থাইল্যান্ড: ব্লগাররা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রমাণাদি সংগ্রহ করেছে

২১ জন নিহত, ৮৫৮ জন আহত

গতকাল (১০ এপ্রিল) থাইল্যান্ডে রেড শার্ট নামক বিক্ষোভকারীদের সাথে সৈনিকদের যে সংঘর্ষ ঘটে তার ফলে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইতোমধ্যে এক মাস ধরে রেড শার্টরা রাস্তায় প্রতিবাদ করে আসছে। তারা প্রধানমন্ত্রী অভিশিৎ ভেজ্জাজিভার পদত্যাগ, সংসদ বাতিল করা এবং নতুন নির্বাচনের দাবী জানায়।

পহান ফা সেতুর কাছে প্রতিবাদকারী ও সৈনিকদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ছবি টনি জোহ প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ করেছেন।

এই রক্তাক্ত ঘটনা সম্বন্ধে টনির বিস্তারিত বর্ণনা:

দিনের শুরুতে সেনারা পহান ফা সেতুর কাছে তাদের রাস্তা তৈরি করে নেয় এবং প্রতিবাদকারীদের পেছনে সরে যেতে বাধ্য করে, সেদিনই সন্ধ্যায় প্রতিবাদকারীরা সিদ্ধান্ত নেয় তারা শক্তিশালী ভাবে ফিরে আসবে।

প্রথমদিকে পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে শান্তই ছিল, সেনারা সে সময় নরম, মন প্রশান্ত করা সঙ্গীত বাজিয়ে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ করে রাখার চেষ্টা করছিল। তবে সেকেন্ডের মধ্যে সবকিছু পাল্টে যায়, যখন গুলি গর্জে ওঠে এবং জনতা প্লাস্টিকের বোতল ও বাঁশের লাঠি নিয়ে তাদের আক্রমণ করে।

সেনারা সংখ্যায় অল্প ছিল, তার সম্ভবত অনুভব করেছিল যে তারা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তখন তারা জনতার উপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। যখন স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি বর্ষণের শব্দ প্রতিবাদ করার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তখন লোকজন দৌঁড়াতে থাকে এবং আশ্রয় খুঁজতে থাকে। শীঘ্রই প্রতিবাদকারীরা এমনকি প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে তুলে নেয় এবং হঠাৎ সেনাদের গায়ে অবরোধের জন্য রাখা পাথর ও মলোটোভ ককটেল (পেট্রোল বোমা নামে পরিচিতি এই বোম রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটোভ দ্বারা তৈরি বোতলের ভেতর পেট্রোল ভরে বানানো সাধারণ বোমা) পড়তে থাকে।

এই পর্যায়ে সামরিক বাহিনী নিজেদের অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ট্যাঙ্ক ও আরমার্ড পারসোনেল ক্যারিয়ার (বিশেষ সাঁজোয়া যান) যা রেড শার্টদের দ্বারা ঘেরাও হয়েছিল সেগুলো সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়।

নির্মল ঘোষ এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী:

সেনারা বিচিত্র কারণে এমন এক গান শোনাচ্ছিল যা ৭০ দশকের হিট ডিস্কো সঙ্গীত, যা প্রতিবাদের মেজাজকে হালকা করার প্রচেষ্টা। যখন আমি সেখানে গেলাম তখন তারা বনি এম নামক ব্যান্ড দলের “রাসপুটিন” নামক গানটি বাজাচ্ছিল। রেড শার্ট ও সামরিক বাহিনীর প্রধান মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এক শান্তি চুক্তি করেছিল।

কিন্তু রেড শার্টরা রাটচাপরাসং ও রাজাদামনোয়েন এলাকার উভয় জায়গায় তাদের অনুগামী প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা বিশাল আকারে বাড়িয়ে ফেলে এবং রাত নামার সাথে সাথে বোঝা যায় যে সামরিক বাহিনীর পক্ষে রাজাদামনোয়েন ও পান ফা এলাকাকে খালি করে ফেলা সম্ভব নয়, যা খারাপ দিকে গড়াতে পারে বলে মনে হচ্ছিল।

রাটচাপরাসং নামক এলাকা যা রেড শার্টদের মূল প্রতিবাদ কেন্দ্র ছিল তার মুড ছিল শান্ত এবং এমনকি তুলনামূলকভাবে উৎসবমুখর। কিন্তু – কাও সান নামক রাস্তার ডেমোক্রেসি মনুমেন্ট (গণতন্ত্র ভাস্কর্য) এর রাজাদামনোয়েন এলাকায় প্রতিবাদকারীরা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে এবং থেকে থেকে কিছু খণ্ড লড়াই চলে, সেনাবাহিনী পুরো পরিপূর্ণ নোংরা এক যুদ্ধে সরাসরি রেড শার্টদের উপর রবার ও সাধারণ বুলেট ছুঁড়তে শুরু করে।

খাও সান সড়ক যা পর্যটকদের ভীড়ে পূর্ণ থাকে সেখানেও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে:

জুরনোটোপিয়ার টুইটার ফিড অবশ্যই পড়া উচিত: “খাও সান পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা টানানো হয়েছিল। রেড শার্ট-এর দল সৈন্যদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। বেশ কয়েকটি রাস্তা রক্তে ভেসে গিয়েছিল….. পুনরায় প্রদান করা থাই সরকারে বিনয়ী প্রতিশ্রুতি শুনবেন না। খাও সান এখন বিপজ্জনক এক এলাকা। আমি দুজন পর্যটককে দেখেছি যারা আহত হয়েছে… খাও সান লিস উন্মুক্ত হয়ে গেছে, সব জায়গায় রেড শার্টদের দেখা যাচ্ছে। এটিকে দেখতে এখন এক যুদ্ধক্ষেত্রের মত লাগছে…..খাও সানের রাস্তাকে ঘিরে যুদ্ধ চলছে। পর্যটকরা লুকানোর জন্য আশ্রয় খুঁজছে। একে-৪৭ নামক অস্ত্র হাতে এক রেড শার্ট দাঁড়িয়ে আছে। খাও সানে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয়।পর্যটকরা বলছে, তারা সব ভয়াবহ ক্ষতবিক্ষত মানুষ দেখেছেন, তার মধ্যে এক বৃদ্ধ মানুষ ছিল, যার চোখ বের হয়ে ঝুলছিল”।

একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওর অংশ খাও সান সড়কের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি প্রদর্শন করছে ।

নিউ মান্দালার একজন পাঠক এই ইমেইলটি পাঠিয়েছে। এই সংবাদ সেনা ও প্রতিবাদকারীদের সংঘর্ষে সৃষ্টি হওয়া প্রভাবের কথা বর্ণনা করছে।

প্রতিবাদকারীদের দিকে হেঁটে যাবার সময়, আমি লক্ষ্য করলাম বাতাসে এক প্রতিরোধের অনুভূতি বিরাজ করছে, কিন্তু একই সাথে উদ্বিগ্নতা রয়েছে। যারা অন্য দিকে হেঁটে যাচ্ছিল, তাদের খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, তাদের অনেকের শরীর ময়লায় ঢেকে ছিল, যদি না দেহে কাটা বা ক্ষত চিহ্ন ছিল। এছাড়াও আমি খেয়াল করলাম এখানে সেখানে কিছু ব্যক্তি (এমনকি পুরো পরিবার, যাদের মধ্যে শিশুরাও অর্ন্তভুক্ত ছিল) যারা দৃশ্যত পথে যেতে যেতে স্মারক হিসেবে পুলিশের কিছু শিরস্ত্রাণ (হেলমেট), দাঙ্গার সময় প্রতিরক্ষা বর্ম (রায়ট শিল্ড) এবং লাঠি (ব্যাটন) সংগ্রহ করছিল।

অতিরিক্ত আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার (ট্যাঙ্কের মত সাঁজোয়া যান)-এর একটি সারি রাস্তার এক পার্শ্বে অবস্থান করছিল। সব জায়গায় ঝাঁক বেঁধে শয়ে শয়ে রেড শার্টের লোকেরা উপস্থিত হয়েছিল, যারা আক্ষরিক অর্থে খালি হাতে তাদের ছিঁড়ে ফেলেছিল। মাঝে মাঝে তারা থামছিল, যাতে ব্যাংককের একটি মধ্যবিত্ত পরিবার সামনে এগিয়ে আসে এবং এপিসি (আর্মাড পার্সোনেল ক্যারিয়ার বা সাঁজোয়া যানের)-এর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারে, সম্ভবত তাদের সন্তানকে সবার উপরে তুলে ধরার চেষ্টা, যাতে ভালো ভাবে একটি ছবি তোলা যায় তার কারণে, আবার তীব্র ধ্বংসসাধন শুরু হবার ফলে বিষয়টি লম্বা সময় ধরে চলেনি।

সেখানে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে, তার প্রমাণ দেবার জন্য কারো ভিডিওর তথ্য উপস্থাপন করার দরকার নেই। রাস্তার পার্শ্বে থাকা দোকান- ঘরগুলোর দরজার সামনে রবার বুলেটে ঢাকা পড়ে রয়েছে।। রাস্তাগুলো নিজেরাই যেন কাচের মোজাইকে, পাথর ও অন্য ধ্বংসস্তুপে রূপান্তরিত হয়েছিল, এবং সেখানে রক্তও ছিল।

নিকোলাস ডে বিক্ষোভের সময় তার অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করছেন । এছাড়াও তিনি রেড শার্ট নামক প্রতিবাদকারীদের চরিত্রের পরিষ্কার ধারণা প্রদান করছেন।

সেখান বুলেট ভরা ছিল নাকি বন্দুক খালি ছিল, আমি তা জানি না। যদি বুলেট ভরা থাকে, তাহলে এমন সরু এলাকায় তা জনতার উপর ছোড়া তাদের উচিত হয় নি, যার ফলে অসংখ্য মানুষ মারা যেতে পারত। আমরা খুব বেশি দুর পিছনে যেতে পারিনি, এমনকি আমরা রাজাদামেরান সড়কে ফিরে যেতে পারিনি। লোকজন সেখান থেকে পেছনের দিকে ফিরে আসে এবং দাড়িয়ে থাকে, যদিও এর আগের চেয়ে তারা সামান্য নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নেয়। লোকজন বলছিল তাদের উপর ছোড়া বুলেটগুলো প্রকৃত বুলেট ছিল না। যে সমস্ত লোকজন সেখান থেকে একবারে নড়ছিল না, তারা হল রেড শার্ট এর প্রহরীরা, যারা তাদের প্রতিবন্ধকতার ঠিক সামনে অবস্থান নিয়ে ছিল। এই সমস্ত লোকেরা হয় একেবারে উন্মাদ অথবা প্রচণ্ড সুশৃঙ্খল. অথবা উভয়েই।

শেষ কয়েক ঘন্টার আমি কিছু বিষয়ে শিক্ষা লাভ করলাম। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কাঁদুনে গ্যাস খুব বাজে জিনিষ; আরেকটি বিষয় হচ্ছে সৈন্যদের রাজাদামনেরান সড়ক থেকে রেড শার্টদের বিতাড়িত করার জন্য এই জিনিস প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়েছিল।

ব্লগাররা ব্যাংককের এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বেশ কিছু ছবি পোস্ট করেছে। এই মুখোমুখি সংঘর্ষের সময় কিছু সৈনিককে প্রতিবাদকারীরা আটকে ফেলে। পরের দিন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

সংঘর্ষের এলাকায় ঘুরে এসে থাইল্যান্ড ট্রাবলস উপসংহার টানেন যে সৈনিকরা জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রকৃত বুলেট ছোড়েনি।

প্র্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন সেনারা কেবল আকাশের দিকে তাক করে সত্যিকারে বুলেট ছুঁড়ছিল তার এই দাবী সঠিক নয় এবং তা সম্ভবত এক ডাহা মিথ্যা। আরো একবার দেখা গেল যে থাই সেনাদের নেতৃত্ব দুর্বল, তারা দুর্বল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং তাদের প্রশিক্ষণও দুর্বল, যারা একটি নাগরিক অস্থিরতাকে প্রাণঘাতী আঘাত না করে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এই সেনারা প্রতিবাদকারীদের গুলি করার মত হামলা কি কারো আদেশের কারণে চালিয়েছে, নাকি ব্যাক্তিগত বিদ্বেষের কারণে তা ঘটিয়েছে, তা হয়ত কখনোই জানা যাবে না। তবে স্বল্প প্রশিক্ষিত এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত সেনাদল পাঠানো, যাদের এ রকম কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবার খুব সামান্যই অভিজ্ঞতা রয়েছে, এ রকম উত্তেজনাকর এবং কঠিন পরিস্থিতিতে সরাসরি গুলি করা আরো সমস্যাকে তৈরি করার নামান্তর।

থাই সরকারি কর্মকর্তারা চান প্রতিবাদকারীরা তাদের এই বিক্ষোভ শোভাযাত্রার সমাপ্তি টানুক যা দেশটির অর্থনীতির ক্ষতি করছে, বিশেষ করে পর্যটন খাতের। এই ভয়াবহ সংঘর্ষের কারণে রাজনৈতিক অচলাবস্থা মনে হচ্ছে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .