ফ্রান্সঃ দমিনিক স্ত্রস-কানের পতন?

সোমবার, ১৫ মে, ২০১১-এ, ফ্রান্স এক রাজনৈতিক ভূমিকম্পের মধ্যে দিয়ে জেগে উঠে: তারা জানতে পারে যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড বা আইএমএফ)-এর প্রধান (এখন প্রাক্তন), যিনি ফ্রান্সের নাগরিক, সেই দমিনিক স্ত্রস কান এক যৌন নিপীড়নের ঘটনায় যুক্ত। নিউ ইয়র্কের এক হোটেলের চেম্বারমেইডের ( হোটেলের যে কর্মচারী বিছানাপত্র বা বেডরুম ঠিকঠাক করে) বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে তাকে সেখানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই ঘটনা উন্মোচনের তিনদিন পরেও, ফরাসী ব্লগাররা এই বিশ্ব রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির প্রভাব ফরাসী রাজনীতিতে কি ভাবে পড়তে যাচ্ছে তা ধরতে অসমর্থ হয়েছিল।

“ডন জুয়ান” থেকে এক “বিকৃত মানুষ”

Front page of the French daily newspaper "Liberation".

“লিবারেশন” নামক ফরাসী দৈনিকের প্রথম পাতার সংবাদ।

ফ্রান্সে এই রাজনৈতিক পতনের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড। দমিনিক স্ত্রস কান যিনি কিনা ডিএসকে নামে পরিচিত, তিনি হতে পারতেন একমাত্র ব্যক্তি, যে বর্তমান রাষ্ট্রপতি সারকোজিকে আগামী নির্বাচনে পরাজিত করতে পারত। এমনি সাম্প্রতিক কিছুদিন আগে চালানো এক জরিপে দেখা যাচ্ছে কান সারকোজির চেয়ে এগিয়ে।

লিওয়নিটিউড-এ ব্লগ করা রোমানি এই ঘটনায় হতবাক [ফারসী ভাষায়]:

Moi qui suis un strauss-kahnien des plus convaincus depuis des années, par beau temps et par orage, je suis effondré si les choses se confirment.

এত বছর ধরে স্ত্রস কানের একনিষ্ঠ এক সমর্থক হিসেবে এক সুন্দর এবং ঝোড়ো হাওয়ায়, আমি নির্বাক হয়ে যাব, যদি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিশ্চিত হয়।

যে ভাবে এই কেলেঙ্কারির বিষয়টি ফ্রান্সকে আঘাত করেছে, ডরহাম লের তাতে বিরক্ত [ফরাসী ভাষায়]:

L'affaire Bill Clinton, à coté de tout ce foutoir, c'est le chapitre guimauve d'un mauvais roman de la bibliothèque rose. Il faut sans doute remonter plus loin pour trouver trace d'une affaire aussi grave  […] au tout début des années 80 et à la candidature d'Edward Kennedy à l'investiture démocrate

বিল ক্লিনটনের কেলেঙ্কারি, এই ঘটনার তুলনায়, শিশুদের জন্য লেখা একটা সস্তা উপন্যাসের একটা আকর্ষনীয় অধ্যায়ের সমান। কেউ একজন সম্ভবত এ রকম এক ক্ষতিকর কেলেঙ্কারির জন্য অনেক পেছনে ফিরে যেতে পারে […] ১৯৮০ এর দশকে ডেমোক্র্যাটিক দলের মনোনয়ন সময় এডোয়ার্ড কেনেডির ক্ষেত্রে যে ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।

ডিএসকের কিছু সমর্থক, যারা এই ঘটনার কথা অস্বীকার করছে, তারা এখনো তাকে সমর্থন দিচ্ছে, “হ্যাঁ আমরা সবাই কান” ব্যানার [ ফরাসী ভাষায়] এবং টিশার্ট পরা ছবি নিয়ে তাদের ব্লগে নিজেদের তুলে ধরছে। এর মধ্য একজন ধারাভাষ্যকার টুইট করেছে:

হ্যাঁ, আমার কান, আমরা নির্বাচনের (কান নাম লেখাটিকে খানিকটা বদলিয়ে তারা উল্লেখ করছে) কথা ভুলে যেতে পারি না।

প্রচার মাধ্যমের সংবাদের উপর মনোযোগ প্রদান করা

এই কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশ হবার পরের প্রথম দিন, কার্টুন শিল্পী ডাডু তার এই স্কেচের মাধ্যমে স্ত্রাস কানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে সাধারণের মনোভাবকে তুলে ধরেন: এটা হয়ত সত্য নাও হতে পারে।

ডিএসকের গ্রেফতার হওয়ার বিষয়টি সম্বন্ধে এখানে লেখক , যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব কঠোর আইন এবং সুনাম নষ্ট করা অভিযান হিসেবে দেখছেন। সোমবারে এক জরিপে দেখা যায় যে ৫৭ শতাংশ ব্যক্তি মনে করেন যে ডিএসকে নির্দোষ। এজনেস-এ, লা মোনালেসেট, উদ্বেগের সাথে মন্তব্য করেছে [ফারসী ভাষায়]:

Après le too big to fail, voici le too powerfull [sic] to rape.

পরবর্তীতে, এক বিশালতা যার পতন ঘটানো অসম্ভব, এতটা ক্ষমতাশালী যাকে ধর্ষণ করা অসম্ভব।

এই কেলেঙ্কারির ঘটনার তৃতীয় দিনে, প্রচার মাধ্যমের পুরোপুরি এক উন্মাদনার মাঝে ( এই সময়টায় গুগল ফ্রান্সে সার্চ দিলে ১৯ মিলিয়ন ডিএসকে সম্বন্ধীয় বিষয় দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল ) বাস্তবতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে- যা কিনা সত্য হতে পারে।

ট্রিশটান বানোন নামের এক তরুণ লেখিকার ২০০৭ সালে প্রদান করা এক সাক্ষ্যে জানা যায়, ২০০১ সালে স্ত্রস কান তাকে যৌন নিপীড়ন করেছিল, এখন যে কিনা পৃথিবী বিখ্যাত, এবং সে ১৮ মে, ২০১১ তারিখে আরেকটি সাক্ষাৎকার প্রদান করে, সিটিজেন প্রচার মাধ্যম আগোরা ভক্স-এ, যেখানে সে বিষয়টি নিশ্চিত করে। তার এই সাক্ষাৎকার এখন ফ্রান্সের দৈনিকগুলোতে ছাপা হচ্ছে, যা ডিএসকের অভিযুক্ত অতীতকে তুলে ধরছে [ফরাসী ভাষায়]।

অন্যতম এক সেরা ফরাসী ব্লগ পারটাগেনাস মো আভি-তে এক লেখা এক পোস্ট করা হয়েছে-যার শিরোনাম “আমি তা জানি” (জে লা সাভিয়া) [ফারসী ভাষায়]। এই পোস্ট অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটিকে তুলে ধরছে:

সংবাদপত্রের ভদ্রমহিলা এবং মহোদয়গণ। যদি আপনার ডিএসকের এই ধরনের ঘটনা সম্বন্ধে আগে জেনে থাকেন… তাহলে কেন আপনারা তার জনপ্রিয়তাকে বাড়িয়ে তুলেছিলেন এবং তাকে একজন সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে বাজারজাত করেছিলেন?

এখন সেই সব ফরাসী সাংবাদিকদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে, যারা নারীদের প্রতি ডিএসকের এই মনোভাব সম্বন্ধে জানত এবং এতদিন চুপ করেছিল। তবে এই অভিযোগ থেকে একজন সাংবাদিক অন্তত নিরাপদ, তার নাম জ্যা ক্যাথ্রেমে। তিনি ফরাসী-ইউরোপিয় সম্পর্ক বিষয়ক সাংবাদিক এবং ব্লগার। ২০০৭ সালে তিনি তার ব্লগে লিখেছিল [ফরাসী ভাষায়]:

Le seul vrai problème de Strauss-Kahn est son rapport aux femmes. Trop pressant, il frôle souvent le harcèlement. Un travers connu des médias, mais dont personne ne parle (on est en France)

সেবাসেটিয়ান রোচাট এই ঘটনায় ডিএসকে-কে একজন অভিযুক্ত হিসেবে দেখছেন না, তিনি তার ওয়েবসাইট আরেত স ইমাজ-এ এই ধারণা দেন। সেখানে তিনি এক শক্তিশালী ফরাসী আইনের কথা উল্লেখ করেন। ফরাসী সাধারণ আইনের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে [ফরাসী ভাষায়] ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার সবার অধিকার থাকবে।

Comment rester élégant et ne pas être attaqué en justice, tout en évoquant des sujets graveleux qui relèvent de la vie privée ? C'est le dilemme des journalistes dès qu'il s'agit de parler de la vie sexuelle des politiques.

কি ভাবে আপনারা রুচিশীল থাকবেন এবং মামলা এড়িয়ে যাবেন, যেখানে কামনার মত বিষয়গুলো ফ্রান্সের আইনের দ্বারা সুরক্ষিত? এটাই সাংবাদিকদের দ্বিমুখী চরিত্র, যখন সংবাদের বিষয় কোন রাজনৈতিক নেতার যৌন জীবনের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

কারব্রাজ [ফরাসী ভাষায়] এক মন্তব্যে এই বিষয়ে তীব্র আঘাত করেছে:

আজকের বিষয়ের সাথে এই বিতর্কের কোন সম্পর্ক নেই। আজকে আমরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছি, সেটি হচ্ছে ধর্ষণ, আর এটা হচ্ছে একটা অপরাধ…

রু ৮৯ নামক তথ্যমূলক সাইটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পিয়েরি হাস্কি। তিনি এক খোলামেলা পোস্টে এক অনলাইন বিতর্ক শুরু করেন, তার এই পোস্টের শিরোনাম, “কেন সাংবাদিকরা স্ত্রস কানের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করে না” [ফরাসী ভাষায়], তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি নিজে একাধিক বার এই আইন ভঙ্গ করেছেন ।

Je savais que Roland Dumas, alors qu'il était ministre des Affaires étrangères, était l'amant de Nahed Ojjeh, la fille du ministre syrien de la défense Mustafa Tlass. Fallait-il l'écrire ? Je ne l'ai pas fait, en rangeant cette information dans le domaine de la vie privée, alors que, s'agissant du chef de la diplomatie, je ne pense pas que c'était anodin. J'ai sans doute eu tort.

আমি জানি যে এক সময়কার ফরাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোলান্ড দ্যুমার সাথে নাহেদ ওজ্জেহর প্রেম ছিল। নাহেদ ওজ্জে ছিলেন সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী মুস্তাফা তলাস এর কন্যা। এই ঘটনাটি কি প্রকাশ পেয়েছে? না তা প্রকাশ হয়নি, একজনের ব্যক্তিগত জীবনের বিষয় হিসেবে একে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-এর সাথে জড়িত ছিল এবং এটা কোন সামান্য বিষয় ছিল না। সম্ভবত আমি এ ক্ষেত্রে ভুল ছিলাম।

কার্লস্কোয়াল [ফরাসী ভাষায়] এই বিষয়টির সাথে একমত নন:

Et pourquoi se taire ? Pour pas perdre les interviews, parce que DSK pouvait accéder à la plus haute marche, par peur, par connivence, par lâcheté, par prudence.

কেন নীরব থাকা? সাক্ষাৎকার গ্রহণ না করা, কারণ এর ফলে ডিএসকে সর্বোচ্চ স্থানে উঠে যেতে পারে, এর কারণ এক ভীতি, দায়িত্ব, সতর্কতা।

হাতকড়া পড়া অবস্থায় নিউ ইয়র্কের এক পুলিশ স্টেশন থেকে ডিএসকের বের হয়ে আসা ছবি প্রদর্শনের বিষয় নিয়ে ফরাসী প্রচার মাধ্যমে এক ছোটখাট বিতর্ক দেখা দেয়। ফ্রান্সের আইনে সন্দেহজনক ব্যক্তির হাতকড়া পরা অবস্থায় তোলা ছবি, ততক্ষণ পর্যন্ত পত্রিকায় ছাপা নিষেধ, যতক্ষণ না উক্ত ব্যক্তি অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত না হয়।
লে মন্দ নামক সংবাদপত্রের ওয়েবসাইটের [ফরাসী ভাষায়] এই বিষয়ের করা আলোচনার উপর আসা ধারাবাহিক মন্তব্য প্রদর্শন করে যে, এই আইনের বেলায় ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে:

Henriette: Et dire que Sarkozy veut introduire le système américain. Cela donne des frissons dans le dos.

হেনরিয়েত্তে: এবং আপনারা কি মনে করেন যে সারকোজি আমেরিকার এই পদ্ধতি এখানে চালু করবে। এটা আপনার শিরদাঁড়ায় একটা ভয়ের স্রোত বইয়ে দেবে।

Irca: Les Français, qui ont guillotiné Louis XVI en public et en sont fiers, ont été choqués par la vue du roi des sondages menotté.

ইরকাঃ ফরাসী নাগরিক, যারা প্রকাশ্যে ষোড়শ লুইয়ের মাথা কেটে ফেলেছে এবং তার জন্য তারা গর্বিত, এবং তারা “জরীপে রাজা হতে যাওয়া” ব্যক্তির হাতে হাতকড়া পরা ছবি দেখে মানসিক এক ধাক্কা খাচ্ছে।
দমিনিক স্ত্রস কানের থাম্বনেইল ছবি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ফ্লিকার পাতা থেকে নেওয়া হয়েছে (সিসি বাই-এনসি-এনডি ২.০)। /div>

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .