হাইতি: কেন সকল গল্প এতিমদের নিয়ে ?

একমাস আগে সাত মাত্রার এক ভূমিকম্প দক্ষিণ হাইতির বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংস করে ফেলে। অনেকের কাছে হাইতির শিশু, বিশেষ করে এতিম শিশুরা এখন প্রধান ঘটনার ক্ষেত্রে অনেক চিন্তার এক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই বিষয়ে হাইতির কণ্ঠস্বর খুব সামান্য।

টেলিগ্রাফ২১ এই লম্বা ভিডিও সংবাদটি পোস্ট করেছে। ভূকম্পনের পরপরই এই ভিডিওটি ধারণ করা হয়। এই ভিডিওতে দুটি এতিমখানার ম্যানেজার বা ব্যবস্থাপকের সাক্ষাৎকার রয়েছে, যারা এই বিষয়ে কথা বলেছেন। তবে এই বিষয়ে উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে ভিন্ন। ২.৩০ মিনিটে হাইতির এক নামহীন স্থানে অবস্থিত এক এতিমখানার ম্যানেজার হাইতির শিশুদের উপর সবার আগ্রহ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছেন, বিশেষ করে এর আগে এদের নিয়ে তেমন একটি সবাই চিন্তা করত না। বিদেশী পরিবারগুলো এখনকার বাচ্চা দত্তক নিতে চাচ্ছে। এই ঘটনাটি প্রতিদিনকার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন “আমি এমনকি এক্ষেত্রে তেমন উত্তর প্রদান করি না”। সকলেই শুনুন, ভূমিকম্প পরবর্তী কোন অনুরোধ আমি গ্রহণ করতে রাজী নই।

লিডিস তার বিপরীত ভাবনার অধিকারী। তিনি ভিন্ন এক এলাকায় ৬০ জন শিশুর যত্ন নেন। তিনি দ্রুত এই সমস্ত শিশুদের নতুন এলাকায় স্থানান্তর করার জন্য আহ্বান জানান। তারা এমন এক শহরে বাস করেন যেখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দত্তক প্রদান করার বিষয়টির ঘাটতি রয়েছে, এমনকি বিপর্যয়ের আগেও পরিস্থিতি একই ছিল। “এখন এটি মানবিক একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে”। তিনি বলেন, “শিশুদের এখান থেকে নিয়ে যান। কাগজপত্রের বিষয়টি পরে দেখা যাবে”।

শিশুদের উপর সম্প্রতি মূলধারা বা এর বাইরের সবাই মনোযোগ প্রদান করেছে। চারদিকে প্রচারিত হওয়া আমেরিকান চার্চ গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার হবার ঘটনার পর থেকে এই মনোযোগ প্রদানের বিষয়টি বেড়ে যায়। গত সপ্তাহে হাইতি থেকে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে নিয়ে যাবার সময় ৩৩টি শিশুকে আটক করা হয়। এই বিষয়টি নিয়ে বড় আকারের বিতর্ক শুরু হয়েছে।

কনডিউসিভ, একটি দলগত ব্লগ, যারা ক্রমাগত আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেবার বিষয়ে বিতর্ক করে যাচ্ছে । তারা জানাচ্ছে, এর আগে বিভিন্ন বিপর্যয়ের সময় দ্রুততার সাথে শিশু দত্তক দেবার বিষয়টি ভুলভাবে পালন করা হয়েছে:

বিপর্যয়ের সময় শিশুদের সেই এলাকা থেকে সরিয়ে ফেলার বিষয়টি নতুন নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর অপারেশন বেবিলিফ্ট-এর মাধ্যমে ভিয়েতনামে এই বিষয়টি ঘটতে দেখেছি। সেখানে ১৯৭৫ সালে সায়গনের পতনের পর আমেরিকান সরকার দ্রুততার সাথে প্রায় ৩,০০০ টি শিশুকে তাদের মাতৃভূমি থেকে সরিয়ে নেয়। এরপর থেকে জন্মদাতা পিতামাতা এবং দত্তক নেওয়া বাবামার মধ্য বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা চলতে থাকে। জন্মদাতা পিতামাতা জানান, তারা কখনোই শিশুকে দত্তক দেননি। অন্যদিকে দত্তক নেওয়া বাবা-মা জানায়, তারা আইনি প্রক্রিয়ায় শিশুটিকে দত্তক নিয়েছেন। এখন হাইতির শিশুদের দ্রুত দত্তক নেবার ক্ষেত্রে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

একটি পোস্টের শিরোনাম; এতিম, এতিম, এতিম!, এখানে রেজিস্টরেসিজম ব্লগ আরো সুর্নিদিষ্ট করে বলছে:

মিশ্র সংস্কৃতি এবং আন্তঃবর্ণের শিশুদের দত্তক নেবার ক্ষেত্রে দত্তক নেওয়া বাবা-মায়ের কতজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টি থাকে? (উপরে সেই একই বাবামার কথা উল্লেখ করা হয়েছে [পোস্টটিতে] যারা কালো শিশুর চুলের যত্ন নেবার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে থাকে। এখন, যখন ভদ্রমহিলা একটা শিশুকে দত্তক নিচ্ছে, তখন কি মনে হয় যে তিনি বর্ণ বা সংস্কৃতির ভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করছে?)(এমনকি মানসিক আঘাতের বিষয়টি নিয়ে আমাকে শুরু করতে বলবেন না. আলোচনার জন্য এই বিষয়টি অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু এই বিষয়ে আমার মতামত হল, সাধারণ ব্যক্তিরা একটি মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত শিশুর যত্ন নেবার জন্য যথাযথভাবে তৈরি নয়।)

দত্তক প্রদান করা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন হাইতির বংশদ্ভূত নাগরিকদের এই সমস্ত এতিম শিশুদের দত্তক নিতে অনুরোধ করে না? যে সমস্ত ব্যক্তিরা এই বিষয়ে অভিজ্ঞ, যারা মানসিক আঘাতকে নিরাময় করতে সক্ষম?

এই পোস্ট আরো সৃষ্টিশীল এক সমাধান প্রদান করেছে।

এখানে একটা বিচিত্র চিন্তা রয়েছে: যদি এই সমস্ত শিশুদের দত্তক নেবার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়, কারণ যেহেতু তাদের বাবামা তাদের ভরণপোষণ করতে পারছে না, তা হলে আমরা পুরো পরিবারটিকে বিমানে করে হাইতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাই না কেন? যদি আমরা সত্যিকার অর্থে শিশুদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করি, তা হলে তাকে তার পরিবারের সাথে রেখে দেওয়াই সবচেয়ে উত্তম নয় কি? কিন্তু বিষয়টি অন্য যে সমস্ত পরিবার শিশু দত্তক নিতে চায়, তাদের চাওয়াকে পুরণ করে না। আপনি বুঝতে পারছেন, সেই সমস্ত পরিবার, যাদের ইচ্ছা অনাথ শিশুদের রক্ষা করবে।

হাইতির রেসটাভেস (অনেক সময় তাকে রেসটাভাক নামে জানা যায়) পদ্ধতি নতুন করে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে, যা একই সঙ্গে একটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমিকম্পের পূর্বে পোস্ট করা এক লেখায় রিপিটং আইল্যান্ড এই পদ্ধতি সম্বন্ধে বলেছিলে, “যে সমস্ত বাবা-মা তাদের সন্তানকে পালন করতে পারেন না, তারা সন্তানকে তাদের তুলনামূলক বিত্তশালী আত্মীয়ের কাছে অথবা কোন অচেনা পরিবারে বাস করতে পাঠায়, যেখানে তারা কাজের বিনিময়ে খাবার, আশ্রয় এবং শিক্ষা লাভ করতে পারে। এই বিষয়টি অনেকটা দাসত্বের সমান। ভদ্রমহিলা জাতি সংঘের এক তদন্ত কর্মকর্তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন, রেসটাভেস বিষয়ে তদন্ত করার জন্য যিনি গত বছর হাইতি ঘুরে দেখেন। তিনি বলেছিলেন:

……অন্য পরিবারে সন্তানকে পাঠানোর মত ব্যাপার হাইতিতে অনেক লম্বা সময় ধরে চলে আসছে। তবে, বর্তমানে যাদের টাকা দিয়ে এই কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়, তারা দেশটি শিশুর খোঁজে চষে বেড়ায়, যাতে সেই শিশুটিকে দেশের ভেতরে বা বাইরের কোন পরিবারের কাছে পাচার করে দিতে পারে। এই কাজটি শিশুর মৌলিক অধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

গত দুই সপ্তাহে হাইতিতে যে সমস্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিপর্যস্ত শিশুদের যত্নের নেওয়ার কাজের সাথে জড়িত তারা জানিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত দত্তক নেবার বিরোধী। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি এক বিবৃতি প্রদান করেছে। এটি করেছে সেই প্রতিষ্ঠানের শিশু নিরাপত্তা প্রদান বিভাগের এক কর্মকর্তা। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “হাইতির শিশুদের হাইতিতে থাকা পরিবারের সাথে যুক্ত করে রাখার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের জন্য সর্বশেষ যে উপায়টির কথা ভাবা হবে, তা হল তাদের দত্তক দিয়ে দেওয়া।

…..এটি এমন এক পরিস্থিতি, যখন কোন শিশুকে তার নিজস্ব এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে, সেক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কিছু নিয়ম পালন করত হবে: এই শিশুটির সাথে একজন থাকবে যে তার আত্মীয় বা সেই ব্যক্তিটি দত্তক নেওয়া পরিবারটিকে জানে। যদি সম্ভব হয় তা হলে শিশুটির সকল বৃত্তান্ত নিবন্ধন করতে হবে এবং তাদের পরিবারকে অবশ্য জানাতে হবে শিশুটিকে কোথায় পাঠানো হচ্ছে এবং কে তাকে দত্তক নিচ্ছে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে অনেক শিশুকে দত্তক দেবার সময় তার সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্য রাখা হয় না।

দাতা সংস্থা যার মধ্যে রয়েছে সেভ দি চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন এবং রেড ক্রস ডিজাস্টার ফান্ড (এই প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কোন সহযোগী কোন সংস্থা নয়)। তারা সবাই এক যৌথ বিবৃতিতে কোন শিশুকে এখান থেকে বাইরে পাঠানো বা দত্তক দেবার বিষয়টির বিরোধিতা করেছে। ইউনিসেফের ভাবনাও একই।

তা হলে বিতর্ক কোথায়? সীমান্তে কিছু শিশুকে আটকানো হয়। এই শিশুদের বাইরে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রটেস্টান চার্চ এডাপটেশন গ্রুপ যুক্ত ছিল। তাদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেবার কথা বলে, যার মানে তারা তাদের নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে। অন্য সব ধর্ম প্রচারক খ্রীস্টান ব্লগ এ ব্যাপারে অনেক বেশ সতর্ক। ক্রিশ্চিয়ানিটি টুডে, খ্রীস্টান ধর্মমতের (সু-সমাচার বা ইভানজেলিক কনভিকশন) প্রতি বিশ্বাস তৈরি করার এক পত্রিকা” তারা দ্রুত আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেবার বিরোধিতা করেছে।

এই রকম এক দুর্ঘটনার ঠিক পরবর্তী মাসগুলোতে আমরা সেই সমস্ত এলাকা থেকে শিশুদের সরাতে চাই না, যেখানে পরিবারগুলো এখনো তাদের শিশুদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। ২০০৪ সালে সংঘটিত দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সুনামির পর সেখানকার অনেক ছোট শিশুর পরিচয় কার্যত জানা যাচ্ছিল না, এবং এখনো অনেক শিশুর পরিচয় জানা যায়নি। তবে পরিচয় জানার জন্য ডিএনএ পরীক্ষা এবং অন্য পদ্ধতিগুলোকে ধন্যবাদ, এর ফলে পরিবারগুলো তাদের হারিয়ে যাওয়া সদস্যদের ফিরে পেয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .