হাইকোর্ট কর্তৃক জামায়াতে ইসলামের নিবন্ধন বাতিল, তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ হুমকির মুখে

বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে হাইকোর্ট। যুদ্ধাপরাধী সংগঠনটির নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা শোনার পর অনেক নেটিজেন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। কেউ কেউ অবশ্য গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হলো কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন।

গত বৃহস্পতিবার (১লা আগস্ট) হাইকোর্ট এই রায় দেয়। ২০০৯ সালে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে অন্য কয়েকটি ইসলামপন্থী সংগঠনের ২৫ জন নেতার আবেদনের পর হাইকোর্ট এই রায় দিলো।

এই রায়ের ফলে জামায়াত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।

এই রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে তাদের কর্মকাণ্ড। তবে তাদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবী ওঠে গত ফেব্রুয়ারীতে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলন থেকে (গ্লোবাল ভয়েসেস এর বিশেষ প্রতিবেদনগুলো দেখুন) যা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের ফাঁসির দাবী নিয়ে লড়ছে। এই সব যুদ্ধপরাধীদের অধিকাংশই জামাতে ইসলামীর নেতা এবং দেলোয়ার হোসেন সাঈদী এবং আলী হাসান মোহাম্মদ মোজাহিদের মত উচ্চপদস্থ নেতাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আদালত। একই ধরনের অপরাধের জন্যে তাদের আরও কয়েকজন নেতার বিচার চলছে।

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামাত নেতাদের বিচারের প্রতিবাদে জামাত সমর্থকরা পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছেন

যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত জামাত নেতাদের বিচারের প্রতিবাদে জামাত সমর্থকরা পুলিশের উপর চড়াও হচ্ছেন। ছবি রেহমান আসাদের। সর্ব স্বত্ব ডেমোটিক্স (২৮/১/২০১৩)

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাতের রয়েছে সারা দেশ জুড়ে প্রচুর একনিষ্ঠ নেতাকর্মী এবং তারা প্রধান বিরোধীদল বিএনপির প্রধান সহযোগী। তবে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিয়ে অনেকেই তাদের সমালোচনা করেন যা গত নির্বাচনে তাদের ফলাফল থেকে দৃশ্যমান। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তারা মাত্র ৪.১৬% ভোট পায় এবং মোট ৩০০টি আসন থেকে মাত্র দুইটিতে জয়লাভ করে (৩৯টিতে প্রার্থী দিয়েছিল তারা)। গত মার্চ মাসে ব্লগার জ্যোতি রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামাত ফ্যাক্টর নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যেখানে তিনি অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি জামাতের অর্থনৈতিক ও আদর্শগত প্রেরণার কথা লিখেছেন:

In the quarter century since the party’s relaunch, the Jamaat has made considerable inroads in several non-state sectors as well. Islami Bank, whose management is affiliated with the Jamaat, has become the third largest bank in the country. Jamaat-supported hospitals and coaching centres provide affordable health care and education to urban, working and the lower middle classes. The party has particularly strong financial ties with countries in the Gulf, which helps with these enterprises. Funding and ideological support also comes from the radical Islamic discourse among the diaspora Bangladeshi community in the UK.

জামাতের রাজনীতিতে ফেরার পঁচিশ বছরের মধ্যে তারা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে জায়গা করে নিতে পেরেছে। ইসলামী ব্যাঙ্ক, যার পরিচালনার সাথে জামাত জড়িত, এখন দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্ক। জামাতের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিক ও কোচিং সেন্টারগুলো দেশের শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের সুলভে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সেবা দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সাথে এদের ভাল অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে যা এইসব উদ্যোগগুলোর অর্থায়ন করে। তবে তাদের অর্থ ও ভাবধারার অন্যতম যোগানদাতা হচ্ছে ব্রিটেনে অবস্থিত প্রবাসী বাংলাদেশী কম্যুনিটি এবং তাদের মৌলবাদী চিন্তাধারা।

আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছিল যে জামায়াতে ইসলামীর আর্দশ ও ভাবধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং নিচের ৪টি বিষয় গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করা হয়:

১) জামাত সাংসদদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে স্বীকার করে না।
২) নির্বাচন কমিশন জাতি ও ধর্ম বিদ্বেষী দলকে নিবন্ধন দিতে পারে না।
৩) ধর্ম বা লিঙ্গবৈষম্য সমর্থন করে না: জামাতের সংবিধান অনুযায়ী কোন অমুসলিম বা নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করা যাবে না।
৪) স্থানীয় ভাবে নিবন্ধিত নয়: জামাতের মূল নিবন্ধন ভারতে এবং ভারত ও পাকিস্তান সহ বিভিন্ন দেশে এর শাখা আছে।

রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভ মিছিল। ছবি তুলেছেন মেহেদী হাসান। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০১/০৮/২০১৩)

রায়ের প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভ মিছিল। ছবি তুলেছেন মেহেদী হাসান। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০১/০৮/২০১৩)

গত সোমবার (৫ই আগস্ট) আপিলেট ডিভিশনের একটি বিশ্রাম কালীন বেঞ্চ হাইকোর্টের রুলটির বিরুদ্ধে স্থগিতকরণ আদেশের আবেদন খারিজ করেছে। তবে আপিল কোর্ট আবার চালু হলে জামাত আপীল করতে পারবে হাইকোর্টের বিরুদ্ধে। এদিকে রায়ের প্রতিবাদে সংগঠনটি ১২ আগস্ট ২০১৩ থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছে।

তবে হাইকোর্ট জামাতের উর্ধ্বতন নেতাদের উপর সমন জারি করেছে আদালতে হাজির হয়ে কারণ দর্শাতে কেন উক্ত হরতালের ডাক আদালত অবমাননা হবে না।

অনেক নেট নাগরিক এই রুলিংকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাকিনা কাশিম (@SaqeenaQuasim) টুইটারে লিখেছেন:

বাংলাদেশে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে না। যাক, বাঁচা গেল!

জামায়াতকে দুষ্টক্ষত হিসেবে উল্লেখ করে কাজী মামুন ফেসবুকে লিখেছেন:

‘ইনহিউম্যান’ বলেন আর যাই বলেন, আই ডোন্ট কেয়ার! জামাত হলো একটা গ্যাংগ্রিন এর মতো। কেটে সমূলে উৎপাদন না করা হলে কোনো লাভ নেই!

জারা কাদির Zara (@zarakadir) জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলকে মেনে নিতে পারেন নি। তিনি মনে করেন এতে গণতন্ত্রচর্চা ব্যাহত হবে:

জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় যারা খুশি হয়েছেন, এখনো কি মনে করছেন, এটা যুদ্ধাপরাধের সাথে সম্পর্কিত? আপনি গণতন্ত্র ধ্বংস করে ফেলছেন। তাই আস্তে তালি বাজান। #SaveBangladesh

বাংলাদেশের প্রায় ৮৯% মানুষ মুসলিম। তাই এদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে ইসলামী রাজনীতি বন্ধ করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন রজব আলী (@RozobAli):

একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলকে ব্যান করে মুসলমানদের রাজনীতি থেকে দমানো যাবে না। এতে শুধু সভ্যতার সংঘাতকেই শক্তিশালী করা হবে।

এদিকে কয়েকটি ইসলামী দলের আবেদনের প্রেক্ষিতে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আজাদ আলী (@azadaliCCM) টুইটারে লিখেছেন:

মিশরের সালাফি নূর পার্টি সেনা অভ্যুত্থানে সহযোগিতা করেছে। আর বাংলাদেশে কিছু সুফি দল চায় না জামায়াত রাজনীতি করুক!?

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধের জোড়ালো দাবি উঠেছিল। এখন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হওয়াকে অনেকেই ভাবছেন জামায়াত বুঝি নিষিদ্ধ হয়েছে। বিষয়টি খোলাসা করতে ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট কল্লোল মোস্তাফা ফেসবুকে লিখেছেন:

জামাতে ইসলামিকে নির্বাচন কমিশনের দেয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করা আর জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা দুইটা কিন্তু একেবারে ভিন্ন বিষয়। হাইকোর্টের রায়ে নির্বাচন কমিশনে জামাতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হওয়ার পর, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন জামাতের নিবন্ধন বাতিল করলে, দল হিসেবে জামাতে ইসলামি নির্বাচন করতে পারবে না কিন্তু জামাতের দলীয় রাজনীতি কিংবা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কিন্তু তাতে নিষিদ্ধ হয় না।

শাহবাগ প্রতিবাদের সময় জামাত নেতাদের বিরুদ্ধে দেয়ালচিত্র।

শাহবাগ প্রতিবাদের সময় জামাত নেতাদের বিরুদ্ধে দেয়ালচিত্র। ছবি ফ্লিকার থেকে মেহদি হাসানের। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স (সিসি বাই-এনসি-এসএ ২.০) এর আওতায় ব্যবহৃত)

জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির ময়দানে ইসলামকে অনেক সময় নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা ধর্মের নামে হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত করেছিল। তাই এদেরকে ইসলাম থেকে খারিজ করার আহবান জানিয়ে জনপ্রিয় গায়ক মাকসুদুল হক ফেসবুকে পোস্ট দেন:

‘নিবন্ধন বাতিল’ নিয়ে চতুর্দিকে যখন ‘চেতনার’ জয়গান তখন আমার কোনো আনন্দ নেই। নিষিদ্ধ করুন… তাতেও আমার কাছে নো বিগ ডিল… এদের পাপ ক্ষমার অযোগ্য… ইসলাম থেকে এই হায়েনাদের খারিজ করুন, বুকে ইমান রাখুন মজবুত এবং বীর দর্পে বলুন… ‘এরা মুসলমান না এরা কাফের’ সেদিনই শহীদানের আত্মা শান্তি পাবে… সেদিন বাংলাদেশে ইসলাম কলঙ্কমুক্ত হবে…

১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি বেশ কয়েকবার নিষিদ্ধ হয়েছে। ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৯৭৯ সালে দলটি আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। বিষয়টি নিয়ে শাহ আলী ফরহাদ(@shah_farhad) টুইটারে টুইট করেন:

জামাত যদি এখন নিষিদ্ধ হয়, তাহলে এটাই তার প্রথম নিষিদ্ধ হওয়া নয়। এটা চতুর্থবারের মতো নিষিদ্ধ হবে তারা। #SaveBangladesh pic.twitter.com/YJjXQijMiE

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .