হাইতি: ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা

যত দুর জানা যায় হাইতির ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ভয়ংকর পরিসংখ্যানের উপর মনোযোগ প্রদান করা শুরু হয়েছে, কিন্তু খুব সামান্য কয়েকটি নাম এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আজ জনপ্রিয় ডোমিনিকান ব্লগার গুইলিয়ারমো পেনা নিশ্চিত করেছেন যে, এই ভূমিকম্পে তার পিতা গুইলিয়ামো পেনা সিনিয়র [পিতা পুত্রের নাম যখন এক হয়ে যায় , তখন পিতাকে সিনিয়র ও পুত্রকে জুনিয়র নামে ডাকে হয়], মারা গেছেন। সিনিয়র পেনা হাইতির রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সে সান্টো ডোমিঙ্গোর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান মেরা, মুনেজ এন্ড ফন্ডেয়ারে, প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করতেন। সিনিয়র পেনার একজন সহকর্মীও মারা গেছেন। সেখানে কর্মরত এক তৃতীয়াংশ লোক আহত হয়েছে, কিন্তু তাদের সফলভাবে সান্টো ডোমিঙ্গোর প্লাজা ডে লা সালুড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনেক ডোমিনিকান ও স্প্যানিশভাষী ব্লগার ইতোমধ্যে গুলিয়ামো পেনা জুনিয়রকে সান্ত্বনা প্রদান করেছে, যে তার চিন্তা টুইটারের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।

ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের লোকেরা ভূমিকম্পের পরবর্তী ঘটনাবলীকে অন্য ভাবে অনুভব করেছে। ডোমিনিকান ব্লগার জোসে সিলে টুইটারের মাধ্যমেও দাবি করেন যে ডোমিনিকান সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সেসফ্রন্ট হাইতির যে সমস্ত বাসিন্দা এ দেশে বাধ্য হয়ে ঢুকতে চাচ্ছে, তাদের প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে।

se jodio la vaina, confimado eso de que se perdio el control en la frontera por mi hermana que esta por esos lados

সবকিছু যেন প্যাঁচানো হচ্ছে। এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, সীমান্তে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। সেখান থেকে আসা আমার বোন এই তথ্য জানায়।

ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া লোকদের সীমান্ত পাড়ি দেবার ঘটনার সত্যতা এখনো নিশ্চিত নয়, তবে ডোমিনিকান সরকার ঘোষণা দিয়েছে যে সীমান্ত দিয়ে চলাচল আগের মতই স্বাভাবিক রয়েছে। বারাহোনার ডোমিনিকান হাসপাতাল এবং সামরিক বাহিনী পরিচালিত হাসপাতাল গুলো হাইতির ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা দেবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বাভারা এলাকার ভেরন-এ একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এলাকাটি এক জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। সান্টো ডোমিঙ্গোর প্রচার মাধ্যমের সূত্র অনুসারে একই এলাকার এক ইতালিয়ান বাসিন্দা এক হোটেলে চাঁদা সংগ্রহ কেন্দ্র খুলেছে। এই হোটেলের নাম লুনা ডেল কারিবে। এই পরিমাণ চাঁদা সীমান্ত এলাকার শহর জিমানিতে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সান্টো ডোমিঙ্গোতে অবস্থিত হাইতির দূতাবাস সংবাদ প্রকাশ করেছে যে, যারা সে দেশে যেতে চায়, তাদের জন্য দূতাবাস পরিবহণের ব্যবস্থা করবে।

হাইতির টেলিফোন ব্যবস্থা এখনো বিকল: তবে মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলো অনেক ভালো সেবা প্রদান করছে। সবচেয়ে বড় মোবাইল প্রতিষ্ঠানের নাম ভোইলা। সেটি ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তবে এই পরিস্থিতিতেও সেটি কার্যকর রয়েছে। ভোইলার মূল প্রতিষ্ঠান ট্রিলজি ইন্টারন্যাশনাল। এটি যুক্তরাষ্ট্রের, ওয়াশিংটনের সিয়াটল ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান।

ইডিসন ভলসিম, ফ্রান্সের ননতে -তে বাস করেন। তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে পোর্ট-অ-প্রিন্সে বাস করা তার মায়ের সাথে ভূমিকম্পের পরপরই কথা বলেছেন। তিনি স্থানীয় এক সংবাদ প্রকাশ করা টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন:

ইডিসন ভলসিম ওরফে ইভ:…. তিনি সুস্থ আছেন। যদিও তার পরিবারের বাকীদের কোন খবর নেই…। জানা গেছে কোন ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা কাজ করছে না। সকলেই পায়ে হেঁটে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। কাজেই অন্যদের সাথে যোগাযোগ করা সত্যি খুব কঠিন।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: এবং আপনার মা, তিনি কোথায়, এই সময় দ্বীপটির অবস্থা কেমন?

ইভ: সে নিজেই পোর্ট -অ-প্রিন্সে বাস করে। এটা ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: তিনি কি আপনাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন, সেখানে কি ঘটেছে?

ইভ: তিনি আমাকে বলেছেন তার ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল। এই বিষয়টি আমরা সব জায়গায় বলে বেড়াতে পারি না।
যখন ভূমিকম্প শুরু হয়, তিনি তখন একটা রেস্তোরাঁয় ছিলেন। কাজেই ভূমিকম্প শুরু হবার সাথে সাথে সেখানে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রেস্তওরাঁর মধ্য কিছু লোক মারা যায়, কারণ সেটি ভেঙ্গে পড়ে। তিনি কোন রকমে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।

এরপর থেকে.. বলতে পারেন, তারপর থেকেই লোকেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। বলা যায়, যাদের শরীরে কোন আঘাত লাগেনি, তাদের অবস্থাও ভয়াবহ হয়েছিল।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: আপনি কি উদ্বিগ্ন?

ইভ: হ্যাঁ, আমি আমার মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন-তবে তিনি সুস্থ আছেন। তার ক্ষেত্রে সবকিছু ঠিক আছে।

কিন্তু পরিবারের বাকী সদস্যদের ক্ষেত্রে….এই মুহূর্তে আমি জানি তারা কি অবস্থায় রয়েছে, আমরা তাদের সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানি না… আমরা তাদের খবরের জন্য অপেক্ষা করছি। তারা এই ভূমিকম্পের শিকার এবং অনেকে আহত হয়েছে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী: এবং মানসিক ভাবে কি আপনার মা ঠিক আছেন?

ইভ: ওহ মঙ্গলময়! তিনি তার জীবনের অনেক কিছু এবার দেখে ফেলেছেন, কিন্তু এখন তিনি ঠিক আছেন।

পোর্ট অ প্রিন্সের মাটিতে অনেকে নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন। ভূমিকম্প থেকে বেঁচে আসা জ্যঁ ফ্রঁসে লাবাডি এই বিপর্যয়ের স্মৃতি পুনরায় উদ্ধার করে মধ্যরাতের ধ্বংসযজ্ঞের কয়েক ঘণ্টা পরে, ভোরে পোস্ট করেছেন:

১৩/১/২০০১ ০০.২৫
প্রথম ভূমিকম্প, প্রচণ্ড ভাবে মাটি কেঁপে ওঠে।
১২.৩০ মধ্যরাত: আমরা প্রবল ভাবে প্রার্থনা করছি যে, এটাই শেষ মত ভূমিকম্প.. সত্যিকার অর্থে…মনে হচ্ছে এইবার সব শেষ হয়ে যাবে…
রাত প্রায় ৪.৪৫ মিনিটের সময়, গাড়িচালক সহ, আমরা পেতিও ভিয়া নামক বড় বাজার এলাকার কারিবিয়ান-এ প্রবেশ করলাম। এটি সেই বাজারে গাড়ি রাখার স্থান। বলাই বাহুল্য ডেলমাস-এর রাস্তার ভীড় আমাদের যাত্রার গতি ধীর করে দিয়েছিল। প্রবেশ করার সময় আমাদের গাড়ি ভূমিকম্পের চোটে নাচতে শুরু করে দেয়। আমি কল্পনা করছিলাম, তিন থেকে চারটি বালক বাম্পারের উপর বসে গাড়িটিকে দোলাতে চাইছে। আমাদের সামনে গাড়ি রাখার স্থানটি যেন ওয়াহু সমুদ্র উপকূলে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মত দুলছিল।
কারিবিয়ান ভবনটি নাচতে শূরু করে এবং ৩ সেকেন্ডের মাথায় হুড়মুড় করে পুরো ভেঙ্গে পড়ে। গাড়ি রাখার স্থানে একটা সাদা মেঘ এসে দাঁড়ায় এবং সেখানে জম্বি নামক ভূত ধুলোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয়, পুরো এক আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

যদিও এটা অনেকটা, ঘটনার আগে ঘটা এক বিষয় ছিল- যখন ধুলা অপসারিত তখন চারতলা ভবনের এই ধ্বংসস্তুপের ইঁট-সিমেন্ট বা কংক্রিটের ধ্বংসস্তুপ দেখে মনে হয়েছিল, এর ভেতরে বাসিন্দাদের কেউ জীবিত নেই। রাস্তায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকজন পাগলের মত ছোটাছুটি করছিল। সে সময় ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীদের একজন গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে তারা আমাদের পেছনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। গাড়ি চালক আমার চেয়ে দ্রুত পরিস্থিতির বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছিল যে ঘটনা কি ঘটতে যাচ্ছে, সে তার সর্বশক্তি দিয়ে প্রার্থনা করতে শুরু করল। সে জোর জোরে প্রার্থনার বাণী উচ্চারণ করতে শুরু করল, তার বাহু দু'টি আকাশের দিকে তুলে দিল। আমার কানের কাছ থেকে বেশ দুরের এই শব্দ আমাকে শান্ত করল। আমাদের চোখের সামনে যে উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়েছিল গাড়ি চালক তার এক অর্থ আমাদের সামনে তুলে ধরল। সবকিছু থেমে যাবার পাঁচ মিনিট পর কয়েকজন মোটর সাইকেল আরোহী গিয়ে ভবনের নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে জোর করে ১৫ ফুট উঁচু বেষ্টনী খুলে বাড়ির দিকে রওনা দিতে সক্ষম হয়। ডেলমাসকে দেখতে পুরোপুরি বিধ্বস্ত এবং বিস্ময়কর এক অঞ্চলের মত লাগছিল। আমরা ভেঙ্গে পড়া সব ভবনের মাঝ দিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালাতে সক্ষম হই। রাস্তায় লোকজন দৌঁড়াচ্ছিল, তারা যীশুর কাছে ফুঁপিয়ে এবং জোরে জোরে প্রার্থনা করছিল এবং এবং বাহু উপরে উঠিয়ে তাকে ডাকছিল। ধুলায় অনেকের চেহারা সাদা হয়ে গিয়েছিল, সবাই এক অবিশ্বাসের চোখে ঘটনাকে দেখছিল, এদের মধ্যে অনেক আহত লোক এবং মৃতদেহ বা এ রকম অনেক দেহ পড়েছিল…। জ্যঁ ক্লদ যাত্রার সময় পুরো শক্তির সাথে তার বিশ্বাসের উপর তৈরি করা গান গাইতে গাইতে থাকেন। আমার সহকর্মীদের উৎসাহী মনোভাব আমার নাস্তিকতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। এইসব দৃশ্য আমাদের যেন এক চলচ্চিত্রের দৃশ্য হয়ে হাজার বার চোখের সামনে ঘুরতে লাগলে। এমনকি আমি আমার শঙ্কা দুর করতে সক্ষম হলাম। তবে জেহান্নের কাছে ফিরে যেতে পারিনি। খেয়াল করলাম একতলার ভবনটি এই ভূমিকম্পের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এই ভূমিকম্পটি কত ভয়ানক ছিল তা বোঝার আগে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরব। শহরটির এই অংশে পরিস্থিতি অনেক উন্নত ছিল। আমরা সন্ধ্যায় সৃষ্টি হওয়া ভূমিকম্পের ফলে যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে দিয়ে প্রথম রাত কাটানোর জন্য প্রস্তুত হলাম। আমাদের ভূমির মালিক-নামক স্থাপত্যবিদের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে রাত কাটানোর জন্য তৈরি হলাম। পরে আবার কথা হবে।

সন্ধ্যায় খবর এল যে সাহায্যবাহী প্রথম বিমানটি হাইতির প্রধান বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

হাইতির ভূমিকম্প সম্বন্ধে জানার জন্য গ্লোবাল ভয়েসেস-এর বিশেষ পাতা এখানে রয়েছে।

সান্টো ডোমিঙ্গো থেকে রোসিও ডিয়াজ সংবাদ প্রেরণ করছে। ফরাসী ভাষা থেকে অনুবাদ করেছে সুজান্নে লেহন ও ক্যাথরিন গানলি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .