বাংলাদেশ: বিশ্ব বাঘ দিবসে সুন্দরবন রক্ষার ডাক

সারা বিশ্বে বন্য বাঘের সংখ্যা এখন মাত্র ৩২০০ তে নেমে এসেছে। তাদের রক্ষা এবং এ বিষয়ে সচেতনতা আনার জন্যে বাঘ রয়েছে বিশ্বের এমন ১৩টি দেশ বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম ও রাশিয়ায় প্রতিবছর ২৯ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। এ বছর বাংলাদেশে দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- বাঘের আবাসস্থল সুন্দরবন বাঁচান।

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের প্রধান আবাসস্থল সুন্দরবন। কিন্তু নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও সুন্দরবনে বাঘের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনে শিকারিদের হানা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন কারণে ৬৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ২০ বছরে ৩৩টি এবং ২০০১ থেকে ২০১১ সালের জুলাই পর্যন্ত ১১ বছরে ৩২টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে এসেছিল বাঘটি। তিনজন গ্রামবাসীকে আক্রমণ করে নিজেও নিহত হয় মানুষের হাতে। ছবি শেখ মহির উদ্দিন। স্বত্ব ডেমোটিক্স।

বাঘের মৃত্যুর কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন: শিকারিদের জালে আটকে, বনদস্যুদের গুলিতে, প্রাকৃতিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবের কারণে বনত্যাগী এসব রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আর বনে ফেরা হয় না। বন সংলগ্ন লোকালয়েই ঘটছে তাদের মর্মান্তিক মৃত্যু। একটা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যাভাব, বয়সজনিত কারণ এবং চোরা শিকারিদের হাতে গড়ে তিনটি করে বাঘ মারা যাচ্ছে সুন্দরবনে। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তায় চালিত বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি। এর মধ্যে পুরুষ বাঘ ১২১টি, বাঘিনী ২৯৮টি এবং বাঘ শাবকের সংখ্যা ছিল ২১টি।

বাঘের মৃত্যুস্রোত থামাতে ইতোমধ্যে, ‘ন্যাশনাল টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম’ (এনটিআরপি) প্রণয়ন ও ২০০৯-২০১৭ বাঘ সংরক্ষণ কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাঘ ও হরিণ শিকার বন্ধে অধিকতর শাস্তির বিধান রেখে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইন ২০১২ করা হয়েছে।

এদিকে ২০০৮ সাল থেকে চলতি ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাঘের হামলায় ১৪০ জন জেলে, বাওয়ালী, মৌয়াল মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৩২ জন। বিশ্ব বাঘ দিবসে বিডিনিউজ২৪ব্লগের ব্লগার মেফতু ওইদিনই তার গ্রামে বাঘের আক্রমণে নিহত হওয়ার কথা জানান।

মানুষ কর্তৃক বাঘ মারার কারণ হিসেবে ব্লগার আইরিন সুলতানা জানান:

বাঘ মেরে ফেলে কেবল চামড়া বেচলেও কড়কড়ে নোটের নগদ ‘১৫ লাখ টাকা’ কামিয়ে নেওয়া যায়। বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে রমরমা ব্যবসা রয়েছে বাঘের চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের। সবচেয়ে বড় বাজারটি নিয়ন্ত্রণ করে চীনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধশিল্প। এভাবে শিকারি বাঘ নিজেই শিকারে পরিণত।

সুন্দরবন বাংলাদেশের মোট সংরক্ষিত বনভূমির ৪১ ভাগ জায়গা জুড়ে অবস্থিত। ৪৫৩ প্রজাতির প্রাণীসহ অনেক বিপন্ন প্রজাতির আবাসস্থল সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যের এক বিপুল সম্ভার। জীববৈচিত্র্য ছাড়াও প্রাকৃতিক দূর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে সুন্দরবন উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদান করছে। আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনায় সুন্দরবনের অংশ বিশেষকে ১৯৯২ সালের ২১ মে ‘রামসার এলাকা’ (Ramsar Site) ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো সুন্দরবনকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। সুন্দরবনই হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র  আবাসস্থল। কিন্তু নানা কারণে সুন্দরবনের আয়তন কমছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। ২০০ বছর আগেও সুন্দরবনের আয়তন ছিল প্রায় ১৬,৭০০ বর্গ কিলোমিটার। সে সুন্দরবনের আয়তন এখন প্রায় এক তৃতীয়াংশ। তাই এবারের বাঘ দিবসে সবার কণ্ঠেই ছিল সুন্দরবন রক্ষার আহবান। আর সবার মুখেই ছিল সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিরোধীতা। বাংলাদেশ সরকার, সুন্দরবনের কাছে রামপালে ভারতের সাথে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করেছে

সুন্দরবন বাঁচাও, পরিবেশ বাঁচাও

সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিবাদে মানববন্ধন। ছবি ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ব ডেমোটিক্স

ব্লগার দিনমজুর জানান প্রস্তাবিত এই বিদ্যুত কেন্দ্র সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে:

পরিবেশ দূষণ, লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তন, বন কেটে ধ্বংস করা ইত্যাদি নানান কারণেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে। প্রস্তাবিত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি থেকে সুন্দর বনের দূরত্ব মাত্র ৯ কিমি। ফলে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে বায়ু-পানি-কঠিন-তরল যত ধরণের দূষণ ঘটতে পারে তার সবটুকুই সরাসরি সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

ব্লগার কামরুল হাসানও এর পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করেন:

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে পরিমানে কোল ডাস্ট বা কয়লা ধুলোর সৃষ্টি হবে তা সুন্দরবনের বাতাসে মিশে জীব বৈচিত্র্যে উপর মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। কার্বন নিস্রনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বাতাসে সীসার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ফলে কম সহনশীল প্রাণী টিকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে।

এদিকে টিআইবি'র একটি লেখায় প্রধান বন সংরক্ষক স্বাক্ষরিত এক পত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এবং উন্মুক্ত এলাকায় এ কয়লাভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হলে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে।”

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .