কিরগিজস্তান: ‘ধারণকৃত’ বিপ্লব

গত ৬ই এপ্রিল মধ্য এশিয়ার পাহাড়ি দেশ কিরগিজস্তানে ব্যপক গণবিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় যার ফলে অবশেষে সরকারের পতন ঘটে। বিক্ষোভকারীরা আঞ্চলিক প্রশাসকদের আটক করে এবং পুলিশ আর সেনা বিরোধী দলের পক্ষ নেয়, যার ফলে প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক বাকিয়েভ প্রায় সব সমর্থন হারান।

রায়ট রক্তশূন্য হয়নি- সাম্প্রতিক বিক্ষোভের ফলে প্রায় ৭৪ জন নিহত আর ৫০০ জনের বেশী আহত হয়েছেন। তাই আগের ২০০৫ সালের শান্তিপূর্ন ‘টিউলিপ বিপ্লব’ থেকে এটি বেশ আলাদা। তবে দুটি অভ্যুত্থানের মূল বিষয়টি আলাদা না। মাত্র পাঁচ বছর আগে, বাকিয়েভ এসেছিলেন আলা-তু স্কোয়ারে কিরগিজ রাজধানীর কেন্দ্রে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট আস্কার আকায়েভের পদত্যাগ দাবি করে। এবারে বাকিয়েভকে রাজধানী ছেড়ে পালাতে হয়েছে চিৎকার করা মানুষের ভিড়ের ভিতর দিয়ে যেটার নেতৃত্বে ছিল বিরোধী দলীয় নেতা রোজা ওতুনবায়েভা

কিরগিজস্তানের সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক বিভেদ। মানচিত্র উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে

কিরগিজস্তানের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিভেদ। মানচিত্র উইকিমিডিয়ার সৌজন্যে

বর্তমান বিদ্রোহের কারণ অনেক: উত্তর বনাম দক্ষিণের সংঘর্ষ ( বাকিয়েভ দক্ষিণের বাসিন্দা, বিদ্রোহীরা উত্তরে থাকে), দুর্নীতি আর দমন শীল সরকার (সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিরগিজ মানুষ সব ধরনের দমন দেখেছেন সংবাদপত্র বন্ধ হওয়া থেকে স্বাধীন সাংবাদিকদের হত্যা, রাশিয়ার বৃহৎ স্বার্থের খেলা, ওরতেগা ই গাসেতিয়ান ‘মানুষের বিদ্রোহ’ ইত্যাদি)। ২০১০ সালের কিরগিজ বিদ্রোহের যে কারণই থাকুক না কেন এটা মনে রাখা দরকার যে এটা খুবই বিশাল, ভয়ঙ্কর, রক্তাক্ত আর ভালোভাবে নথিভূক্ত ছিল।

নতুন মিডিয়ার ভূমিকা এইবারে সামান্য একটু পাল্টিয়েছে অন্যান্য দেশের নাটকীয় ঘটনার তুলনায় (যেমন মল্ডোভা বা ইরানের বিক্ষোভ)। ব্লগ আর টুইটার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার গুরুতর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়নি যেহেতু কিরগিজস্তানে ইন্টারনেট ব্যাবহারের হার কম (২০০৯ সালে জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ)। তবে নতুন মিডিয়া দ্রুত সকল প্রধান ঘটনা জানিয়েছে তালাস শহরের প্রাথমিক বিক্ষোভের পুরো বর্ণনা দিয়ে। বিশকেক শহরের ভাংচুর আর লুট যা এর পরে হয়েছে তারও বর্ণনা আছে। একই সাথে বিরোধী দল নতুন মিডিয়াকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর মানুষের মতামত বিক্ষোভকারীদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে। যেমন, বিরোধী নেতা রোজা ওতুনবায়েভা (টুইটারে @ওতুনবায়েভা) আঞ্চলিক সরকারের প্রধান হওয়ার সাথে সাথে তার টুইটারে অ্যাকাউন্ট নিবন্ধন করেছেন। আর প্রেসিডেন্ট বাকিয়েভের ছেলে ম্যাক্সিম একটি লাইভজার্নাল (কমিউনিটি ব্লগিং প্লাটফর্ম) অ্যাকাউন্ট খুলেছেন সরকার পক্ষীয় মতামত জানানোর জন্য।

গ্রেগরি আস্মোলভ জানিয়েছেন ‘সম্পাদক ২.০’ এর মত ‘সাংবাদিক ২.০’ রা খুব কার্যকর ছিলেন না কিরগিজ ঘটনা জানাতে। প্রবাসী ব্লগার, যারা অঞ্চলটি চেনেন, বিভিন্ন স্থান থেকে ছবি, ভিডিও আর টুইটারে স্বীকারোক্তি সংগ্রহ করেছেন সম্পূর্ণ পরিস্থিতি বোঝার জন্যে। এই অঞ্চলের সব থেকে বেশী তথ্য সম্বলিত দুইজন ব্লগার দেশের বাইরে ছিলেন: আমেরিকাতে থাকা ইয়েলেনা স্কোচিলো (এলজে ব্যবহারকারী মোরিরে) আর কাজাকিস্থানে অবস্থিত ভাচেস্লাভ ফিরসোভ (লর্ড ফেম)। তারা পেরেছেন সব থেকে বেশী ছবি, ভিডিও আর ঘটনাপ্রবাহ সংগ্রহ করতে।

সংবাদ জানানোতে আর একদল ‘বিজয়ী’ হচ্ছে স্থানীয় ব্লগ-পোর্টাল নাম্বা.কেজেড, ক্লুপ.কেজি, ইসিক্কুল্প্রেস.কেজি (আর এর সাথে ঐতিহ্যগত সংবাদ সাইট যেমন ইন্টারনিউজ.কেজি, নিউইউরেশিয়া.নেট আর ২৪.কেজি), ডিজেল.এল্কাট.কেজি ফোরাম আর শব্দহীন একটি ওয়েবক্যাম যেখানে আলা-তু স্কোয়ার দেখান হয়েছে (এর স্ক্রিনশট অনেক ব্লগার ধারণ করে দেখিয়েছেন)। যদিও টুইটার বার্তাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের উস্কানিতে আর একই খবরের পুর:প্রচার ছিল, টুইটার হ্যাশট্যাগ #ফ্রিকেজি (এই ঘটনা নিয়ে সব থেকে বেশী ব্যবহৃত হ্যাশট্যাগ), #বিশকেক, #কিরগিজস্তান আর #তালাস সম্ভব করেছে ইংরেজীভাষী পাঠকদেরও বুঝতে যে কি ঘটছে।

দেশব্যাপী ইন্টারনেট নিয়ে সমস্যা সত্ত্বেও (সরকারী বাহিনী বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় ওয়েবসাইট যেমন ‘আজাটেক’, ২৪.কেজি, ফেরঘানা.রু, বন্ধ করে দেন জানিয়েছেন এলজি ব্যবহারকারী সাবিনারাইনগোল্ড), ৬ আর ৭ই এপ্রিল তারিখের কিরগিজ বিদ্রোহ বেশ ভালোভাবে নথিভুক্ত হয়েছে ইন্টারনেটে। রেজিস্তান.নেট আন্দিজান গনণহত্যার সাথে এর তুলনা করে লিখেছেন:

কিরগিজস্তান থেকে বের হওয়া সকল তথ্য সব সময়ে বিশ্বাসযোগ্য না। এটা প্রায় পক্ষপাতদুষ্ট, বিভ্রান্তিকর আর পরস্পর বিরোধী হয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো আমাদেরকে কিরগিজস্তানের একটা চিত্র দিচ্ছে যেটা খেয়াল করা দরকার-কেবল এখন না, বরং আসছে মাস আর বছরে, যখন এইসব ঘটনা চিন্তা করে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো যে কি হয়েছিল।

যেহেতু অনেক তথ্য ছিল, তাই যেসব তথ্য আর কাগজ ব্লগাররা সংগ্রহ আর প্রকাশ করেছে তাতে ঘটনার নিয়মতান্ত্রিক একটা তালিকা প্রদানের প্রচেষ্টা ছিল।

এপ্রিল ৬, তালাস:

বিপ্লব ৬ই এপ্রিল কিরগিস্থানের উত্তর-পশ্চিমের তালাস শহরে শুরু হয়, যেখানে স্থানীয় মানুষ স্থানীয় প্রশাসনে আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘন্টা আগে একই জিনিষ হয় নারিয়ানে। পরের দিন, প্রায় সকল প্রাদেশিক রাজধানী বিরোধী দলের কবলে চলে যায় কেবল উত্তর কিরগিজস্তানের বিশকেক ছাড়া।

এপ্রিল ৭, বিশকেক ভাংচুর

সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ৭ই এপ্রিল বিশকেকে। বিরোধী দলের মিটিং সংঘর্ষে পরিণত হয়। যখন বিক্ষোভকারীরা (যারা কোনভাবে অস্ত্র জোগাড় করেছিল) প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে আক্রমণ শুরু করে পুলিশ বাহিনীকে পরাজিত করে, তখন প্রেসিডেন্টের গার্ডরা তাদের দিকে গুলি করা শুরু করে তাদের থামানোর উদ্দেশ্যে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন যে অন্তত ২০ জন গুলিতে নিহত হন (অন্যরা গ্রেনেড আর আগুনে মারা যান)।

পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি বিক্ষোভকারীদের থামানো আর তারা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। প্রেসিডেন্ট বাকিয়েভ তার প্লেনে অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। ৮ই এপ্রিল তারিখে তথ্য পাওয়া যায় যে তিনি ওশ (দেশের দক্ষিণ) এ নেমেছেন, আর জালালাবাদে তার গ্রামের দিকে গিয়েছেন। তিনি ক্ষমতার দাবি ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। এই পর্যন্ত ওশ অঞ্চল বিরোধী দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না। এখনো পরিষ্কার না যে বাকিয়েভের কি হবে।

এপ্রিল ৮, বিপ্লবের পরে

বিরোধী দল বিশকেক জিতে নেবার পরে, তারা আর একটা গুরুতর বিপদের সম্মুখীন হন: লুণ্ঠনকারী। বিভিন্ন ব্লগার (মাঝেমাঝে অস্ত্রসহ) লুণ্ঠনকারীদের উপস্থিতির কথা জানান। বিকালে এদেরকে থামান হয় নতুন প্রতিষ্ঠিত পুলিশ আর স্বেচ্ছাসেবী ব্রিগেড দ্বারা যাদের হাতে সাদা ব্যান্ডেজ ছিল। ব্লগের শেষ সংবাদ অনুসারে বিশকেকের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের পাশে মানুষের ছবি, জামিলা কুলোভা

বিশকেকের রাস্তার ছবিসহ ফ্লিকার সেট, ইয়েলেনা স্কোচিলো

বিশকেকের রাস্তার ভাঙ্গা জানালা, ভিয়াচেস্লাভ ফিরসোভ

বিশকেকের ছবি, ভালারি গিওরগিয়াদি

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .