ভুটান: ধুমপানকে অপরাধের সাথে যুক্ত করার ঘটনা ক্ষোভের সঞ্চার করেছে

যদি কোন আইনগত কাগজ না থাকে, তাহলে ভুটানে একজন ধূমপায়ীর হয়ত জেলে হয়ে যেতে পারে। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী জুয়াঙ্ক মাদ্রিগাল-এর। সিসি বাই-এনসি-এসএ

নববর্ষ এসে গেছে, তার সাথে এসেছে এক নতুন সমস্যা।

এই মাসের শুরুতেই ভুটান সরকার তার কুখ্যাত “ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন” কঠোরভাবে প্রয়োগ করা শুরু করেছে। এই আইন ১ জুন, ২০০৯ সাল চালু হয়। এই আইন অনুসারে আইন ভঙ্গকারী যে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে চতুর্থ মাত্রার অভিযোগ আনা যেতে পারে, যার ফলে তার ৫ থেকে ৯ বছরের জেল হতে পারে।

যদিও এই আইন, ধূমপায়ী এবং ব্যবসায়ীদের উপর তৈরি করা এক প্রতিবন্ধকতা, কিন্তু যে সমস্ত নাগরিকরা ধূমপান করে না, তারাও গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতার উপর যে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে সে সব নিয়ে এবং মদ আর মাদকের বদলে, তামাকের মত কম জটিল জিনিসের উপর গুরুত্ব প্রদান করার কারণে এই আইন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাসরিন টোবোগাইয়োর ব্লগ পোস্ট, যার শিরোনাম “সংসদ ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন পাশ করেছে”: সেখানে ট্রুথ নামের মন্তব্যকারী বলছে:

এটা আসলে একটা মরা ঘোড়াকে বেত্রাঘাত করার মত। একবার ভুল করার বিষয়টি ক্ষমা যোগ্য, সকলেই ভুল করে। কিন্তু ভুল থেকে কোন শিক্ষা না নেওয়া আসলে এক ধরনের বোকামি। কেবল লোকদের ধরে জেলে পোরা আর ধূমপান নিষিদ্ধ করা, কোন ভাবে এই সমস্যার সমাধানে কাজে আসবে না, যারা কুখ্যাত অপরাধী, জেল তাদের জন্য হওয়া উচিত। যদি সিগারেট কোম্পানীর উপর কর ধার্য করা হয়, তাহলে সরকার সেখান থেকে রাজস্ব আয় পেতে পারে। সেই টাকা লোকজনকে তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা প্রদান করার কাজে ব্যয় করা যেতে পারে। যদি ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে তা কালোবাজারে চলে যাবে এবং এর ফলে কেবল কালোবাজারিরা ছাড়া আর কেউ লাভবান হবে না। আমি বুঝতে পারি যে ডিপিটি দলের নীতি অনুসারে ভোট দিয়েছে, কিন্তু জাতীয় পরিষদের সদস্যদের বুদ্ধি কোথায় গেল। এটা মোটের উপর হতাশ করা এক ব্যাপার। আমি আশা করব যে সংসদের উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের সংসদ সদস্যদের বুদ্ধি গজাবে। যখন কোন কিছু কাজ করে না, তার মানে ভিন্ন ভাবে তার জন্য চেষ্টা করা দরকার.. আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন,: বার বার একই ভাবে কাজ করা এবং ভিন্ন কিছু আশা করা”-এটা এক ধরনের উন্মাদনা। আমাদের আইনপ্রণেতার অনেকটা এরকম।

গতকাল বিজনেসভুটান টুইট করেছে যে, “আজ কর্তৃপক্ষ ড্রায়াঞ্জ এন্ড ডিসকোথেকস নামক প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করতে পারে, তারা এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায় যে, নতুন ধূমপান নিয়ন্ত্রণ আইন ঠিকমত পালন করা হচ্ছে। এসব ঘটনা নতুন কিছুই না। ২০০৫ সালে, ভুটানের সাংসদরা সকল ধরনের তামাকজাত পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধ করেছিল। এর ফলে ভুটান বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রে পরিণত হয়, যারা অন্যদের সবার আগে ধূমপান নিষিদ্ধ করে। এতে দৃশ্যত আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম ভুটানি কর্মকর্তাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় এবং তাদের প্রতি প্রীত হয়। এমনকি সে সময় কর্মকর্তারা বৈধভাবে কেনা তামাকের মজুদ পুড়িয়ে দেয়, যার মূল্য ছিল কয়েক মিলিয়ন নগুলট্রম (ভুটানি মুদ্রা)।

কুয়েনসেল সংবাদ প্রদান করছেন যে নতুন আইন অনুসারে ১৮ বছর ঊর্ধ্ব যে কোন ভুটানি নাগরিক এক মাসে দেশে ২০০ টি সিগারেট বা ৩০ টি সিগার বা ১৫০ গ্রাম তামাক জাত পণ্য আমদানী করতে পারবে।

যদি এই সমস্ত পণ্য ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকে আমদানী করা হয়, তাহলে তার জন্য ২০০ শতাংশ বিক্রয় কর প্রদান করতে হবে। আর যদি তা ভারত থেকে আমদানী করা হয় , তাহলে তার জন্য ১০০ শতাংশ বিক্রয় কর প্রদান করতে হবে।

যখন শুল্ক দপ্তরে এই সব পণ্য আমদানির কথা ঘোষণা করা হবে, তখন এই ব্যক্তিকে আমদানী পণ্য এবং তার পরিচয় সহ এক রশিদ প্রদান করা হবে। যে তারিখে এই রশিদ প্রদান করা হবে, তারপর ঠিক একমাস পর্যন্ত এই রশিদ কার্যকর থাকবে এবং যখন সে ধূমপান করবে তখন কাছে উক্ত রশিদ থাকতে হবে। যদি তাকে ধূমপানের আইনগত অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে উক্ত রশিদ দেখাতে হবে।

এই বিষয়টি আপনাকে এক বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, কি ভাবে এই বিষয়টির প্রয়োগ হতে পারে। ধূমপান এবং সিগারেটের উপর ২০০৫ সালে যে নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছিল তা একেবারে অকার্যকর হয়। কারণ তা ছিল দুর্বল ভাবনা প্রসূত-এবং অবাস্তব। পরে শেষে যা গর্বের বদলে এক অস্বস্তিকর বিষয়ে পরিণত হয়, কারণ এরপরেও দাপটের সাথে লোকজনকে ধূমপান করতে দেখা যায়।

এবং এই আইনটি কতটা জনপ্রিয়? যেখানে এর ফলে স্বাস্থ্যগত সুবিধা লাভ করা যাবে, সেখানে অনলাইনে লোকজন এই এরকম আইনের অর্থহীন বাস্তবতার দিকে নির্দেশ করছে।

ভুটানটাইমস.কম-একটি অনলাইন ফোরাম, সেখানে “সিগারেট এবং রশিদ” নামক এক ধারাবাহিক আলোচনায় বেশীর ভাগ ভুটানি নাগরিক, ছদ্মনামে এই বিষয়ে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে:

কাকোরিকো বলছে:

এটা আমাকে পরিচালক উডি অ্যালেনের একটি পুরোনো ছবি “বানানাস”-এর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এই ছবিতে এক স্বাধীনতা মুক্তিযোদ্ধা, ক্ষমতা পাবার সাথে সাথে স্বৈরশাসকে পরিণত হয় এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু করে। সে ঘোষণা দেয়, দেশের সকল নাগরিককে নিয়মিত জাঙ্গিয়া বদলাতে। কিন্তু তাকে প্রশ্ন করা হয় কি ভাবে সরকার পরীক্ষা করে দেখবে যে, নতুন আইন ঠিকমত মানা হচ্ছে। তখন সে বলে, অবশ্যই সকলকে প্যান্টের উপর জাঙ্গিয়া পড়তে হবে।

রকসা সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার মত সাহস দেখাচ্ছে:

কি ভাবে সরকার ১০১টি জটিলতা ছাড়া এই আইনের প্রয়োগ করতে পারে, সে বিষয়ে আমি সরকারকে চ্যালেঞ্জ করছি।

এদিকে নাম্বার_উনো বলছে:

আমরা এমন এক জাতি যাদের সাথে শ্রেণীকক্ষের ছাত্রের মত আচরণ করা হচ্ছে।

কিন্তু ড্রুপকিনলে আরো ভয়াবহ এক দিকের কথা ভাবছেন:

আমি মনে করি ধূমপানের জন্য রশিদ নাম্বার সহ পরিচয়পত্র প্রদান করা মাদক অধিদপ্তরের জন্য সহজ বিষয় হবে। বিষয়টি ভালো। তা না হলে, ধূমপায়ী এবং ইন্সপেক্টরের মধ্যে এক ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, যেখানে শেষ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি জেলে যেতে পারে, তবে ধূমপান করার কারণে নয়, খুন করার কারণে।

মিগয়েল এই আইনের কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন:

বর্তমানে ভুটানে মদ্যপান করার পর বেপরোয়াভাবে গাড়ী চালানোর ফল যত লোক মারা যায়, তার পরিমাণ অন্য যে কোন ঘটনার চেয়ে বেশী। সরকার কি তামাকের বদলে মদ্যপানের উপর মনোযোগ প্রদান করতে পারে না?

ব্লাঙ্কস্লেট বলছে, ইচ্ছা থাকিলেই উপায় হয়:

এক কালোবাজের সৃষ্টি এবং সেখানে গুণ্ডাদের বিনিয়োগ করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে- সরকার চমৎকার ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে!

যদিও নিষিদ্ধ পণ্যের কারণে সব সময় কালোবাজার নামক প্রতিষ্ঠানটি টিকে থাকে, তারপরেও তামাকজাত পণ্যের জন্য এ রকম এক বিপজ্জনক কালোবাজার সৃষ্টির প্রয়োজন কি?

হ্যাঁ, কেবল সিগারেটের জন্য কালোবাজার নয়, তার সাথে রাজস্ব আয় এবং কাস্টমস এর রশিদ বইয়ের জন্য কালোবাজার! আসল রশিদ বই যেই ছাপাখানা থেকে ছাপ হবে, যদি সেই একই ছাপাখানা থেকে একই মানসম্পন্ন করে ভূয়া রশিদ বই ছাপা হয়, তাহলে রাস্তায় টহল দান করা পুলিশের পক্ষে দুটির মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি সকল অবৈধ সিগারেটকে বৈধ করে দেবে, যা নিশ্চিতভাবে দেশে প্রবেশ করবে, যা তাকে আরো প্রিয় করে তুলবে। হাওয়ালা পদ্ধতিতে টাকা হস্তান্তর, তার কাজের ধরনের কারণেই কাগজ ছাড়া হয়ে থাকে, এটি পরিচয় পদ্ধতি ছাড়া টাকা প্রদানের এক ব্যবস্থা.. এক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতে পারে। এটি মাঝখানে থাকা পরিচয়হীন এক ব্যক্তির সহায়তায় করা হতে পারে, যারা একটা ভূয়া রশিদের মাধ্যমে টাকা প্রদান করবে এবং এক মুর্হূতেই সিগারেট নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। কে জানে আমাদের শুল্ক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে হয়ত আসল কাগজ দিয়েই তারা এই কাজ করবে।

উপরের কথাগুলো ইকোনমিস্ট নামের একজন লিখেছে।

সবশেষে চোহোইক সাধারণ কয়েকটি পরামর্শ প্রদান করছে যা হয়ত কাজে লাগতে পারে।

সত্যিকার অর্থে সরকারে যা করা উচিত:
১ জনসম্মুখে ধূমপান নিষিদ্ধ করা এবং এই আইনকে বলবৎ করা।
২ সিগারেট বিক্রির নিষিদ্ধ করার বদলে আমদানী/বিক্রির উপর উচ্চহারে কর আরোপ করা। এই ঘটনাটি তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। আর আমি নিশ্চিত যে এর ফলে সিগারেটের চাহিদা কমে আসবে। একই সাথে এর মধ্যমে সরকার বাড়তি কিছু টাকা আয় করতে সক্ষম হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .