বাংলাদেশে সম্প্রচার নীতিমালার অনুমোদন, সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের আশংকা

বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় জোট রাজধানী ঢাকায় জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার বিপক্ষে র‍্যালিতে অংশ নিচ্ছে। ছবি ঈন্দ্রাজিত ঘোষের। সর্বস্বত্ব ডেমটিক্স (১৯/৮/২০১৪)

রাজনৈতিক দল বিএনপি ও শরিক দলগুলো রাজধানী ঢাকায় জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার বিপক্ষে র‍্যালিতে অংশ নিচ্ছে। ছবি ঈন্দ্রাজিত ঘোষের। সর্বস্বত্ব ডেমটিক্স (১৯/৮/২০১৪)।

বাংলাদেশে টেলিভিশন ও বেতারের জন্যে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার খসড়া সম্প্রতি ক্যাবিনেটে অনুমোদন করা হয়েছে। এই নীতিমালার আওতায় সম্প্রচার আইন তৈরি এবং একটি স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে এই নীতিমালা নিয়ে সম্প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে জড়িতরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও রাজনৈতিক দল বিএনপি ও শরিক দলগুলো রাজধানী ঢাকায় জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। তারা মনে করেন, এটি কণ্ঠ চেপে ধরার সুযোগ করে দেবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশনের সংখ্যা সব মিলিয়ে ২৫টি। আর বেতারের সংখ্যা ১০টিরও বেশি। বাংলাদশের প্রচারমাধ্যম আপাতঃদৃষ্টিতে স্বাধীন, যদিও রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডার এর প্রেস এর স্বাধীনতা সূচকে ১৭৮ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ ও মিডিয়া হাউজ বেসরকারি মিডিয়ার মালিক যারা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী। কার্যকরী নীতিমালা ও নির্দেশনার অভাবে অনেক সংবাদ মাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষয়বস্তু চুরি করা, কুৎসা রচনা ও প্রোপাগান্ডা চালানোর অভিযোগ আছে। সাথে সাথে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারনে বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এইসব অপকর্মের বিচার হয়না।

বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তাই এই সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলো সম্পাদকীয়তে লিখেছে:

[…] সম্প্রচার নীতিমালায় প্রতিষ্ঠানবিশেষের খবর প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ জারির কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যম কী প্রচার করবে, কী প্রচার করবে না, সেটি সরকার বা তথ্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা জারি করে বলে দিতে পারে না।

তবে ব্লগার সাক্ষী সত্যানন্দ ৩৯ অনুচ্ছেদের পুরোটাই তুলে ধরে নতুন সম্প্রচার নীতিমালা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। এই ব্লগার দেখিয়েছেন যে এই সম্প্রচার নীতি অনুযায়ী ৩৯ অনুচ্ছেদের যে সব বিষয় উল্লিখিত আছে সেসব নিয়ে বিবাদ হলে সকল অংশীদারকে নিয়ে আলোচনা করা হবে।

সরকারের এ ধরনের নীতিমালার কেন প্রয়োজন পড়লো তা জানিয়েছেন সাংবাদিক, ব্লগার এবং বাম আন্দোলন কর্মী আরিফুজ্জামান তুহিন:

এখন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একটি সরকার ক্ষমতায় যাদের অনির্বাচিত বলাই শ্রেয়। এরকম সরকারের জন্য এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ও নীতিমালা খুব দরকার। [..] সম্ভাব্য সমালোচনা আসতে পারে এমন সব বিষয়ের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র শান দিয়ে রাখে। এই নীতিমালা হলো সে ধরনের অস্ত্র।

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানও সম্প্রচার নীতিমালাকে সমালোচনা ও নিন্দা থেকে রক্ষা পাওয়ার বর্ম বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও দেশটির তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন অন্য কথা। তিনি মিডিয়াকে জানিয়েছেন, বিকাশমান অবস্থায় থাকা সম্প্রচার মাধ্যম এখন বিছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কিছু আইন, বিধি আর চুক্তি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। সেজন্য এ নীতিমালা করা হয়েছে।

ব্লগার ফিরোজ জামান চৌধুরী পুরোনো এক পোস্টে জানিয়েছেন যে দেশে রাতারাতি এতগুলো বেসরকারি টিভি ও রেডিও চালু হয়েছে যাদের জন্যে মানানসই নীতিমালা কিন্তু তৈরি করা হয়নি।

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা মন্ত্রীসভায় অনুমোদন পাবার পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়। সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িতরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অনুমোদনের আগে কেন বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো না সে প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক আমিন আল রশীদ:

সম্প্রচার নীতিমালা নিয়া সম্প্রচারকর্মীরা খুবই উদ্বিগ্ন….তো এইটা মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের আগে এর ধারা উপধারা নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করলেন না কেন?…তাহলে তো সরকার একটা চাপে থাকত এবং এটা অনুমোদনের আগে আরও হয়তো পরীক্ষা নিরীক্ষা করত…বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে যাবার আগে শিকারি যাতে ট্রিগারে চাপ দিতে না পারে, সেই চেষ্টাটা উত্তম…

এখানে টুইটার থেকে কিছু প্রতিক্রিয়া দেয়া হল

জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা: ইতিহাসের শেষ? http://t.co/JnGKhYXxaD

বাংলাদেশে সম্প্রচার নীতিমালা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে – যদিও স্বাধীন সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে।

সম্প্রচার নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারির পরেই তথ্য মন্ত্রণালয় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাংবাদিক প্রভাষ আমিন:

আগামীকাল ৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী দিবস। তথ্য মন্ত্রণালয়ের পাঠানো তথ্যবিবরণীতে আদিবাসী দিবসের বিভিন্ন আয়োজনে ‘আদিবাসী’ শব্দটি পরিহার করার অনুরোধ করা হয়েছে। কি অদ্ভুত অনুরোধ, আদিবাসী দিবসে আদিবাসী বলা যাবে না। বলতে হবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বা উপজাতি।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে ৪টি বাদে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২০০২ সালে একুশে টেলিভিশন, ২০১০ সালে চ্যানেল ওয়ান, ২০১৩ সালে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন এবং দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (সংশোধন) আইন পাস হয়েছে, সেখানে একটি ধারায় এমনভাবে অপরাধ সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে ইন্টারনেটে যেকোনো কর্মকাণ্ডকেই এই আইনের আওতায় অপরাধ হিসেবে গণ্য করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী একটি জাতীয় অনলাইন মিডিয়া নীতিমালার খসড়া করা হয়েছে যা এই জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার মত প্রশ্নবিদ্ধ। এই নীতির আওতায় যে কোন অনলাইন মিডিয়াকে অনেক টাকা দিয়ে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। এটি সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সংবাদ করা নিষিদ্ধ করবে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক প্রভাবিত সহিংস আন্দোলন, বিদ্রোহ এবং অন্যান্য হানিকর সংবাদ প্রচারেও বিধিনিষেধ আনবে।

গত ১৮ই আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে একটি রিট পিটিশন জারি করে মোঃ ইউনুস আলি আকন্দ বলে সুপ্রিম কোর্ট এর এক সাংবাদিক।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .