পাকিস্তান: প্রেমিক জুটির উপর নজরদারীর কারণে টিভি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে

পাকিস্তানের সংবাদ নেটওয়ার্ক সামা টিভি ১৭ জানুয়ারি, ২০১১ তারিখের সকালের অনুষ্ঠানে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে যার উপস্থাপিকা মায়া খানকে একদল মধ্যবয়স্ক নারীদের নিয়ে করাচির বিভিন্ন পার্ক চষে বেড়াতে দেখা যায়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অভিবাবকের অনুমতি ছাড়া পার্কে বেড়াতে আসা প্রেমিক জুটিদের পাকড়াও করা ।

এই অনুষ্ঠানে দলটিকে পার্কে জুটিদের ধাওয়া দিয়ে অনেককে পালাতে বাধ্য করে কোন একজনকে কোনঠাসা করে তাদের অনুমতি ছাড়াই ভিডিও রেকর্ড করতে দেখা যায়। তারা ক্যামেরা বন্ধ করতে বারবার অনুরোধ করলে, তাদের বন্ধ করার কথা বলা হয়। অথচ সচেতনভাবেই সামা টিম শব্দসহ চিত্রগ্রহন চালিয়ে যায়।

অনুষ্ঠানটির এই পর্ব চলাকালে জুটিদের পরস্পরের সাথে বিয়ে প্রমাণ করতে এবং বিয়ের সনদ উপস্থাপিকা মায়া খানকে দেখাতে বলা হয়।

Screenshot from Youtube Video. Click on image to watch.

ইউটিউব ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট। বড় করে দেখার জন্যে ছবিতে ক্লিক করুন।

পাকিস্তানের সামাজিক প্রচার মাধ্যম ব্যবহারকারীরা এই পর্ব প্রচারের পর তীব্র প্রতিবাদ করে। অনেকেই মেহরীন কাসানার মতো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, যেমন তিনি বলেছেন:

দেখুন, মেয়েরা সপ্তাহের প্রায় প্রতিটি দিনই প্রেমে পড়ে এবং ছেলেরাও তাই। কখনো তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়, কখনো তারা ভুল করে। একেই মানবিক বলা হয়। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আলোকিত করার জন্যে জনসমক্ষে তেড়ে ধরতে একদল মধ্যবয়স্কা দরকার নেই। বিশ্বাস করুন, যাই ঘটুক না কেন তা তাদের মায়েরাই সামলাবেন। তাদের সমালোচনা করার দায়িত্ব আপনাকে বা অন্য কাউকে কেউ নিতে বলেনি

এই পর্বটি প্রচারের পর থেকে হৈচৈ এখন চলছে পাকিস্তানের সারা টুইটার ও ফেসবুকে। বিনা শাহ ট্রিবিউনের জন্যে তার লেখায় মন্তব্য করেছেন:

সর্বোচ্চ রেটিং অর্জনের জন্যে চ্যানেলগুলো উত্তেজনাকর কিছু দেখাতে গিয়ে বারবার আমাদের মিডিয়ার নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ফলে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সম্মতি ছাড়া টেলিভিশনে দেখিয়ে হয়রানি করার কারণে এখন এসবের ভুক্তভোগীদের আইনী পদক্ষেপের সম্মুখীন। উপরন্তু, এই পর্বটির প্রচার দু‘জন নিরপরাধ মানুষের ওপর পারিবারিক মূল্যবোধের নামে নিজেদের নৈতিক বিচার চাপিয়ে দিয়ে আমাদের ভ- সমাজের নিকৃষ্ট ইন্দ্রিয়ের আবেদন যুগিয়েছে-এটা আজকের পাকিস্তানের সবচেয়ে দায়িত্বহীন সম্প্রচার সাংবাদিকতার আরেকটি অংশ মাত্র।

এই সন্ধিক্ষণে নাগরিক সমাজের কর্মীদের আধা-সংগঠিত একটি দল এই অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘লাল মসজিদের মতো চৌকিদারী “সুবাহ সাবেরে মায়াকে সাথ“ বন্ধ কর‘ শিরোনামে একটি অনলাইন পিটিশন আপলোড এবং চালু করে। আবার কয়েক ডজন লোক অনলাইন ফিডব্যাক ফরমে পিইএমআরএ (পাকিস্তানের ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ)-তে অভিযোগ করে।

২২ জানুয়ারি আইনজীবী ওসামা সিদ্দিক উপস্থাপিকার এরকম আক্রমণাত্মক, হীন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি সংক্ষিপ্ত চিঠি খসড়া প্রস্তুত করেন। একদল নাগরিক এই চিঠির সাথে আরেকটি ফলো-আপ চিঠি জাফর সিদ্দিকীর (সিএনবিসি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, যার সাথে সামা টিভি যুক্ত) কাছে পাঠান।

Bএই প্রতিবাদের সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত নাগরিক সমাজের কর্মী বীণা সারওয়ার তার পোস্ট ‘আর নয় পাহারাদার খালাম্মা‘-তে মন্তব্য করেছেন:

আমি সর্বপ্রথম ২১ জানুয়ারী ২০১২ একটি ফেসবুক গ্রুপে ২২ জানুয়ারীর এই অনুষ্ঠানের শেয়ার করা লিংকটি দেখতে পাই। আমি এবং আরো অনেকে ইউটিউব লিংকগুলো ফেসবুক এবং টুইটারে শেয়ার করা শুরু করি। এগুলো ছড়িয়ে গেলে ক্ষোভ বেড়ে ওঠে।

জনগণ নাক গলানো এবং খবরদারী প্রদর্শনের মাত্রা দেখে স্তম্ভিত হয়। ভারত থেকে টুইটারে জাফরানী পাহারাদার ব্রিগেড সম্পর্কে মন্তব্য আসে যারা জুটিদের মন্দিরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাৎক্ষণিক বিবাহে বাধ্য করে, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা যে মানসিকতার প্রতিবাদ করছি তা শুধু পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ নয়।

Graphic courtesy Teeth Maestro

গ্রাফিক সৌজন্যে টিথ মায়েস্ত্রো

২৩ জানুয়ারীর মধ্যে পূর্বে উল্লেখিত অনলাইন পিটিশনটি ৪,৮০০টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এবং এধরনের সম্প্রচার সাংবাদিকতার কী সমস্যা তার ওপর কয়েকটি আর্টিকেল লেখা হয়; এই সম্মিলিত চাপে মায়া খানের ফেসবুক পাতা এবং পরবর্তীতে এই অনুষ্ঠানের সমস্ত ইউটিউব লিংক সরিয়ে ফেলা হয়।

২৩ জানুয়ারীর অনুষ্ঠানে মায়া খান জনগণকে আঘাত দেয়া তার উদ্দেশ্য নয় একথা বারবার বলে তার এই পর্বের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আবার এদিকে নাগরিক সমাজের কর্মীরা প্রকাশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং আকাশ থেকে এই পর্বটি সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়। তদুপরি এই নেটওয়ার্কের বিশেষকরে এই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু হয়।

 

সামা টিভি মায়া খানকে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যে তাদের কাছে পাঠানো চিঠির জবাব দেয় যে তিনি ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করেছেন। যার প্রেক্ষিতে ২৮ জানুয়ারি জাফর সিদ্দিকী জানিয়ে দেন যে মায়া খান ও তার দলকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ৩০ জানুয়ারী থেকে তার অনুষ্ঠান আর সম্প্রচারিত হবে না।

সেকারণেই অনুষ্ঠান বন্ধের আজই প্রথম দিন। এটা পাকিস্তানের সম্প্রচার মাধ্যমের ইতিহাসের এবং সামাজিক প্রচার মাধ্যমের জন্য এক যুগান্তকারী মূহুর্ত কারণ এটি বুঝতে পেরেছে যে ইচ্ছে করলে এটি এর বিধিবদ্ধ সীমাকে বাড়িয়ে নিতে পারে, কিন্তু এমন কতগুলো সীমা আছে যা তাকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে। তা সে যেভাবেই হোক না কেন, পাকিস্তানে গোপনীয়তা ও প্রকাশ্য হয়রানি ছাড়া প্রতিক্রিয়া আদান-প্রদানের স্বাধীনতার মতো অধিকার এগিয়ে নেয়া এবং আদায়ে নাগরিক সমাজের জন্যে তা একটা ভাল দৃষ্টান্ত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .