রাশিয়া: গম রপ্তানীর উপরে নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে

এই পোস্ট পুলিতজার সেন্টার/গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইনের খাদ্য নিরাপত্তা সিরিজের অংশ। এই রিপোর্টগুলো বিশ্বব্যাপী ব্লগারদের এই বিষয়ে মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টিং তুলে ধরে যা পুলিতজার গেটওয়ে টু ফুড ইনসিকিউরিটিতে দেখানো হয় । এখানে খাদ্য সংকট নিয়ে আপনার কাহিনী জানাতে পারেন।

রাশিয়াতে গমসহ বিভিন্ন শস্য রপ্তানিতে নতুন একটি নিষেধাজ্ঞা ভীতির সৃষ্টি করেছে যে এই পদক্ষেপ কি করে গমের মূল্য আর খাদ্য নিরাপত্তার উপরে প্রভাব ফেলবে। রাশিয়া বিশ্বের প্রথম পাঁচ গম রপ্তানিকারকদের মধ্যে পড়ে, কিন্তু এই গ্রীষ্মে দেশব্যাপী গমের ফসল নষ্ট হয় যখন প্রচন্ড তাপপ্রবাহ, প্রচন্ড খরা আর দাবানল দেশটিকে আঘাত করে।

স্বর্ণালী গম

স্বর্ণালী গম। ফ্লিকার থেকে দুদুয়ার সৌজন্যে (সিসি-বাই-এনসি-এসএ)

বিশ্ব ব্যাংকের একটি ব্লগ প্রসপেক্টস ফর ডেভেলপমেন্টে ব্লগ করতে গিয়ে হ্যান্স টিমার বলেছেন যে রাশিয়ার গম উৎপাদন গত বছরের থেকে এক চতুর্থাংশও কমে যেতে পারে। এর ফলে, রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন গত মাসে ঘোষণা করেন যে দেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে শস্য রপ্তানীতে, যার মধ্যে গম, বার্লি, রাই আর ভুট্টা আছে। এই আদেশ গত ১৫ই আগস্ট থেকে কার্যকরী হয়েছে, আর একই সাথে কৃষকদের আর্থিক সাহায্য দেয়াও বন্ধ হবে।

গত সপ্তাহে পুতিন বলেছেন যে এই নিষেধাজ্ঞা ২০১১ সাল পর্যন্ত গড়াতে পারে, যাতে পরের বছরের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত তৈরি হয় আর দেশে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইতোমধ্যে আর্ন্তজাতিক বাজারে গমের দাম গত জুন থেকে ৫০% পর্যন্ত বেড়ে গেছে

কিয়েভ পোস্টে একটি লেখায় লরেন গুডরিচ বলেছেন যে এই নিষেধাজ্ঞা দুর করে দিতে পারে রাশিয়ার সামাজিক আর রাজনৈতিক অস্থিরতা, যেমনটি ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতির কারণে হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে মোজাম্বিকে রুটির দাম বৃদ্ধি নিয়ে রায়টে ১৩ জন নিহত আর শত শত আহত হয়, ওদিকে মিশর আর সার্বিয়ার মতো দেশে ক্ষোভ বাড়ছে ক্রমাগত। গমের উপরে নিষেধাজ্ঞা অন্যান্য স্থানেও ভীতির সৃষ্টি করেছে, বিশ্ব খাদ্য সংকটের ভীতি সৃষ্টি হচ্ছে আর এর ফলে গমের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে।

ফাইনানশিয়াল নিউজ ওয়েবসাইট সামফোলিও এর জন্য লিখতে গিয়ে সিমোন মঙ্গার মুল্যের উপরে নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য প্রভাব ব্যাখ্যা করেছেন:

“পণ্যটির রপ্তানীর ব্যাপারে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ..ধারণা করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী এর মূল্যের উপরে বড় ধরণের প্রভাব ফেলবে। যখন প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন এই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন, তখনই গত দুই বছরের মধ্যে মূল্য সব থেকে বেড়ে যায় আর অন্যান্য দেশ এই ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে তাদের নিজেদের রপ্তানির উপরে মাত্রা নির্ধারন করেন।

আমেরিকায় গমের দাম খুব কম কমলেও, কৃষকরা ব্যবস্থা নিচ্ছেন তাদের উৎপাদন বাড়াবার, এবং বাজারে অনেক অনিশ্চয়তা আছে। কারন গম উৎপাদন বেড়ে গেলে এই পণ্যের অতিরিক্ত সরবরাহ থাকবে আর অন্যান্য শস্য কম আসবে বাজারে।“

এই পরিস্থিতি, যার সাথে গমের উৎপাদন কমা বিশেষ করে কানাডার মতো দেশে, বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তায় ভীতি আরও বৃদ্ধি করেছে। পুতিনের ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যে, ডউ জোন্স নিউজওয়ার্স কে জাতিসংঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রাম (ডাব্লুএফপি) বলেছে যে এই নিষেধাজ্ঞা উন্নয়নশীল দেশে তাদের দেয়া খাদ্য সাহায্যকে সীমিত করবে, যার ফলে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অনাহারে থাকবে। ডাব্লুএফপি ২০০৯ সালে ৭৩টা দেশে ১০০ মিলিয়নের বেশী লোকের জন্য খাদ্য সাহায্য দিয়েছে। ২.৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্যের এক তৃতীয়াংশ তারা যা সেই বছর কিনেছিল তা ছিল গম, যার ৯৫% গম ব্ল্যাক সি এর আশেপাশের এলাকা থেকে নেয়া হয়।

রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ব্লগার আনাটোলি কার্লিন ক্যালির্ফোনিয়াতে থাকেন আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। তিনি তার ব্লগ সাবলাইম অবলিভিয়নে একত্র করেছেন রাশিয়ার খরা আর দাবানল নিয়ে মিডিয়ার খবর। তিনি চিন্তা প্রকাশ করেছেন এই পরিস্থিতি বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর উপরে কি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে সেটা নিয়ে।

“[কৃষির] মন্দা [রাশিয়াতে] আর দুই বছর চলতে পারে, যদি মাটি খুব শক্ত হয়ে যায় শীতের ফসল লাগানোর জন্য…আর এর সাথে অন্যান্য দেশের কৃষি কমতির কারনে (উদাহরণস্বরূপ, চীনের বন্যা এর চালের উৎপাদন এই বছরে ৫-৭% কমিয়ে ফেলেছে)। আর বাড়তে থাকা খাদ্য মজুদ, মিশর আর পাকিস্তানের মতো গরিব খাদ্য আমদানিকারকদের জন্যে সামাজিক দানের পরিমাণ বাড়বে। ২০০৮ সালের খাদ্য সংকটের পুনরায় হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখন নেই কিন্তু একটি জিনিষ নিশ্চিত যে আমাদের যুগ বাড়তে থাকা ঘাটতির যুগ।“

রাশিয়াতেও ভীতি বেড়েছে, কেবল গম নিয়েই না বাকহুইট নিয়েও। এটি যদিও কার্যত গম নয়, বাকহুইটকে রাশিয়াতে প্রধান খাদ্য শস্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। খরা দেশের বাকহুইট উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, আর মূল্য বৃদ্ধির ফলে রাশিয়ার ব্লগ জগৎে এ নিয়ে সাড়া পড়েছে। দুই সপ্তাহ আগে দ্যা গার্ডিয়ানের প্রকাশিত এক লেখায় অ্যালেক্সেই কোভালেভ জানিয়েছেন যে এক-কিলো বাকহুইটের প্যাকেট যার আগের মুল্য ২০ রাশিয়ান রুবল (ইউএস ডলার ০.৬৫) ছিল এখন তা পাওয়া গেলেও ৪০ বা ৭০ রুবল দাম হয়

মস্কোবাসী আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওলেগ ভোলোদিন তার ব্লগে বলেছেন যে খাদ্য সরবরাহকারীরা এই ভীতিতে অবদান রাখছেন:

Понятно, что с урожаем-2010, мягко скажем, проблемы – но “продовольственная паника” их только усугубляет. Давая поставщикам и торговым сетям прекрасный повод задирать цены – вызывая новую волну истерики “видите, дорожает!”. Кстати, если статистика не врет – продажи круп, макаронов и муки за последнюю неделю (!) выросли впятеро.

হালকাভাবে বলতে গেলে এটা পরিষ্কার যে ২০১০ সালের চাষে কিছু সমস্যা আছে। কিন্তু ‘খাদ্য ভীতি’ এটাকে আরো খারাপ করছে। এটা সরবরাহকারী আর বিক্রেতাদের সুযোগ দিচ্ছে মূল্য বৃদ্ধির, যার ফলে ভীতির নতুন একটা ঢেউ উঠছে: ‘দেখো মুল্য আরো বেড়ে যাচ্ছে!’ তবে, পরিসংখ্যান যদি ভুল না বলে, সিরিয়াল, পাস্তা আর আটার বিক্রি পাঁচগুণ বেড়ে গেছে (!) গত সপ্তাহের মধ্যে।

ভীতি সৃষ্টি করা ছাড়াও, মূল্য বৃদ্ধি আর খাদ্য নিরাপত্তার উপরে বড় ধরনের প্রভাব ফেলা, কিছু অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে রাশিয়ার শস্যের উপরে নিষেধাজ্ঞা অন্য দিক থেকে খারাপ প্রভাব ফেলবে। ইকোনমিপলিসি জার্নাল.কমে সিমোন ব্লাক এই প্রভাবের কথা ব্যাখ্যা করেছেন:

এই মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি রোধের প্রচেষ্টায়, সরকার রপ্তানির উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলে কার্যকরভাবে রাশিয়ার কৃষকদের তাদের পণ্যের জন্য সব থেকে উচ্চ মুনাফা পাওয়া থেকে আটকানো হয়েছে। এই ধরনের জিনিষ বার বার চেষ্টা করা হয়েছে, সব থেকে বেশী আর্জেন্টিনার সাম্প্রতিক গরুর মাংস রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ্য। এটা সব সময়ে খারাপভাবে শেষ হয়- উৎপাদনকারীরা এর ফলে কপর্দ শুন্য হন, মানুষ চাকুরি হারায়, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য উৎপাদন আসলে কমে যায়… কিন্তু রাজনীতিবিদরা কখনো শেখেন না। খুব কম হলেও, ব্যবসা করার স্থান হিসাবে রাশিয়ার সুনামের বেশ ক্ষতি হবে।

ভীতি সত্ত্বেও, বিশ্বের গমের মজুদ ২০০৭-২০০৮ সালের লেভেলের উপরে আছে আর জাতিসংঘের খাদ্যা আর কৃষি সংস্থা জানিয়েছে যে বর্তমানে চিন্তার কোন কারন নেই নতুন বিশ্ব খাদ্য সংকটের। এর আলোকে কাজাখস্তানের সরকারি নীতি পরামর্শক আজামাতাব্দিমোমুনোভ তার নলেজম্যাপ ব্লগে লিখেছেন যে কি নিয়ে এতো কথা হচ্ছে। রাশিয়া বিশেষজ্ঞ আর হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা ফেলো পল আর গ্রেগোরি তার ব্লগে বলেছেন যে এখন যখন বাজার শক্তি রাশিয়ার কৃষিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, রাষ্ট্রের বদলে, চিন্তার কারণ আরো কম:

“রাশিয়ার মানুষের উপরে বাজার কৃষিতে ফিরে যাওয়ার প্রভাব চিন্তা করেন। ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে বিশাল সোভিয়েট আকালের সময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদনে বিশ শতাংশ ঘাটটি দেখেছিল- এই বছরের কমে যাওয়ার ভবিষ্যৎবাণীর একই ধরনের পরিসংখ্যান। সাথে সাথে এর ফলে ছয় মিলিয়নের বেশী লোক মারা যান তখন… তবে ২০১০ সালে রাশিয়ার মানুষ সব থেকে খারাপ বিষয় যার মুখোমুখি হচ্ছে তা হলো খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়া। রাশিয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক গোত্রের অংশ। খুব খারাপ পরিস্থিতিতে, এটা এই বছর শস্য আমদানী করতে পারে আর পরের বছর আবহাওয়া ভালো হয়ে স্বাভাবিক হলে আবার রপ্তানী করতে পারে।”

জাতিসংঘ খাদ্যা আর কৃষি সংস্থা গত সপ্তাহে ঘোষণা করেন যে সদস্য দেশ সমূহের বিশেষ একটি সভা তারা ইটালির রোমে সেপ্টেম্বর ২৪ তারিখে করবেন, গমের বাড়তে থাকা মূল্য নিয়ে আলোচনা করতে আর খাদ্য যোগান ব্যবস্থা ভালোভাবে পর্যালোচনার জন্য।

অ্যালেক্সেই সিদোরেঙ্কোকে ধন্যবাদ রাশিয়ার ব্লগ পোস্ট খুঁজতে আর এর ভাষান্তরে সাহায্য করতে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .