োর ভয়েস নামক প্রচারণার আরেকটি প্রতিবাদ-যা গত ২২শে এপ্রিল দিল্লির যন্তর মন্তর-এ অনুষ্ঠিত হয়। এই বিষয়ে প্রতিবেদন ও ছবির জন্য কাফিলা ব্লগ দেখুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .