আরব বিশ্ব: মহান আয়াতুল্লাহ মোহাম্মেদ হুসেইন ফাদাল্লাহকে স্মরণ করা

সাইয়্যেদ মোহাম্মেদ হুসাইন ফাদাল্লাহ

মোহাম্মেদ হুসেইন ফাদাল্লাহ অন্যতম এক শিয়া নেতা। গতকাল (৪ জুলাই) তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি ছিলেন এক ধর্মীয় নেতা এবং তার প্রচুর অনুসারী রয়েছে। এই অঞ্চলের ব্লগাররা তাকে স্মরণ করছে। তার মৃত্যুতে লেবানন তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে।

অ্যাঙ্গরি আরব নিউজ সার্ভিসের লেবাননী নাগরিক ড: আসাদ আবু খালিল, ফাদাল্লাহ সম্বন্ধে সরাসরি পাওয়া তথ্য জানাচ্ছেন:

আমি এখনো দোহায় এবং এই পরিস্থিতিতে মোহাম্মেদ হুসেইন ফাদাল্লাহ সম্বন্ধে লেখার সময় নেই। কিন্তু তার সম্বন্ধে বেশির ভাগ লেখা (কেবল মাত্র ইংরেজীতে লেখা নয়) কেবল তার পেছনের ইতিহাস এবং এই সমস্ত লেখা তার চিন্তার কথা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। তার শৈশব শুরু হয় নাজাফে, তার বাবা আব্দুর-র’উফ ফাদাল্লাহ ছিলেন সেখানকার একজন শিক্ষক ছিলেন। তার শৈশবের সময় তিনি ভীষণ বিরক্ত ছিলেন। যেমনটা তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, সেখানকার কমিউনিস্টদের শক্তিতে তিনি বিরক্ত ছিলেন। শৈশবে কমিউনিস্টদের সাথে তার দ্বন্দ্ব তার পড়াশুনা শুরুর ক্ষেত্রে এবং যুক্তির আচরণ তৈরির ক্ষেত্রে প্রভাব তৈরি করে। সেটা ছিল এমন এক সময় যখন ইরাকী কমিউনিস্ট পার্টি, ইরাক এবং তার বাইরে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ছিল।

যদিও প্রচার মাধ্যম তাকে হিজবুল্লাহদের উপদেষ্টা বলে মনে করত, এক্ষেত্রে ড: আবুখালিল জানাচ্ছেন:

হিজবুল্লাহর সাথে তার সম্পর্ককে সব সময় ভুল বোঝা হয়েছে এবং এই সম্পর্কে এমন কিছু ছিল যা কেবল পশ্চিমের লোকেরাই নয়, অনেক আরবও জানতে পারেনি। ৯০-এর দশকে হিজবুল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক হয়ে পড়ে: দামেস্কে ফাদাল্লাহ সপ্তাহে একবার একটি ধর্মীয় ভাষণ প্রদান করতেন এবং সেখানে তিনি এক নতুন ধর্মীয়-রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশ ঘটান এবং উলিয়াত আল-ফাকিহর সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন। তিনি ৮০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রদান করা এক ভাষণের ফিতা (টেপ) আমাকে প্রদান করেন, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন কি ভাবে তিনি শুরার ধারণা থেকে সরে গিয়ে উলিয়াত আল-ফাকিহর ধারণায় প্রবেশ করেন। ফাদাল্লাহ দামেস্কে সাপ্তাহিক যে ভাষণ প্রদান করতেন সেখানে তিনি এক নতুন ধারার তত্ত্বের উন্নয়ন ঘটান, পরে তিনি উলিয়াত আল-ফাকিহর ধারণা থেকে সরে আসেন এবং নতুন এক উদারনৈতিক চিন্তার উন্নয়ন ঘটান বিশেষ করে ব্যাক্তিগত নীত বা আইনের উপরে। তিনি মেয়েদের হস্ত মৈথুন নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন এবং নিময় জারি করেন যে যদি একটি মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে সে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। তিনি বিজ্ঞান এবং ধর্মের মধ্যে আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির উপর জোর দেন। তার ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং উলিয়াত আল-ফাকিহ-এর প্রাথমিক কিছু বিষয়ের কারণে হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সাথে সম্পর্ককে জটিল করে তোলে এবং ইরানের একজন ধর্মীয় নেতা ফাদাল্লাহর দেওয়া ফতোয়ার প্রতি উত্তর প্রদানে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। হিজবুল্লাহ আবেদন জানিয়েছিল যে এই দ্বন্দ্বের বিষয় যেন প্রকাশ্যে উঠে না আসে এবং বিষয়টি যেন ধর্মীয় নেতাদের আলোচনার মধ্যে সীমিত থাকে।(প্রাথমিক ভাবে এই দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে আমি হাসান নসরুল্লাহ কাছ থেকে জানতে পারি। হাসান নসরুল্লাহ এক সময় ধৈর্য্যের সাথে ফাদাল্লাহ সাথে সে সময়ে চলা দ্বন্দ্বের বিষয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল)। কিন্তু ২০০৬ সালে সকল কিছু বদলে যায়: যখন গতানুগতিক উপেক্ষিত ইজরায়েলি প্রাচ্য বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ফাদাল্লাহ, হিজবুল্লাহর “আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বা নেতা” তখন পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম এবং কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি উৎসাহ প্রদান করল যে হ্যাঁ তিনি তাই-এবং ইজরায়েলি যুদ্ধাপরাধীরা তার বাসা এবং তার গড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে বোমা হামলা চালায়। এই বিষয়টি তাকে হিজবুল্লাহর বিশ্বস্ত সহযোগীতে পরিণত করে এবং তিনি শেষ দিন পর্যন্ত এই সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। মোহাম্মেদ হোসাইন ফাদাল্লাহর ধর্মীয় রাজনৈতিক চিন্তার রূপান্তর-এই বিষয়টি কোন পিএইচডি বা উচ্চতর গবেষণার বিষয় বস্তু হতে পারে। এক সময় তার প্রভাব লেবাননের সীমানা ছাড়িয়ে যায় এবং তার প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রদান করা চাঁদার অনেকটাই লেবাননের বাইরে থেকে সংগৃহীত হয়েছে। লেবাননে “ধর্মীয়-রাজনৈতিক উত্তরাধিকার” বিষয় জনতা কোন ধারণা করার আগে, তাদের জানা উচিত যে মারজি’ইয়াহ (সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ) উত্তরাধিকারীতে রুপান্তরিত হতে পারে না।

উপসংহারে, অ্যাঙ্গরি আরব যোগ করেছেন:

তার মৃত্যুতে কেবল হিজবুল্লাহ এবং সিসতানির মত লোক লাভবান হবে। এরা ক্রমাগত ছাড়িয়ে যাবে, যারা খামেনির সাথে একমত নয়। এই সমস্ত লোকেরা লেবাননে নিজেদের ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম করছে।

ইয়া লিবনান-এ পাঠকরা ফাদাল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেএলিয়াস লিখেছে:

তিনি একজন মহান আধ্যাত্মিক নেতা এবং পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি লেবাননের জন্য সবচেয়ে সেরা এবং একতাবদ্ধ এক লেবানন চাইতেন, কিন্তু একই সাথে তিনি চাইতেন তারা যেন অন্য অমুসলিমদের সাথে মিশে এবং অনেক বেশি খোলামেলা হয় এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়। লেবানন অনেক কিছু হারিয়েছে এবং আমি আশা করি অনেক তার দেখান পথ অনুসরণ করবে। ফাদাল্লাহ আপনি শান্তিতে ঘুমান এবং আপনার পরিবার এবং লেবাননের উপর শান্তি নেবে আসুক।

ইউসুফ এর সাথে যোগ করেছেন:

আমাদের অনেক দুর্লভ একজনকে হারালাম, এমন এক আধ্যাত্মিক নেতা, যিনি একসাথে বসবাস এবং একতাবদ্ধ থাকার বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন এবং সেই বিষয়ে প্রচারণা চালাতেন। তার আত্মা শান্তিতে ঘুমাক এবং আল্লাহ তার পরিবার এবং প্রিয়জনকে এই কঠিন সময়ে শান্তি এবং ধৈর্য্য প্রদান করুক। আল্লাহ মানবতার উপর রহমত নাজিল করুক… শান্তি প্রদান করুক।

মিশর থেকে জেইনোবিয়া লিখেছে:

সেই ৮০–দশক থেকে ফাদাল্লাহ কেবল হিজবুল্লাহর আধ্যাত্মিক নেতা হিসেব নয় একই সাথে তার বিতর্কিত ধর্মীয় মন্তব্য এবং ফতোয়ার কারণে পরিচিত ছিল। এটা কেবল লেবানন নয় যারা তাদের এক আদর্শ ব্যক্তিকে হারিয়েছে, পুরো শিয়া সমাজ তাদের এক স্পষ্টভাষী এবং মধ্যপন্থী নেতাকে হারালো। আপনারা আলশিত্তের উপর তৈরি করা আলজাজিরার তথ্যচিত্রটি দেখতে পারেন যেখানে তিন তার ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর কথা বলছেন।

এখনো মিশরের ব্লগে, সেখানকার আবু আল মায়া’লি ফায়েক জানাচ্ছে (আরবী ভাষায়):

لقد كان هذا الرجل يذكرنى بالشيخ محمد الغزالى رحمه الله فقد كان الغزالى يكره سفاسف الأمور،كما كان يكرهها أيضا الشيخ العلامة محمد حسين فضلله،رحل هذا الرجل والأمة تتلاطمها أمواج الخلافات المفتعلة بفعل بعض الأغبياء الذين تركوا العدو الحقيقى المتمثل فى ما يسمى بدولة إسرائيل وراحوا يفتشون عن عدو من الماضى وضعه المستعمر وما زال يلعب عليه حتى اللحظة،ما أحوج الأمة إلى أمثال السيد حسين فضلله كما كان أحوجها أيضا إلى الشيخ الغزالى
এই ব্যক্তিটি আমাকে শেখ মোহাম্মদ আল ঘাজালির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল, আল্লাহ তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুক। আলা ঘাজ্জালি অগভীর বিষয়কে ঘৃণা করতে। সাইয়্যেদ ফাদাল্লাহ তা ঘৃণা করতেন। এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে যখন মুসলমান জাতির উপর আঘাত আসছে কয়েকেজন নির্বোধ মানুষের কারণে যারা সত্যিকারের শত্রুদের ছেড়ে দিচ্ছে, যাকে ইজরায়েল নামে চেনা যায় এবং তার বদলে অতীত থেকে শত্রু খোঁজা শুরু হয়েছে, যে শত্রুকে তৈরি করেছে উপনিবেশের লোকেরা, যারা ক্রমাগত বিভক্ত কর এবং শাসন কর নীতিতে নিয়ে আজও খেলা করছে। আজকের দিনে ইসলামিক জগতে সাইয়্যেদ ফাদাল্লাহর মত মানুষের দরকার, যেমন প্রয়োজন শেখ আল ঘাজালির মত লোকের।

বাহরাইনের শিয়া গ্রাম বানি জামারার এক তরুণ সাইয়্যেদ ফাদাল্লাহর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে

এবং সবশেষ বাহরাইন, এ গ্রীন ওয়েসিস সংবাদ প্রদান করছে যে ফাদাল্লাহর মৃত্যুতে বান জামারা গ্রামে এক শোভাযাত্রা বের হয়। এই শোভাযাত্রার ছবি দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .