আফ্রিকা: আন্তর্জাতিক সমকামীতা ও লিঙ্গ পরিবর্তন ভীতি প্রতিরোধ দিবস আফ্রিকায় এসেছে

আন্তর্জাতিক সমকামীতা ও লিঙ্গ পরিবর্তন ভীতি প্রতিরোধ দিবস (ইন্টারন্যানশনাল ডে এগেইনস্ট হোমোফোবিয়া এন্ড ট্রান্সফোবিয়া বা সংক্ষেপে আইডিএএইচও) এমন একটি দিন যাকে লোকজন চিহ্নিত করে সমকামীতা ভীতি প্রতিরোধের জন্য একসাথে কথা বলার দিন হিসেবে। এটি কার্যকর এবং ফলাফল পরিবর্তনের উপর মনোযোগ প্রদান করে, কি ভাবে জনতা সমকামীতা ও সাম্যতাকে গ্রহণ করে; এমন এক উপায়ে, যেখানে সমকামীতাকে সহজে গ্রহণ এবং শ্রদ্ধা করা হবে ও তাদের কিছু অধিকার থাকবে এবং অন্য সব নাগরিকদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে তারা নিরাপদে ভ্রমণ করবে, আর কেউ তাদের ক্ষতি করবে না। প্রতি বছরের ১৭ মে এই দিনটি পালন করা হয়।

আইডিএএইচও সেই সমস্ত এলাকার কথা উল্লেখ করে, যেখানে সমকামী ভীতি বাড়ছে। এ বছর এই বিষয়ে আফ্রিকার তিনটি দেশের উপর মনোযোগ প্রদান করা হয়েছে: দেশগুলো হচ্ছে কেনিয়া, উগান্ডা এবং মালাউই:

১৭ মে- আন্তর্জাতিক সমকামীতা ভীতি প্রতিরোধ দিবস (আইডিএএইচও)- এটি এমন একটি দিন যখন ভালো ইচ্ছা শক্তির অধিকারী মানুষেরা বিশ্বের মনোযোগ পুরুষ সমকামীতা প্রতিরোধ নামক বৈষম্যমূলক সমস্যা ও তাদের উপর সংঘটিত আক্রমণের উপর প্রদান করে এবং সেই সমস্ত এলাকার কথা উল্লেখ করে, যেখানে মহিলা ও পুরুষ সমকামী, উভয় লিঙ্গ এবং লিঙ্গ পরিবর্তনকারী (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার বা এলজিবিটি সম্প্রদায়) মানুষেরা সবচেয়ে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে থাকে।

এ বছর আইডিএএইচও আফ্রিকার তিনটি দেশের উপর মনোযোগ প্রদান করেছে-
দেশগুলো হচ্ছে উগান্ডা, কেনিয়া এবং মালাউই। বেশিরভাগ আমেরিকানদের কাছে আফ্রিকা অনেক দুরের মহাদেশ মনে হতে পারে, কিন্তু পুরুষ সমকামীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যে ঘৃণা সরবরাহ করা হয় তা, তা অন্তত আফ্রিকার একটি দেশে আইনগত ভাবে পুরুষ সমকামীতা প্রতিরোধ প্রচারণার ব্যাপারে পর্দার পেছনে যে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে তার পেছনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে দেশটির নাম উগান্ডা। তবে পুরুষ সমকামীতা প্রতিরোধ নামক ঘৃণা এখানে আমেরিকার মিশনারীরা (ইভানজেলিক মিশনারী) উগড়ে দিচ্ছে এবং বিদেশের মিশনারীরা খুব সাধারণভাবে কেবল আরো বেশি এ ধরনের ঘৃণা ছাড়ানোর “দায়িত্বে” নিয়োজিত, যা আফ্রিকার পুরুষ সমকামীদের বিরুদ্ধে উন্মত্ত জনতার আক্রমণের শেকড়ে প্রথিত।

অভিযোগের খানিকটা অংশ ধর্মীয় যাজকদের উপর বর্তায়, যেখানে চার্চের প্রতি অভিযোগ রয়েছে, তারা সমকামীতা ভীতির ক্ষেত্রে অর্থ সাহায্য, প্রচারণা এবং সমকামীদের প্রতি ঘৃণা বিস্তারে সহায়তা করছে। রেভারেন্ড রোউল্যান্ড জাইড, যিনি একজন নাইজেরিয়ান ও হাউজ অফ রেইনবোর (খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের একটি চার্চ, যারা সমকামীতাকে স্বীকার করে নিয়েছে) একজন ভিন্নমতাবলম্বী যাজক, তিনি বলেন:

সারা বিশ্বে, লিঙ্গ পরিবর্তনকারী এবং সমকামীতা ভীতির ফলে তাদের উপর যে আক্রমণ ঘটে, রক্ষণশীল মানুষেরা তার আয়োজন করে থাকে। যারা তাদের কাজটিকে বৈধতা দেবার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে থাকে। এটা বিশেষ কোন ধর্মের বিশেষ অধিকার নয় এবং এই সব ব্যক্তিদের উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ার উদাহারণ ক্যাথলিক, প্রটেস্ট্যান্ট, অর্থোডক্স, মুসলমান, ইহুদি, হিন্দু, প্রকৃতি পূজক ইত্যাদি.. সব ধর্মের প্রেক্ষাপটে বিরাজমান। ধর্মীয় দল এবং বিশ্বাসীদের মাঝে আক্রমণ, বাধা প্রদান, ঘৃণা এবং বৈষম্যের এক পরিবেশের দিকে ঠেলে দেওয়া, যে আক্রমণাত্মক মনোভাব পরোক্ষভাবে অনেক অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক লোকজনকে প্রভাবিত করে এবং তাদের এমন মতামত প্রদানের দিকে নিয়ে যায় এবং মহিলা সমকামী, পুরুষ সমকামী এবং উভয়লিঙ্গ এবং লিঙ্গ পরিবর্তনকারী ও দ্বৈতলিঙ্গ (যার মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান) { লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার ও ইন্টারসেক্স বা এলজিবিটিআই} নাগরিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তার অধিকার ও অনেক সময় জীবন পর্যন্ত নিয়ে নেয়। অতীতের কোন ঘটনার অনেক বাইরে এই ধর্মীয় আক্রমণ, অনেক বেশি ধারাবাহিক এবং অনেক সময় অনেক দেশের জন্য বাড়তে থাকা এক বাস্তবতা। রক্ষণশীল ধর্মীয় অধিকার, তার আক্রমণ তত্ত্বের মাধ্যমে নির্দেশনা তৈরি করে এবং একই সাথে তা রাজনৈতিক জগতে এক বাঁধার সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি এই ঘটনা কেনিয়া, উগান্ডা এবং মালাউই-কে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে:

কেনিয়াকেনিয়ার একজন পুরুষ সমকামী এক্টিভিস্ট ডেনিস নিজিওকা তার কালারফুল লাইফ অফ এ গে কেনিয়ান ব্লগে প্রথম লেখাটি পোস্ট করেন। কি ভাবে একদল উন্মত্ত জনতা কেনিয়ার মোম্বাসায় পুরুষ সমকামীদের উপর আক্রমণ চালায়, তার লেখায় তিনি সেই ঘটনা তুলে ধরেন:

১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবারে, মোম্বাসা থেকে খবর আসতে শুরু করে, উন্মত্ত একদল লোক মটওয়াপার উপশহরে পুরুষ সমকামীদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। নানাবিধ যুক্ততার মধ্যে দিয়ে কয়েকজন পুরুষ সমকামী এই আক্রমণের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়। কেনিয়ার মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া এই বিষয়ে যোগাযোগ শুরু করেছে। নাইরোবি এবং মোম্বাসার নানাবিধ খেলোয়াড়দের সাথে যুক্ত হয়ে কেনিয়ার মানবাধিকার কমিশন বা কেএইচআরসি সিদ্ধান্ত নেয় কেএইচআরসির (কেনিয়ান হিউম্যান রাইট কমিশন বা কেনিয়ার মানবাধিকার সংস্থা) লূক** এবং মার্ককে** পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয় । নিচে পেমা কেনিয়ার জেমস** ও স্টে এলাইভ এক্টিভিস্ট -এর জনের** পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে বিস্তারিত এক লেখা রয়েছে, যারা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে প্রতিক্রিয়া প্রদান করেছে এবং যাদের সদস্যরা মটওয়াপার হঠাৎ আক্রমণের ফলে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পেছনের কাহিনী:
কি ভাবে দুজন পুরুষ সমকামীর বিবাহের গুজব ছড়াতে শুরু হয় তার বিভিন্ন সংস্করণ রয়েছে এবং এই বিষয়ে এখনো তদন্তের প্রয়োজন, কোথা থেকে এই গুজবের শুরু। ধারণা করা হচ্ছে, ইচ্ছাকৃতভাবে এই গুজব ছড়ান হয়েছে।

উগান্ডা

উগান্ডার সংসদ এমন আইন তৈরির জন্য তৈরি হচ্ছে যাতে সমকামী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান বা যাবজ্জীবন কারাবাসের মত শাস্তি প্রদান করা যেতে পারে। এই খসড়া আইনের বর্তমান পর্যায়: পুরুষ সমকামীতা প্রতিরোধে খসড়া আইন তৈরি: সংসদদের সংশোধনের মাধ্যমে এই খসড়া আইনকে পুরোপুরি আইনে পরিণত করা; রাষ্ট্রপতি এই খসড়া আইনটিকে আটকে রেখেছে এবং আরো ঘৃণা তৈরি করার জন্য চার্চে পুরুষ সমকামীদের পর্ণ ছবি প্রদর্শন করছে

উগান্ডার পুরুষ সমকামীতা প্রতিরোধ খসড়া আইন এখন সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তা রাষ্ট্রপতি ইয়োরি মুসাভেনির স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে, যার মধ্যে দিয়ে সরকারিভাবে সমকামীতা অবৈধ বলে গণ্য হবে। এর আগের আইন/ধারাটি পরিষ্কার ছিল না, কিন্তু এখন এখন এই খসড়া আইনটিকে বলা হচ্ছে“ সমকামীতা প্রতিরোধ খসড়া আইন ২০০৯”, যা ডেভিড বাহাতি নামক এক সংসদ সদস্যর সভাপতিত্বে খসড়া করা হয়েছে, যিনি বলেছেন, যে কোন ধরনের সমকামী কর্মকাণ্ড অথবা এ পথে আগানো ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে।

মালাউই

এক বাগদান (বিয়ের চুক্তি) অনুষ্ঠান শেষে এক পুরুষ সমকামী জুটিকে গ্রেফতার করা হয়েছে:

মালাউইর এক আদালত টিওয়াংগে চিমবালাংগা ও স্টিভেন মনজেজাকে আগামী মাসে গ্রস ইনডিসেন্সির (এমন এক যৌন কর্ম যা সাধারণ ভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর্যায়ে পড়ে না, কিন্তু দৃশ্যত নিষ্পাপ সম্পর্কের চেয়ে বেশি, শারিরীক আকর্ষণ এবং আলিঙ্গন ইত্যাদি এর মধ্যে পড়ে) অভিযোগে শাস্তি প্রদান করবে। চিমবালাংগা যাকে একজন মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং তার সঙ্গী মোনজেজা সহ তাকে গত ডিসেম্বর মাসে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তারা নিজেদের জন্য ঐতিহ্যবাহী এক বাগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। শাস্তি হিসেবে এই জুটির ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে।

রেভারেন্ড জাইড আন্তর্জাতিক সমকামীতা ভীতি প্রতিরোধ দিবসের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লিখেছেন এভাবে:

আন্তর্জাতিক সমকামীতা এবং লিঙ্গ ভীতি প্রতিরোধ দিবস যে মূল্যবোধ যোগ করে তার যৌক্তিকতা এই বিষয়ে কণ্ঠস্বর তুলে ধরার কৌশল নির্ধারন করে:
-প্রচার মাধ্যমে এটি ভালো এক মনোযোগ আকর্ষণ লাভ করে এবং একটি কৌতূহল জনক মুহূর্ত প্রদান করে, যাতে তা জনতার সমানে উপস্থাপন করা যায় এবং প্রচার মাধ্যমে এ বিষয়ে কথা বলা শুরু হয়।
-এটা একটা ভালো সুযোগ, নীতি নির্ধারকদের রাজনৈতিক মনোযোগ প্রদানের জন্য অনুরোধ করা যায়।
– এটা মূলধারার সামাজিক প্রতিষ্ঠানে মনোযোগ আকর্ষণ তৈরি করে এবং সংবিধানের বাইরে বার্তা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে যা এলজিবিটি/মানবাধিকার সংস্থার বাইরের “প্রচলিত” অংশ। এটা হয়ত এভাবে এলজিবিটি বিষয়ে জনতার মাঝে প্রচারণা সম্ভবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে, যার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিশেষ ভ্রাম্যমান এলাকা (মোবাইলস্টেশন) অর্ন্তভুক্ত।
-যদিও এর সাধারণ মনোযোগ থাকে এই একটি বিশেষ দিনকে ঘিরে, তবে তা যৌথ উদ্যেগের প্রয়োজনকে অর্ন্তভুক্ত করে নেয়। এটি একটি বিশেষ কারণে, সারা বছরে এক জোট গড়ার ব্যাপারে সাহায্য করে।

প্রস্তাব করা হয়েছে, ২০১০ ও ২০১১ সালের আন্তর্জাতিক সমকামীতা ও লিঙ্গ পরিবর্তন ভীতি প্রতিরোধ দিবস, এই বিষয়ে প্রচারণা মুহূর্ত তৈরির কাজে ব্যবহার করা হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .