ইরাকের প্রাচীন অ্যাসিরিয়ান শহর ধ্বংস করল আইএসআইএস

আসুরনাসিরপালের উত্তর পশ্চিম প্রাসাদ নিমরুদ লামাসসু [অ্যাসিরিয়ান সুরক্ষাশ্বর] (ছবিঃ উইকিপিডিয়া)

আসুরনাসিরপালের উত্তর পশ্চিম প্রাসাদ নিমরুদ লামাসসু [অ্যাসিরিয়ান সুরক্ষাশ্বর] (ছবিঃ উইকিপিডিয়া

প্রগতিবাদী সংগঠন আইএসআইএস দ্বারা নিমরুদের প্রাচীন অ্যাসিরিয়ান শহর ধ্বংসের খবর বিশ্ববাসীকে মর্মাহত করেছে। একইভাবে বিভিন্ন দেশের সরকার, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন এনজিও এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

পোস্টটি লেখার সময় পর্যন্ত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আলাদা আলাদাভাবে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্নয় করতে পারেনি। তবে অনলাইনে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে ইরাকের পর্যটন এবং প্রাচীনকালের নিদর্শন বিষয়ক মন্ত্রণালয় আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে “সারা বিশ্বের আগ্রহ এবং মানবতার অনুভূতিকে” অমান্য করার অভিযোগ এনেছেঃ 

দায়েশ [আইএসআইএস এর আরবি শব্দ] সন্ত্রাসী দলটি সমগ্র বিশ্বের আগ্রহ এবং মানবতার অনুভূতিকে অমান্য করে চলেছে। তাদের বেপরোয়া আক্রমণের ধারাবাহিকতায় একটি নতুন অপরাধ যুক্ত হয়েছে। তারা নিমরুদের প্রাচীন শহর আক্রমণ করেছে এবং ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে শহরটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। হামলা চালানোর সময় তারা ১৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক আকর্ষণগুলো আত্মসাৎ করে নেয়।   

নিমরুদ শহরটি মসুলের দক্ষিণে অবস্থিত। এটি ১২৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে খুঁজে পাওয়া গেছে এবং পরে এটি নিও-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। এটি ছিল সে সময়কার বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যটিই আধুনিককালের মিসর, তুরস্ক এবং ইরানের রূপকার।   

ঘটনাটির সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল যেমনটি ব্যাখ্যা দিয়েছেঃ  

১৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ সময়ের মধ্যেই এই স্থানে একটি শহরের গোড়াপত্তন হয়ে গিয়েছিল। তবে নবম শতাব্দীর পূর্বাব্দের শুরুতে রাজা দ্বিতীয় আশুরনাসিরপাল শহরটিকে তাঁর নতুন প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এখানে পাঁচ মাইল দীর্ঘ একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন। তিনি জিগুরাত নামে একটি ভাস্কর্য খচিত স্তম্ভ, নতুন মন্দির এবং সুনির্মিত অলঙ্করণে সজ্জিত একটি বড় প্রাসাদ নির্মাণ করেন।  

এগুলো সেই রাজকীয় অলঙ্করণ, যার প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য অনেক বেশি। দুর্বোধ্যভাবে খোদাই করা উদগত শিল্পকর্মের বড় বড় পাথরের দেয়ালের সারি আছে সেখানে। এগুলো শৈল্পিক দালানগুলোর মাটির তৈরি ইটের দেয়ালের সারি করা ভিত্তি হিসেবে রয়েছে। দুর্দান্তভাবে চিত্রিত এসব শিল্পকর্মের বর্ণনায় প্যানেলটিতে সামরিক প্রচারাভিযানের চিত্র দেখা যায়। চিত্রগুলোতে বশীভূত জনগণকে রাজার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে দেখা যায়, রাজাকে (কখনও কখনও কোন শোভাবর্ধক, পবিত্র গাছের ধার ঘেঁষে) যাবতীয় ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান পালন করতে দেখা যায়। অনেক সপক্ষ পৌরাণিক প্রতিমাগুলো ‘জেনিস’ নামে পরিচিত।       

রয়টারস একটি উপজাতি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়েছে, যারা দাবি করেছে যে “ইসলামিক স্টেট সদস্যরা নিমরুদ প্রত্নতাত্ত্বিক শহরটিতে এসেছে এবং এখানে থাকা মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে। এরপর শহরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে এগিয়ে গেছে”। আর সেখানে “প্রাচীন অনেক মূর্তি এবং প্রাচীর, আর একটি দূর্গ ছিল, যা ইসলামিক স্টেট সম্পূর্ণভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছে”।     

মসুলের নিনেভেহ জাদুঘরের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলো ধ্বংস করা উদযাপন করতে আইএসআইএস একটি ভিডিও প্রকাশের কয়েকদিন পর এই ঘটনা ঘটে। তারা যখন মসুল লাইব্রেরীতে লণ্ডভণ্ড করে লুটতরাজ করে তখন অগণিত প্রাচীন বই এবং পাণ্ডুলিপি পোড়ানোর মাধ্যমে তাদের ধ্বংসাত্মক কাজ এগিয়ে চলে। সৌভাগ্যের বিষয় অনেকগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ আগেই বাগদাদ জাদুঘর এবং পশ্চিমের অনেকগুলো শহরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, প্রকান্ড পাখা বিশিষ্ট কয়েকটি ষাঁড় (লামাসু)। এগুলো বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।      

ইরাকের অমূল্য উত্তরাধিকারের যে ক্ষতি করা হয়েছে তার পরিমাণ যথাযথভাবে হিসাব করে বের করা বেশ কঠিন। ৯১১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ৬০৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে নিওঅ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যই ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাবান একটি শাসক দল। লেবানিজ বংশোদ্ভূত ইরাকি ব্লগার এবং ব্যঙ্গনবিশ কার্ল শ্যারোর এই টুইটগুলোর জন্য বর্ননা প্রসঙ্গে এই তথ্যগুলো দেয়া হয়েছেঃ  

তবে আইএসআইএস আসলেই অনেক পেছনের সময়ে ফিরে গেছে। তারা বর্তমানেও যেন অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে।  

‘আরব বসন্ত প্রতিবাদকারীরা অত্যাচারী শাসকের মূর্তি ধ্বংস করেছে’। সেই অত্যাচারী শাসক অ্যাসিরিয়া সাম্রাজ্যের রাজা সারগন। গাধাগুলো যেন কয়েক হাজার বছর পেছনে পড়ে আছে।

এখন বিখ্যাত তাঁর কার্টুন “আবু এ এবং আবু বি” এর কার্টুন চরিত্রগুলো জিহাদিদের ব্যাঙ্গ করে চলেছেঃ 

আমি এগুলোকে আবু এ এবং আবু বি #কার্টুন চরিত্রে পরিণত করেছি। @সোহাআওয়াদখালিলকে তাঁর অবদানের জন্য ধন্যবাদ। 

আইএসআইএস কর্তৃক ইরাকের প্রত্নতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার ধ্বংসের ঘটনাটিকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ২০০১ সালে তালেবান কর্তৃক আফগানিস্তানের বামিয়ান বুদ্ধের পাথর মূর্তি ধ্বংসের লজ্জাস্কর ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সংস্কৃতি সংস্থা কিংবা ইউনেস্কোর এক দাপ্তরিক বিবৃতিতে আইএসআইএস এর কার্যকলাপকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে নিন্দা জানান হয়েছে।

ইউনেস্কো মহাসচিব ইরিনা বোকোভা সারা বিশ্বকে এই ঘটিনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে আহ্বান জানিয়েছেনঃ 

আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারিনা। ইচ্ছাকৃতভাবে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ধ্বংস আইনের চোখে একটি যুদ্ধাপরাধ। আমি এই অঞ্চলের সকল রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের এই ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানাচ্ছি। আর আমি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে মানবতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ধ্বংসের কোন রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় কোন যুক্তি একেবারেই নেই। আমি সকলকে বিশেষকরে ইরাক এবং অন্য যেকোন স্থানে বসবাসকারী তরুণদের প্রতি তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এসব সম্পদ রক্ষা করতে যা কিছু করা সম্ভব তাঁর সবকিছু করতে আহ্বান জানাচ্ছি। তারা যেন তাদের নিজেদের সম্পদ, সমগ্র মানব জাতির উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ বলে মনে করে কাজ করে যায়।   

তিনি আইএসআইএস এর “অপরাধ নৈরাজ্য যা শিল্প সংস্কৃতিকে আরও বেশি শৈল্পিক উপায়ে ধ্বংস” করছে তাদের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানানোর আহ্বান জানিয়েছেনঃ   

সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর, সাংবাদিক, প্রফেসর এবং বিজ্ঞানীদের প্রতিও আবেদন জানাচ্ছি, যেন তারা এসব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ এবন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার গুরুত্ব শেয়ার করেন এবং ব্যাখ্যা করেন। আমাদেরকে এসব অপরাধ নৈরাজ্যের বিরুধে অবশ্যই প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে যা শিল্প সংস্কৃতিকে আরও বেশি সাংস্কৃতিক উপায়ে ধ্বংস করে চলেছে।  

ইরাকের কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাহরাম সালিহ টুইটারে আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে “বর্তমানকে হত্যা করা এবং মানবতার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পদ নিশ্চিহ্ন” করার অভিযোগ এনেছেনঃ   

#দায়েশ #নিমরুদের প্রাচীন অ্যাসিইরিয়ান শহর গুঁড়িয়ে দিয়েছে; তারা বর্তমানকে হত্যা করছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মানবতার সম্পদকে নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে।   

আমর ওয়াদিয়া তাঁর ৩ হাজারেরও বেশি সংখ্যক অনুসারীকে উদ্দেশ্য করে টুইট করেছেন। টুইটে তিনি আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে ইরাকের ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা করার অভিযোগ এনেছেনঃ 

দায়েশ [আইএসআইএস] ইরাকের নিমরুদ শহরটি ধ্বংস করে দিয়েছে। এ শহরে অ্যাসিরিয়ান শাসনামলের সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে মর্যাদা পূর্ণ নিদর্শন ছিল। এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো ৩ হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। দায়েশ ইতিহাস মুছে ফেলছে।  

ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসের ধারককে আপনার প্রয়োজন। ম্যাথিউ ওয়ার্ড আইএসআইএস কে প্রতিমাভঙ্গকারী বলে আখ্যায়িত করেছেনঃ 

#ইরাকের বিখ্যাত #নিমরুদ শহরের #প্রত্নতত্ত্ব নৃশংস প্রতিমাভঙ্গকারী উপায়ে ধ্বংস করা হচ্ছে।  

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .