বাংলাদেশ: সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনায় ক্ষুব্ধ, লজ্জিত

“আমার কোন অজুহাত নেই। আমার পরিবারের উপর শুয়োরের দলের হামলা হয়েছে। আমি ঠেকাতে পারিনি। এই অপরাধের দায় নিয়ে মাথা নিচু করে আছি। আমি লজ্জিত। আমার ক্ষমা পাওয়া উচিত নয়, তবুও আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাই।”

“আমি খুব লজ্জ্বিত… পেপারে ধ্বংসযজ্ঞের ছবি দেখে খুবই খারাপ লাগছে। মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক, ধর্মের নামে এই অনাচার বন্ধ হোক।”

এই রকম অসংখ্য স্ট্যাটাস এখন বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের ওয়ালে শোভা পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে না পারায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অনেকেই লজ্জ্বিত। কেউ ক্ষমা চাচ্ছেন। কেউ প্রতিবাদে রাজপথে নেমে বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে হামলার ঘটনার বিচার দাবি করছেন।

শাহবাগের জাতীয় যাদুঘরের সামনে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবিটি বাংলাদেশ সেকুলার হিউমানিস্ট মুভমেন্টের ফেসবুক পেজ থেকে নেয়া।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজার জেলার রামুতে ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বৌদ্ধ মন্দির ও বসতি হামলা চালায়। এই হামলায় রামু উপজেলার ৭টি বৌদ্ধ মন্দির, প্রায় ৩০টি বাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে আরো শতাধিক বাড়ি ও দোকানে। পরেরদিন পটিয়া ও উখিয়ায় বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির এবং বসতি আক্রান্ত হয়।

ঘটনার সূত্রপাত নিয়ে ব্লগার কূলদা রায় তার ফেসবুক নোটে বলেন:

ঘটনাটির শুরু হয়েছিল রামুতে। কিন্তু আদতে রামুতেও নয়– ফেসবুকে। উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে একজন লোক ফেসবুকে সামাজিক নেট-ওয়ার্কে যুক্ত আছেন। […] সেই লোকটির ওয়ালে একটি লিঙ্ক শেয়ার হয়েছে। এটা ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরান অবমাননা সংক্রান্ত লিঙ্ক। উত্তম বড়ুয়া বলেছেন এটা তিনি করেননি। অন্যের পোস্ট থেকে চলে এসেছে।

এই সূত্র ধরেই উত্তম কুমারকে সনাক্ত করা হয়েছে, তিনি মানুষ নন, তিনি বৌদ্ধ। সুতরাং এই অবমাননার দায় বৌদ্ধ ধর্মের উপরেই বর্তায়। সুতরাং ক্ষুব্ধ লোকজন মোবাইলে তড়িৎবেগে এলাকাতে এই ঘটনাটি জানিয়ে দেয়। লোকজন এই ভাদ্রের রাতে হাজির হয়। মিটিং করে। আক্রমণ করে রামুর বৌদ্ধ পাড়ায়।

সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত আক্রমণ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশের পোস্টার।

সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত আক্রমণের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। হয়েছে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানববন্ধন। ইয়ুথ ফর পিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি নাগরিক তদন্ত পরিচালনা করার উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণ ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, সাংবাদিক এবং অন্যান্য নাগরিক প্রতিনিধি তদন্ত কাজে অংশ নিবেন। তারা একদম ব্যক্তি পর্যায় থেকে তদন্ত শুরু করে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের উপরে ঘটে যাওয়া হামলাগুলোর পিছনে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাদের অপরাধের প্রমাণ-আলামত সংগ্রহ করতে এই উদ্যোগ নিয়েছে।

৮ অক্টোবর ফেসবুক প্রোফাইল ছবি কালো রাখার মাধ্যমে বৌদ্ধদের ওপর আক্রমণের প্রতিবাদ কর্মসূচি দিয়েছে কোজিটো। তাদের সাথে অনেক একাত্মতা ঘোষণা করেছেন অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী। কোজিটো একটি ভিডিও আপলোড করেছে। ভিডিওটি ইতোমধ্যে ফেসবুকে অসংখ্যবার শেয়ার হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা বেশ কয়েকবার হামলার শিকার হয়েছেন। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে রামুর বৌদ্ধ মন্দির ও বসতিতে আক্রমণের ধরন ভিন্ন। ব্লগার বিপ্লব রহমান তার ব্লগে মূল ইন্ধনদাতার রাজনৈতিক শক্তি একই বলে উল্লেখ করেছেন।

মন্দির ভাংচুরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ ইতোমধ্যে ১৬৬ জনকে গ্রেফতার করেছে। মামলা হয়েছে ১৭টি। তবে বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বিরোধীদল পরস্পরকে দোষারোপ করছে। এই ঘটনার পিছনে সাম্প্রদায়িক দল জামায়াতে ইসলামীর ইন্ধন থাকার অভিযোগও উঠেছে। এদিকে হামলা প্রতিরোধে প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ভূমিকা রাখেনি বলে অভিযোগ করেছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। প্রশাসন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় হাইকোর্ট রুল জারি করেছে।

কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের উপর হামলার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবে ছাত্রদের প্রতিবাদ। ছবি তুলেছেন ফিরোজ আহমেদ। কপিরাইট ডেমোটিক্স, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১২।

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের কেউ কেউ অবশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে থেকে হুমকিও পেয়েছেন। যেমন সচলায়তন ব্লগের সবুজ পাহাড়ের রাজা। তিনি ঘটনার প্রতিবাদে পোস্টার নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ফেসবুকে, ব্লগে এ নিয়ে লেখালিখি করেছেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি একটি পোস্টে জানান:

গতকাল রাতে ফেসবুকে ধর্মন্ধদের বিরুদ্ধে কিছু স্ট্যাটাস দেই, সাথে মুক্তমনায় একটি লেখা। আজ সকালে ফেসবুকে ঢুকে দেখি, আমার ‘ফেসবুক মেইলে’ ‘টেম্পরারি মেইল এড্রেস’ থেকে একটা মেইল আসে, ‘পিপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে'।

থানায় যেয়ে সকালে জিডি করে আসি।’

ধর্র্মীয় উগ্রপন্থীরা যখন বৌদ্ধ মন্দির আক্রমণ করে, তখন কিছু সংখ্যক স্থানীয় তরুণ সেটি রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন। তার গল্পই পড়ুন এখানে[ইংরেজি]।

সর্বশেষ: পুলিশ জানিয়েছে যে অপরাধীদের অনেককেই সনাক্ত করা গেছে এবং এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত হামলা। ফেসবুকে কোরান অবমাননাকারী ছবিটি প্রিন্ট করে ছড়িয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন লোকের কাছে – রাগ উৎপাদনের জন্যেসএবং ১০টি ট্রাক ভাড়া করা হয় দুর দুরান্ত থেকে লোক আনার জন্যে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .