পেশোয়ার আক্রমণের অন্তবর্তীকালীন ছবি, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সরকারী বিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে একটি ভাবনা

Screengrab from the Facebook page of Mubeen Shah, killed in the attack at the Army Public School in Peshawar.

মুবিন শাহ্ এর ফেসবুকের পাতা থেকে নেয়া ছবি। তাকে পেশোয়ারের সেনাবাহিনী সরকারী বিদ্যালয়ের আক্রমণের সময় হত্যা করা হয়।

আমার দুই বছরের মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে ‘কী হয়েছে, মা?’ আমি রক্তের দাগ লাগা সবুজ ও হলুদ ডোরাকাটা গলাবন্ধনী এবং সাদা পোষাকের ছবিগুলোকে কিছুতেই আমার মন থেকে দূর করতে পারছি না। আমি আশা করি যে সে আমার চোখের মধ্যে সেগুলিকে দেখতে পায় না।

কয়েক মিনিট পরে আমার স্বামী ক্ষুদেবার্তা পাঠায়, ‘ঠিক আমাদের মতো ঐ বয়সে। সকালের সমাবেশের সারিতে দাঁড়িয়ে। এ ঘটনার মতো কিছু ঘটতে পারে তা কখনোই তুমি ভাবতে পারবে না।’

আধাসামরিক পোষাক পরিহিত ছয়জন বন্দুকধারী তাদের মনের মধ্যে শুধু হত্যার চিন্তা নিয়ে পেশোয়ারের সেনাবাহিনী সরকারী বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। ১৩০জনেরও বেশী নিরাপরাধ, সুন্দর এবং আশাবাদী শিশুর জীবন যত ভয়ংকরভাবে সম্ভব তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। শত শত আরো শিক্ষার্থী এবং পরিবারগুলো তাদের দেহ ও মনে খোলা ক্ষত বয়ে বেরাচ্ছে। 

বিছানার নীচে আমাদের সন্তানদেরকে কল্পিত দানবের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার কথা, কিন্তু এই শিশুরা তাদের শ্রেণীকক্ষে জঘন্য সত্যিকার দানবের সম্মুখীন হলো। 

বন্দুকধারীরা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করার এক ঘন্টা পরে, এবং পাকিস্তানী বিশেষ বাহিনী পেশোয়ারের ছিন্নভিন্ন ক্যাম্পাসটিকে ঘিরে ফেলার ৩০মিনিট পর পাকিস্তানী তালেবানদের একজন মুখপাত্র রয়টারের কাছে বলে যে এই আক্রমণটি করা হয়েছিল ‘ওয়াজিরিস্তানে সেনাবাহিনী অভিযানের প্রতিশোধ হিসেবে’।

আক্রমণ করা এই শিশুদের কারো কারো পিতা হয়তো জুনে শুরু করা তালিবানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান জারবেআজাব-এ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে থাকতে পারে। 

সারা পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সরকারী বিদ্যালয়গুলোতে (এপিএস) ১০হাজারের বেশী শিক্ষার্থী পড়াশুনা করে, যেখানে একটি প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকুরীজীবি ও কঠোর-পরিশ্রমী পাকিস্তানীদের সন্তানদেরকে শিক্ষিত করা হয়।

Mubeen Shah in his uniform. His profile image uploaded on December 3, has been shared by close to a thousand people.

মুবিন শাহ তার স্কুলের পোষাকে। ডিসেম্বরের ৩ তারিখে আপলোড করা তার ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি যেটিকে শত শত বার বিতরণ করা হয়েছে।

আমি যে এপিএস-এর ব্যবস্থাকে ‘প্রগতিশীল’ বলছি তা শুনে অনেক পাকিস্তানীই হয়তো মর্মাহত হবে। আমি এই শব্দটি খুব হালকাভাবে ব্যবহার করি না। বিগত কয়েক ঘন্টা ধরে তাদের ওয়েবসাইটি আমি মনোযোগ দিয়ে দেখে, এই বিদ্যালয় সম্পর্কে আমি যে গল্পগুলো শুনেছি এবং পাকিস্তানের অন্যান্য বিদ্যালয়গুলোর সাথে এদের মূল্যবোধ, প্রশিক্ষণের পদ্ধতি, পাঠ্যক্রম এবং সংগঠিত অবস্থার তুলনা করেই আমি শুধুমাত্র এই সিদ্ধান্তই নিতে পারি। 

সারা দেশ জুড়ে ১৪৬টিরও বেশী সেনাবাহিনী সরকারী বিদ্যালয় রয়েছে। এদের কোন কোনটি দেশের সবথেকে দূরবর্তী অংশে অবস্থিত, যেখানে অন্য আর কোন বিদ্যালয় নেই। এদিকে এপিএস-এর মানের অন্যান্য বিদ্যালয় ব্যবস্থাও রয়েছে – উদাহরণস্বরূপ বীকণহাউস, সিটি বিদ্যালয় এবং রুটস – এগুলো সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যালয় যেখানে পড়ার জন্য উচ্চহারে বেতন প্রদান করতে হয়। 

অনেক বছর আগে আমার স্বামী এবং তার ভাইরা এপিএস বিদ্যালয়গুলোতে যেত, প্রায়শঃই যখন তাদের বাবা কোন জায়গায় স্থানান্তরিত হতো সেখানে শুধু এপিএস বিদ্যালয়গুলোই ছিলো। বর্তমানে, তারা কৌতুক করে তাদের বানানের ভুলগুলোর জন্য এপিএস-এর শিক্ষাকে দোষ দেয়, কিন্তু সামগ্রিক, দৃঢ়-বুনন, জনগোষ্ঠী ভিত্তিক যে শিক্ষা তারা পেয়েছে তার অন্য গল্পটি আমার মতো কারো কাছে সর্বদাই অদ্বিতীয় লাগতো, যেই আমি নিউ ইয়র্কের একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্যাথোলিক বিদ্যালয়, এবং ইসলামাবাদের একটি আধা-সরকারী বালিকা বিদ্যালয় ও একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন বিদ্যালয়ে শিক্ষিত হয়েছি। 

পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে খুত আছে, কিন্তু এপিএস ব্যবস্থা সামর্থের মধ্যে শিক্ষা প্রদান করতে চেষ্টা করে, সামগ্রিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয়, কঠোর শিক্ষক প্রশিক্ষণ, অবিশ্বাস্য ভালভাবে তৈরী পাঠ্যপুস্তক, এবং দ্রুত পাঠ্যসূচী তৈরী করতে চেষ্টা করে। আমি এই সকল তথ্য তাদের ওয়েবসাইট থেকে পেয়েছি, যা ‘শিক্ষা প্রদান ও শিখনের জন্য সম্পদ সেই সাথে সাথে ত্রিমুখী শিখনের অংশ হবার জন্য পিতামাতাদের জন্য একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করে’ বলে তারা উপস্থাপন করে।

এখানে তাদের ‘প্রাক-বিদ্যালয়’ শিক্ষক প্রশিক্ষণ-এর জন্য একটি প্রায়শঃ জিজ্ঞাস্য প্রশ্নমালার কিয়দংশ তুলে ধরা হলো: বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কাছে অর্থবহ হয় যদি এটি প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়। শিক্ষার্থীরা যখন অনুধাবন করে যে দক্ষতাগুলো শ্রেণীকক্ষে শিখানো/বিকাশ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ করা যায়, তবেই তারা শিক্ষাকে অর্থবহ হিসেবে দেখতে পাবে এবং তাদের আরও আগ্রহ জন্মাবে।’

পাকিস্তান বা অন্যান্য সাবেক বৃটিশ উপনিবেশগুলোর বেশীরভাগ বিদ্যালয়গুলোর মতো শিখার্থীরা বিভিন্ন ‘গৃহে’ বিভক্ত যারা বিতর্ক, খেলাধূলা এবং অন্যান্য কার্যক্রমে প্রতিযোগিতা করে থাকে। এপিএস-এ গৃহগুলো  হলো ‘একতা’, ‘বিশ্বাস’, ‘নিয়মানুবর্তীতা’, এবং ‘সহিষ্ণুতা’। এগুলোই হলো সেই মূল্যবোধ যেগুলোকে এপিএস-এর শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রোথিত করা হয়। 

1465118_10153075150314305_7294204234555695461_n

করাচীতে পেশোয়ার আক্রমণের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে মোমের আলোর নিশিপালন। ছবি @আলিয়াচুগতাই এর সৌজন্যে।

২০১৩ সালে, এপিএস-এর কেন্দ্রীয় সংগঠনকারী অঙ্গ যখন তাদের ওয়েবসাইটে ‘হাসি-জাগ্রত আবেগগতভাবে স্বাস্থ্যবান শিশু’ প্রকল্প চালু করে যাতে পিতামাতারা একজন বস্তুনিষ্ঠ মনস্তাত্বিকবিদের কাছে প্রশ্ন পাঠাতে পারবে, যার শিশু ও তরুণদের সাথে কাজ করার ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি সেবাটি পরখ করে দেখি নি কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে একজন বিশেষজ্ঞ ইমেইল-এর মাধ্যমে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে। 

এছাড়াও তারা ‘মূল্যবোধ শিক্ষা কার্যক্রম’ পরিচালনা করে থাকে, যেখানে ‘বৈশ্বিক নাগরিকদের আবেগগত কল্যাণ এবং আরও ভাল মানুষের বিকাশ করা যারা শান্তি ও ঐক্যের ভিত্তিতে সৃষ্ট একটি বিবাদমূক্ত পৃথিবী গড়তে অবদান রাখতে পারে’ তার উপর আলোকপাত করে। তাদের এই কার্যক্রমের জন্য ২০১৩-২০১৪ পুস্তিকার শিরোনাম হলো ‘শান্তি ও ঐক্যের বছর’ যেখানে বিবাদ মিমাংসা, উৎপীড়ন, সাইবার উৎপীড়ন, পুনপ্রক্রিয়াকরণ, এবং আরও কত কিছু নিয়ে আলোচনা করেছে।

শ্রেণীকক্ষের বিবাদ বোঝা ও সামলানোর উপর তাদের একটি অধ্যায় থেকে অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো: ‘মানুষ হিসেবে অন্যান্যদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়া আমাদের জন্য অনিবার্য, কারণ আমাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন অগ্রাধিকার, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, চাহিদা এবং দাবী আছে। বিবাদ, সেকারণেই, আমাদের জীবনের একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক অংশ। বিবাদ যে ধ্বংসাত্মক হবে এমন নয়। আমরা কিভাবে বিবাদে সাড়া দেই তার উপর নির্ভর করে এটি গঠনমূলক হবে বা ধ্বংসাত্মক হবে।’

আমি জানি না এই উপকরণ বা প্রশিক্ষণগুলোর ঠিক কতোখানি সারা দেশে থাকা তাদের ডজন ডজন শাখাগুলোর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে, কিন্তু নিদেনপক্ষে তাদের একটি দৃঢ় পরিকল্পনা রয়েছে। শিশুদের জন্য একটি পরিকল্পনা, যাদের পিতারা পাকিস্তানের সবচাইতে ভয়ংকর ও মর্মপীড়াদায়ক সমস্যা–ভাবাদর্শের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া তালেবান জঙ্গিবাদ–এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। 

পাকিস্তানের অন্যান্য বিদ্যালয়ের অনেকগুলোই–ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং সরকারী উভয়ই–এপিএস এর পুস্তিকা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ নির্দেশিকা থেকে কতো কিছু্ই শিখতে পারতো। 

পরিশেষে, এই যুদ্ধ বোমা বা গুলি দ্বারা জয় করা যাবে না, কিন্তু একটি বর্বর ভাবাদর্শের শিকার হতে পারে এরকম আক্রম্য শিশুদেরকে এই নির্দয় দানবগুলো আসলে কী তা চিনতে পারার হাতিয়ার প্রদান করার মাধ্যমে করা যাবে। 

শহর হাবিব গাজী গ্লোবাল ভয়েস-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। সে এটিকে এপিএস-এর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তীর মতো শুনাক তা চায়নি, এবং যদি তা হয়ে থাকে তবে তার জন্য সে দুঃখিত, কিন্তু সে বিশ্বাস করে যে এপিএস-এর ঘটনাগুলো পাকিস্তানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও না বলা ঘটনাগুলোর একটি। সে টুইট করে  @SaharHGhazi। 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .