অবতার: আদিবাসী অধিকারের পক্ষে না বিপক্ষে?

জেমস ক্যামেরনের বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী সমৃদ্ধ ছবি অবতার (মুক্তি পেয়েছে ২০০৯-এ) একটি বৈজ্ঞানিক কল্প কাহিনী। এই চলচ্চিত্রে পৃথিবীর মানুষ অন্য এক গ্রহকে উপনিবেশ বানানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। এখন সারা বিশ্বে এই চলচ্চিত্রকে ব্যাপকভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, তবে অন্যরা এই চলচ্চিত্রকে ইতিহাসের প্রথম সবচেয়ে দ্রুত বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার আয় করা চলচ্চিত্র হিসেবে দেখছে। অনেকের কাছে এর উপাদানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সূক্ষ্ম বর্ণবাদী আচরণ রয়েছে।

টেলিগ্রাফের ব্লগার উইল হ্যাভেন সাধারণত যুক্তরাজ্যে রাজনীতি, ইন্টারনেট এবং ধর্ম নিয়ে লেখেন। তিনি এই চলচ্চিত্রে উপর অভিযোগ এনেছেন যে, এটি বর্ণবাদ এবং পশ্চিমা বাম ধারার উগ্রতা প্রদর্শন করছে:

আমি এর গল্পটাকে নষ্ট করতে চাই না, কিন্তু এখানে এর মূল বিষয়টি হচ্ছে: একদল ভাড়াটে সৈনিক, যারা আসলে মানুষ, তারা প্যান্ডেরা নামে পৃথিবী থেকে দুরের এক গ্রহকে উপনিবেশ বানাতে চায় কারণ সেখানে এক অতি মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। প্যান্ডোরার স্থানীয় বাসিন্দারা আকারে লম্বা, নীল চামড়ার এক ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী। এদের নাম না’ভি। তারা যে এলাকায় থাকে তার ঠিক উপরে খনির অবস্থান। না’ভিরা সেই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বাস করতে চায় না। কাজেই মানবজাতি তাদের উপর আক্রমণ চালায়।

[…]

অবতারের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবজ্ঞা যাকে ঘিরে চলে, সে এর নায়ক। এক অক্ষম তরুণ আমেরিকান, যার নাম সালী। চলচ্চিত্রে এই চরিত্রটিতে অভিনয় করেছে সাম ওরর্দিংটন। না’ভিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার আগে সালীকে তাদের কাছে পাঠানো হয় (নীল চামড়ার এক অবতার হিসেবে)। কূটনৈতিক ভাবে এই সমস্যা সমাধানের শেষ চেষ্টা হিসেবে তাকে সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সে তাদের দলের একজন হয়ে যায়। তাদের দুর্দশায়, সে তাদের প্রতি এতটা সহানুভূতিশীল হয় যে, মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দিতে থাকে।

যেমনটা বাম ধরার আত্ম দর্পী চিন্তা এগুতে থাকে, এটাই অন্য সব কিছু ছাড়িয়ে সবার উপরে অবস্থান নেয়। চলচ্চিত্র দেখায়, আদিবাসী না’ভি গোষ্ঠীর নিজেদের উদ্ধার করার জন্য একজন সাদা চামড়ার মানুষের দরকার হয়ে পড়ে, কারণ কম উন্নত প্রজাতি হিসেবে তাদের বুদ্ধিমত্তা ও বীরোচিত ধৈর্যের ঘাটতি রয়েছে। তাদের এই ঘাটতি দেখা দেয় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষেত্রে। অসহায় স্থানীয় আদিবাসী। অন্য কথায় বলা যায় তাদের অবশ্যই বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্য সাদা মানুষের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।

ফ্লোরিডা ভিত্তিক এক ব্লগার থিঙ্কিং ফর ইউ। তিনি এই বিষয়ে একমত:

আমাকে এটাই ধাক্কা দিয়েছে যে দর্শকদের অনেকেই শত্রু হিসেবে যুক্তরাষ্টের সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা এবং রঙ্গব্যঙ্গ মেনে নেয়। তারা আক্ষরিক অর্থে করতালির মাধ্যমে আক্রমণকারী বাহিনীর ধ্বংস সাধনকে অভিনন্দন জানায়, কিন্তু সম্ভবত এই রসিকতা আমার উপর করা হয়েছে, কারণ সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বকারীদের হারার ব্যাপারটা কেবল ধারণা মাত্র। এবং অবশিষ্ট অংশের সাথে দৃশ্যমান যে বাণী প্রদান করা হয়, তা হল প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির ভাগ্য, সঠিক কর্ম বা ন্যায়বিচারের উপর নির্ভর করে না। এমনকি ভেতরের শক্তি দিয়ে তাকে পাওয়া যায় না, তার বদলে এই ভাগ্য নির্ভর করে ইঙ্গ-মার্কিন ও পৌরুষের প্রতীক যুক্তরাষ্ট্রে মেরিন বা নৌসেনার হাতে। আপনি ঘাতক বাণিজ্যিক কোন প্রতিষ্ঠান অথবা নিরপরাধ নীল চামড়ার আদিবাসী যেই হন না কেন, ইঙ্গ-মার্কিন পুরুষ নৌসেনা ছাড়া আপনি যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারবেন না। সকল কিছুই এক ঘটনা মাত্র এবং প্রতিরোধ করার চেষ্টা বৃথা।

দি ফায়ার কালেকটিভ: ফাইট ইম্পেরিয়ালিজম, রিথিঙ্ক, এন্ড এক্সপেরিমেন্ট, নামক ব্লগে লেখেন এরিক রিবেলারসি। তিনি এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন:

আমি এই চলচ্চিত্রটিকে সূক্ষ্ম এবং সুন্দর এক চলচ্চিত্র হিসেবে আবিষ্কার করেছি, যা এক উচ্চমানের সাদা চামড়ার সৈনিকের গল্প বলে। সাম্রাজ্যবাদের এক পটভূমিতে এই সৈনিক এক আদিবাসী জাতিকে (না’ভিদের) শোষণ এবং দমন করতে যায়। কিন্তু এই জাতির সংস্পর্শে এসে নিজেই বদলে যায় এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করে।

আদিবাসী ব্লগার মিন্দানাওয়ান'স ন্যারেটিভস অবতার নামক চলচ্চিত্রটিকে দেখছেন যে কোন এক্টিভিস্টের “স্বপ্নের ছবি” হিসেবে। ভদ্রমহিলা তার মাতৃভূমি ফিলইপাইনসের মত সমস্যাকে তুলে ধরা চলচ্চিত্র হিসেবে একে দেখছেন:

এই চলচ্চিত্র মিন্দানাও-এর পশ্চাৎভূমির আদিবাসী এবং গ্রাম্য বাসিন্দারা যে সব সমস্যার মধ্যে বাস করছে তার এক প্রতিফলন। খনি খনন করা এবং অন্য সব ‘উন্নয়ন প্রকল্পের” সাথে সামরিকীকরণের এক সংযুক্ততা রয়েছে এবং মানব অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে; আদিবাসীদের দিয়ে আদিবাসীদের উৎখাত করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ভিত্তিক ব্লগ জর্ডান পস ব্লগ। এই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে:

না’ভিদের হিসেবের সাথে আদিবাসী আমেরিকানদের হিসেব মেলানো এক লজ্জাহীন এবং থুতু গিলে ফেলার মত বিষয়??। এর কারণ আমি মনে করি, তারা যে কোন কিছুকে ইন্ডিয়ান নামক আমেরিকান আদিবাসীদের বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার সাথে মেশাতে চায়, তার বদলে পুরো চলচ্চিত্রটি অরুচিকর এবং বিরক্তিকর। না’ভিরা এতটা সাধু এবং পৃথিবীর দমন এতটা শয়তানীপূর্ণ যে, তা দেখে আমার বমি চলে আসে। এটা গল্প বলা নয়। এটা ধর্মপ্রচার এবং এটা খুব খোঁড়া এক হিতোপদেশ।

আবিগাইল নুসবাউন ইজরায়েলে বাস করা এক ব্লগার যার ব্লগের নাম আসকিং দি রং কোশ্চেন। তিনি মনে করেন না যে, এই চলচ্চিত্রটি আদিবাসীদের আবেগপূর্ণ ভাবে তুলে ধরেছে:

যখন এই চলচ্চিত্রের প্রোডাকশান ডিজাইনার ব্যাখ্যা করেন যে, এই চলচ্চিত্রে নীল চামড়ার ভিন্ন প্রাণীর সৃষ্টির ধারণা অবচেতনভাবে চলচ্চিত্রকার মুক্ত করে দেন। একটা গল্প বলার ক্ষেত্রে এটাকে হয়তো বর্ণবাদী চিন্তাধারা মনে হতে পারে। যদি তা মানবের বেলায় বলা হয়ে থাকে, তা হলে যা বলা হয়েছে, তাতে কোন সমস্যা নেই। সেক্ষেত্রে এই বাস্তবতা সত্ত্বেও কোন সমস্যা নেই এই কারণে যে, এই ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীদের সাথে পরিচিত আমেরিকান আদিবাসীদের পার্থক্য কেবল নীল চামড়ায়। এক বিনীত ব্লগারের এর সাথে আর কি যুক্ত করার রয়েছে?

1 টি মন্তব্য

  • মন্তব্য গুলো পড়লাম। হলিউড মুভির পালকে আরো একটি উচ্চতর গ্রাফিক এনিমেশন এর সাফল্য যুক্ত হলো। ব্লগারদের কথার সাথেও আমি একমত যে আমেরিকানরা সবসময় নিজেদের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রকাশ করতে পছন্দ করে। যা তাদের জাতীয় চরিত্রের বহিপ্রকাশ।

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .