লেবানন: ডিমকে ভেঙে ফেল না!

ডিম, পানির ফোঁটা, বুদ্বুদ, গম্বুজ, এ সবই একটি ভবনের নাম… বৈরুত শহরের ঠিক মাঝখানে ডিমের মত চেহারা নিয়ে এই ভবন দাঁড়িয়ে আছে। তবে, উপরের সব নামে সে পরিচিত। এটি বৈরুত শহরের প্রথম দিককার এক প্রেক্ষাগৃহ যা পরবর্তীতে শহরের কেন্দ্রীয় এক বিপণী বিতানে পরিণত হয়েছে। এখন কিছুদিনের মধ্যে এই ভবন ধ্বংস করে ফেলা হবে। এর বদলে এখানে বৈরুত গেট নামে পরিচিত বিলাসবহুল উঁচু সব ভবন তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এই সংবাদ জানাচ্ছে বৈরুত স্পেসের মাইসা ফারেস।

eggবৈরুতের সোলজারার নামক কোম্পানীর এই জায়গা আবু ধাবি ইনভেস্টমেন্ট হাউস (এডিআইএইচ) নামক প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বৈরুত গেট প্রজেক্ট বা বৈরুতের বিলাসবহুল এক নির্মাণ পরিকল্পনার জন্য তারা এই জমি কিনে নেয়। এর উদ্দেশ্য বৈরুতের উপশহরকে নতুন করে সাজানো ও তাকে আধুনিক করা। এর আগেও বেশ কয়েক বার এগ বা ডিম নামে পরিচিত এই ভবনটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সালের যুদ্ধে এটাকে অস্থায়ী ভাবে বিনষ্ট হবার হাত রক্ষা করা হয়- এ রকম বেশ কয়েক বার তাকে রক্ষা করা হয়। যার সাক্ষী হিসেবে তার গায়ে কয়েকটি আঁচড়ের দাগ রয়েছে। এরপর আবার অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বর্তমানে এগ নামক ভবনটি তৎক্ষনাৎ এক হুমকির মুখে পড়ে গেছে; এবং অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা তার এই আসন্ন বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করতে চায়।

সে’ বেইরুথ-এর লুসি এই অন্যতম ভবন সম্পর্কে এভাবে বর্ণনা করছে [ফরাসী ভাষায়]:

…un bâtiment des plus noircis et des plus imposants : un ancien cinéma, de forme ovale, à moitié détruit. Il fait un peu tâche, au milieu des immeubles lisses et clairs, fruits du travail controversé de Solidere, société de reconstruction du centre-ville de Beyrouth. Conçu en 1965, il est appelé le Blob, le champignon, le Dôme, l’Oeuf… A l’intérieur, des cendres, des impacts de balles, et à l’étage, un grand écran blanc.
Son vrai nom est le «Dôme City Center ». Des expositions et performances y ont lieu. Menacé d’être détruit par des promoteurs en quête de profit, des pétitions et groupes se mobilisent pour sauver ce vestige de la guerre qui fait partie du paysage beyrouthin.

…এর বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে, তবে এটি এক আকর্ষণীয় ভবন: প্রাক্তন এক প্রেক্ষাগৃহ, যা অনেকটা ডিম্বাকার। এর অর্ধেক অংশ নষ্ট হয়ে গেছে, তারপরেও ভবনটি তার চিহ্ন বজায় রেখেছে। এর চারপাশ ঘিরে রেখেছে সুন্দর, পরিষ্কার সব ভবন। সোলজারার নামক প্রতিষ্ঠানের বিতর্কিত শ্রমের ফসল এই ভবন। বৈরুতের উপশহরের এক ভবন পুন:নির্মাণ কোম্পানী এই সোলজারার। ১৯৬৫ সালে এর নকশা তৈরি করা হয়। সে সময় একে তরল বিন্দুর ফোঁটা বা ব্লব, ব্যাঙের ছাতা, গম্বুজ, ডিম্ব ওরফে এগ ইত্যাদি নামে ডাকা হত… এর ভেতরে রয়ে গেছে ছাই, বুলেটের দ্বারা সৃষ্টি হওয়া গর্ত এবং উপরে বিশাল সাদা পর্দা।

এর প্রকৃত নাম ছিল “সিটি সেন্টার ডোম” বা শহরের কেন্দ্রীয় গম্বুজ। এক সময় এখানে বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হত। লাভের আশায় ভবন নির্মাতারা এটিকে ধ্বংস করে দেবার হুমকি প্রদান করতে থাকে। যুদ্ধের বীভৎসতা থেকে এর যেটুকু অংশ বেঁচে রয়েছে, সেটুকু রক্ষার জন্য বিভিন্ন দরখাস্ত প্রদান করা হয়েছে এবং এই ভবন রক্ষার জন্য অনেকে একত্রিত হয়েছে। তারা বলছে এটি বৈরুত শহরের পটভূমির এক অংশ।

এটি কেবল একটা ভবন নয়, এটি এক আত্মপরিচয়ের প্রতীক। এটি এমন এক ভবন যা বৈরুতের উপর তথাকথিত দুবাইয়ের মত সৌন্দর্য বর্ধন “দুবাইফিকেশনের” বিরুদ্ধে এক লড়াই। এই বিষয়টি ব্লগারদের মধ্য কিছু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে ২০০৬ সালে এই ভবনটি ধ্বংস করে ফেলার কথা ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে রাফাত মাজজুব ২০০৮ সালে আবেদন জানাচ্ছে:

ছোট্ট মানুষ। বড় মানুষ। মানুষ এবং পোষা সব প্রাণী। ৩০ সেকেন্ড আগে আমি যা প্রকাশ করেছি তা হল, বৈরুত শহরের কেন্দ্রীয় ভবন এক মাসের কম সময়ের মধ্যে ভেঙ্গে ফেলা হবে।

ছোট্ট মানুষ। বড় মানুষ। মানুষ এবং পোষা প্রাণী। এগ নামক ভবনটিকে রক্ষা করার জন্য এমন কোন সূক্ষ্ম বিষয় নেই, যা নিয়ে আমি ভাবতে পারি। প্রতিদ্বন্দ্বীতাহীন এমন বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। যে কোন প্রস্তাবনা, যে কোন কিছু বিবেচনা করা হবে। আমাকে বিশ্বাস করুন, এই ভবনকে রক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত যে কোন প্রস্তাব বিবেচ্য, যে ভাবেই হোক না কেন: যে কোন প্রস্তাব আমার কাছে পাঠান। আমি এখানে তা প্রকাশ করব। যদি তা ছাপানোর যোগ্য হয়, তা হলে আমি তা ছাপিয়ে দেব এবং চারদিকে ছড়িয়ে দেব।

ছোট্ট মানুষ। বড় মানুষ। মানুষ এবং পোষা প্রাণী। আমি কোন রসিকতা করছি না। সেখানে যান। এটার দিকে তাকান, নিরাপত্তা রক্ষীদের সাথে লড়াই করা, এক উত্তেজনার সৃষ্টি করা, আমরা উত্তেজনার দ্বারা সৃষ্টি ভেতরের উত্তাপকে বের করে দেবে (ফুউউ)<< এটাকে পছন্দ করেছি, ছোট্ট মানুষেরা। বড় মানুষেরা। মানুষ এবং পোষা প্রাণী। দেখুন এটা দেখতে কত সুন্দর !!!!!!!!!!!

এই ভবনটি যখন এক মাস পরেও টিকে গেছে, তখন রাফাত ভবিষ্যৎবাণী করেছে, এটা এখন নতুন এক হুমকির মুখে পড়ে গেছে।
ফ্লাকচুয়েট.নেট এই ভবনটি সম্বন্ধে বর্ণনা করছে, বৈরুতের কেন্দ্রে এ রকম যে সমস্ত ভবন তৈরি হয়েছিল এটি তার শেষ চিহ্ন

… L'œuf, sobriquet de l'ancien cinéma du centre-ville ruiné par les effets de la guerre civile, fait parti de ces bâtiments de caractère qui hantent encore le cœur de Beyrouth. En fait, c'est le dernier dans son genre au centre-ville, après que le projet urbain ait décidé de raser le souk Ayyas et les autres cinémas historiques. Aujourd'hui les étudiants…s'attachent à “The Egg” comme seul témoin architectural du passé tortueux oublié dans la nouvelle Beyrouth sauce Solidere.

প্রাক্তন এই প্রেক্ষাগৃহ যার নাম এগ, সেটি গৃহযুদ্ধের ফলে প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে। এটি এমন এক ভবনের চেহারা তৈরি করে যা বৈরুতের হৃদয়ে বাস করে। বাস্তবতা হচ্ছে এক সময় বৈরুতে এ ধরনের অনেক ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। শহর উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সউক আয়াস ও অন্য সব নাট্যকেন্দ্র ভবন ধ্বংস হবার ফলে সে সব ভবনের মধ্যে কেবল এটি টিকে রয়েছে। বর্তমানের ছাত্ররা অতীতের অত্যাচারিত এক স্থাপত্য হিসেবে এগকে দেখে, যা সোলজারার কোম্পানীর নতুন গন্ধ মাখা বৈরুতে কেবল ভুলে যাবার মত বস্তুতে পরিণত হতে যাচ্ছে।

আলা বায়াৎ বাইটাক-এ, ডিনশার্প বৈরুতের উপশহরের পুন:নির্মাণ সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করছে। এটি একই সাথে লেবাননের আবার শান্ত হয়ে যাওয়া ও গৃহযুদ্ধে যে ধ্বংস সাধন হয়েছে তার বিপরীত চরিত্র তৈরি করা। বেদনাদায়ক ভাবে নতুন করে উপশহরের এই পুন:সজ্জা কেবল ইউরোপ ও উপসাগরীয় দেশের দামী পর্যটকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। লেবাননের অনেক নাগরিক তাদের শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক এলাকার ভবন ভাড়া নিতে বা কিনতে অসমর্থ। তিনি স্থাপত্যবীদ ও রাজনীতিবিদের মধ্যে সম্পর্ক জোড়া দেবার ব্যাপারটি এর মধ্য দিয়ে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন:

কেবল লেবাননবাসীদের বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা রয়েছে এই নির্মিত পরিবেশে নিজেদের উজ্জ্বলতা ছড়ানোর ক্ষেত্রে। কিন্তু একই সাথে নৈরাজ্যবাদীদের এই একই ক্ষমতা রয়েছে। লেবাননের নিকট প্রতিবেশী হিসেবে কেবল মিশরীয়দের সাম্প্রতিক কালে এই রকম ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নিদর্শন রয়েছে। এগ- কেবল এ রকম এক উদাহরণ যা স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই ভবনের নকশাকার স্থাপত্যবিদ জোসেফ-ফিলিপ্পে কারাম, যে কিনা লেবাননে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছে। লেবাননের আধুনিক এই বিশেষ স্থাপত্য নিদর্শন বিভিন্ন টুকরায় ভেঙ্গে যাবে। যা অন্য এক দালানের ভেঙ্গে পড়ার হুমকির মধ্য দিয়ে লেবাননের ভিন্ন এক দিক আমাদের সামনে তুলে ধরছে। যদিও অনেক লেবাননবাসী এগ নামের এই স্থাপত্যভবনটিকে বাঁচাতে চায় এবং তারা এই ঘটনাকে লেবাননকে দুবাইকরণের বিরুদ্ধে এক লড়াই হিসেবে দেখে, কিন্তু সোলজারার নামক প্রতিষ্ঠান এটিকে আবুধাবী ইনভেস্টমেন্ট হাউসের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এর ফলে একে সংরক্ষণ করা বা ধ্বংস করে ফেলার বিষয়ে লেবাননবাসীদের কোন কিছু বলার সুযোগ নেই।

কিন্তু কেউ কেউ এখনো এগকে রক্ষার আশা ছেড়ে দেয়নি। সেফ দ্যা এগ বা এগ নামক ভবনকে বাঁচাও নামে ফেসবুকে একদল এক প্রচারণা শুরু করেছে। এর প্রতিষ্ঠাতা ডানিয়া বাদের নামের এক ছাত্রী। পাঁচ দিনের মাথায় এই প্রচারণা প্রায় ৫০০০ সদস্য সংগ্রহ করেছে। এই প্রচারণার সাথে সকল স্থান ও পেশার মানুষ এসে যোগ দিয়েছে। তারা চেষ্টা করছে এই অন্যতম বিশেষ ভবনটি রক্ষা করার। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ডানিয়ার এক সাক্ষাৎকার ইলউবানানে ছাপা হয়েছে। এই সাক্ষাৎকার ছাপা হয় “এগকে রক্ষা কর প্রচারণাকারীরা বলছে যে লেবানন কোন মরুভূমি নয়, যে এখানে বালু ছাড়া কোন কিছু নেই এবং এখানে এসে কিছু একটা বানালেই চলবে”। তিনি আরো বলছেন “যদি আমরা এক সাথে কাজ করি, তা হলে আমরা একে রক্ষা করতে পারব”। তিনি এই প্রচারণার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর এবং উৎসাহজনক সমর্থন পাচ্ছেন।

যখন এর সদস্য সংখ্যা ৫০০০ পার হয়ে যায়, এই দলটি তখন এখানে ফেসবুক কজ নামক বিশেষ উপাদানে পরিণত হয়, তাদের বিবৃতি এখানে রয়েছে ( ফেসবুক কজে যে কোন ফেসবুক ব্যবহারকারী তার সত্যিকারের বন্ধুর সাথে ইতিবাচক যোগাযোগ তৈরি করতে সক্ষম হয়):

• এগ নামক ভবনটি ১৯৬০ এর দশকের আধুনিক স্থাপত্যকলার এক অগ্রগামী চিহ্ন হিসেব পরিচিত। এটি এমন এক সময় যখন পশ্চিমা সমাজ লেবানের দিকে শ্রদ্ধা এবং বিস্ময়ের চোখে তাকাত।
• আমরা চাই না এগকে কেবল গৃহযুদ্ধের স্মৃতি হিসেবেই দেখা হোক। আমরা বিকাশের বিপক্ষে নই, কিন্তু আমরা আমাদের অতীতের অর্জন ও পরিচয়কে খরচের খাতায় তুলে ধরতে চাই না।
• লেবানন কোন অক্ষত এলাকা নয়। কোন নতুন সংস্কৃতির চিহ্ন ধারণ করে, এমন কারো অপেক্ষায় থাকা সাজে না; আমরা আমাদের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার ঘটনা মেনে নিতে পারি না।

এই প্রচারণা স্বাধীন একদল এক্টিভিস্ট, ইনডাইএ্যাক্ট এবং কালেকটিভ ৩৪ এর সমর্থন লাভ করেছে। এই সব সংগঠন লেবানন এবং তার নাগরিকদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার এক উন্মুক্ত স্থান। তারা এগকে বর্ণনা করছে শহুরে এক ভবন হিসেবে, যা যৌথ এবং একক স্মৃতি ধারক এবং আধুনিক প্রথাগত সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে।

ফেসবুকের পাতায় এগের কিছু চমৎকার ছবি (এগ-সেলেন্ট) রয়েছে এবং সারাহ হাদ্দাদ এর তোলা কিছু সুন্দর ছবি এখানে রয়েছে।

একবার এই সব ছবির দিকে তাকান এবং তারপর এখানে অনলাইনের এই দরখাস্তের পাতায় প্রবেশ করুন।

সর্বোপরি, যেমনটা ফ্লাভি এখানে বর্ণনা করেছে, খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এই ভবন খুবই মূল্যবান, খুবই বিচিত্র, কিন্তু খুবই কঠিন কাজ প্রতীক হিসেবে তাকে ধ্বংস করে ফেলা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .