যুক্তরাষ্ট্র: মানব পাচার প্রতিরোধ কর্মকাণ্ড

মানব পাচার যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমস্যা, যাকে চিহ্নিত করা যায় না, কারণ যারা এর শিকার, তাদের জনসাধারণের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। যারা এর শিকার হয় তারা অবৈধ এক ধরনের দাসত্ব বৃত্তির শিকার হয়, যা প্রায়শ:ই সোয়েটশপ শ্রমিক (যে সমস্ত শ্রমিক নামমাত্র মজুরিতে কাজ করে, যেমন শিশু বা অভিবাসী শ্রমিক) বা কিংবা যৌন কর্মে নিয়োজিত করা হয়। এই সমস্ত পাচারের শিকার সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের সংগঠিত এক অপরাধী দল আমেরিকায় নিয়ে আসে।

স্টপ চাইল্ড ট্রাফিকিং নাউ নামের সংগঠন হিসেব করে দেখিয়েছ সারা বছর প্রায় ২.৫ মিলিয়ন শিশু যৌন বাণিজ্যের উদ্দেশ্য বিক্রি হয়। এদের বেশীর ভাগই মেয়ে। পাচারের শিকার শিশুটির বয়স চার থেকে পাঁচ বছর হতে পারে। এই শিশুদের প্রায়শ:ই তাদের বাসা থেকে অপহরণ করা হয়। এরপর তারা আর কোন দিন তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারে না। মানবাধিকার সংস্থা ও আলাদা ব্যক্তি স্থানীয় সম্প্রদায়কে এই বিষয়ে সচেতন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এর সাথে তারা আমেরিকায় মানব পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। যারা এ ধরনের পাচারের শিকার, তাদের এই পাচার কারী চক্রের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে।

লস এঞ্জেলসে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, সৌজন্যে একলু.সোকাল এবং ছবিটি ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স-এর আওতায় প্রকাশ করা হয়েছে।

লস এঞ্জেলসে ঐক্য বদ্ধ প্রতিবাদ, সৌজন্যে একলু.সোকাল এবং ছবিটি ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স-এর আওতায় প্রকাশ করা হয়েছে।

ব্লগার এবং মানব পাচার প্রতিরোধ কর্মী আমান্ডা ক্লোয়ের সম্প্রতি এক ব্লগ প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম, “কে ছোট্ট কালো মেয়েটিকে চুরি করেছে? তিনি আমেরিকায়, আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের মধ্যে শিশু অপহরণ সমস্যা নিয়ে লেখেন

প্রতি বছর আমেরিকায় প্রায় ৮০০,০০০ টি শিশু হারিয়ে যাবার ঘটনা রিপোর্ট করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ শতাংশ শিশু আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের। গত বছর নিউ ইয়র্কে শিশু হারিয়ে যাওয়ার যে সব রিপোর্ট করা হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া শিশুর অর্ধেকই কালো এবং এদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ মেয়ে শিশু। এদের কেউ সাড়ে সতের বছরের নয়, এদের বেশীর ভাগের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর। অন্য শহর যেমন আটলান্টা, ওয়াশিংটন ডিসি, শিকাগো, এবং লস এঞ্জেলসে বিপুল সংখ্যায় আফ্রিকান- আমেরিকান বাস করে। এই সমস্ত এলাকাতেও বড় আকারে নিগ্রো তরুণী অপহরণের শিকার হয় অথবা “পালিয়ে যায়”। কিন্তু এই সমস্ত মেয়েদের ভাগ্যে কি ঘটে? নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে তারা বাতাসে মিলিয়ে যায় না।

তারা হারিয়ে যায়, বলা যায় বেশ্যার দালালের পকেটে হারায়। এই সব মেয়েরা পাচারের শিকার হয়ে যায়। তারা যৌন বাণিজ্যের শিকার হয়। তাদের অনেকে রাস্তায় দালালদের খপ্পরে পড়ে এবং রাস্তার পতিতায় পরিণত হতে বাধ্য হয়। অন্যরা নগ্ন নাচের ক্লাবে নাচতে বাধ্য হয় অথবা পর্ণ ছবিতে অভিনয় করতে বাধ্য হয়। অনেকে ক্রেইগলিষ্ট বা ইন্টারনেটে বিনে পয়সায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার সাইটে নাম লেখায়, কেউ এসকর্ট এজেন্সি বা সহচরী সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এবং ইন্টারনেটের কোন এক কোণায় নিজেদের বিক্রি করার জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। তারা আসলে মানব পাচারের শিকার, যেমন ভিয়েতনামী মেয়েরা থাইল্যান্ডের পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে যায় অথবা যেমন করে গুয়েতেমালার মেয়েরা এল পাসোতে গিয়ে বাস করতে বাধ্য হয়।

আমেরিকার রাষ্ট্রীয় মুখপাত্র লূইস সি ডেবাকা যিনি তার অফিস মনিটর এন্ড কমব্যাট ইন পার্সন বা ব্যক্তি পাচার পর্যবেক্ষণ এবং তার বিরুদ্ধে অভিযান-নিয়ে নিজে ব্লগ করেন। সেখানে তিনি, আমেরিকার শিশুরা যে সমস্ত বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে তার কথা লিখেছেন। তিনি সম্প্রতি এক প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিল শিশুদের সাথে যারা কাজ করে, সেই রকম কিছু পেশাদার কর্মী, যেমন শিক্ষকরা।

যারা তরুণ তরুণীদের সাথে কাজ করে, তাদের অবশ্যই সতর্ক থাকা উচিত। সে সমস্ত বিষয় তাদের ছাত্রছাত্রীদের জন্য হুমকি স্বরূপ, সে সব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। ধারাবাহিকভাবে প্রযুক্তির উৎকর্ষ লাভ মানব পাচারের এক উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেখানে ইন্টারনেট ফোরাম, এপার্টমেন্ট বা আসবাবপত্র বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেখানে একই ইন্টারনেট পতিতাবৃত্তিতে সহযোগীতা করছে। কাউকে পতিতা বানানোর ক্ষেত্রে অপরাধীরা চ্যাটরুম, মেসেজবোর্ড এবং বিশেষ ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে। অপরাধীরা অপেক্ষায় থাকে, এসব জায়গার কোথায় এমন শিকার পাওয়া যাবে, যারা অনেক নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে নাজুক মেয়ে বা ছেলেটি এদের শিকার। এই ধরনের অপরাধীদের হুমকির মুখে সেই সমস্ত কিশোর কিশোরী পড়ে যায়, যাদের ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়, অথবা যারা বাবা-মার সম্পর্কের জটিলতায় বাড়ি থেকে পালাতে যায়, তারাই দালালের খপ্পরে পড়ে। এই সমস্ত দালালেরা, তাদের ভালোবাসা ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে। কিন্তু তাদের এমন এক পৃথিবীতে ফলে দেয় যেখানে নিষ্ঠুরতা আর অত্যাচার ছাড়া কিছুই নেই।

ডেবাকা এছাড়াও তার ব্লগে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক অফিসের তালিকা উল্লেখ করেছেন, যেখানে কেউ মানব পাচারের ঘটনা বা সন্দেহজনক বিষয়ে রিপোর্ট করতে পারবে। নির্দিষ্ট গ্লোবাল বা বেসরকারী আন্তর্জাতিক এনজিও অথবা সরকারী অংশীদারদের কাছে এই বিষয়ে রিপোর্ট করতে হবে।

সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য, কিছু ব্যক্তি আইনগত প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা শুরু করেছেন, যেমন তথ্য চিত্র নির্মাতা টারা হার্লে। তিনি রোড আইল্যান্ডে বাস করেন। সেখান থেকে তার ব্লগের মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে দারুণ ভাবে যুক্ত হয়েছেন। তিনি তার মতামতে জানাচ্ছেন আইনকে আরো কার্যকারী করতে কি কি যোগ করা উচিত, তিনি লিখেছেন।

আমি এই আইনের সপক্ষে রয়েছি। আমি আশা করি যে সিনেটর পেরির এই আইন কংগ্রেস ও সিনেটে পূর্ণ সমর্থন লাভ করবে। আমি মনে করি এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল প্রশিক্ষণ প্রদান। ঠিকমতো প্রশিক্ষণ ছাড়া কি ভাবে আমরা আশা করব, পুলিশ ঘটনার শিকারকে চিহ্নিত করতে পারবে? আমাদের অবশ্যই একটা আদর্শ তৈরি করা উচিত, আমরা এই ঘটনার শিকার ব্যক্তিটির সাথে কি রকম আচরণ করবো। আমাদের ঘটনার শিকার ব্যক্তিটির সাথে এমন আচরণ করা উচিত, যেন সে এক দুর্ঘটনার শিকার, কোন অপরাধী নয়।

ভদ্রমহিলা কিছু প্রচার মাধ্যমের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করেন এবং তারা এই পরিস্থিতি ব্যাখ্যায় যে শব্দ ব্যবহার করে সে গুলোতেও আপত্তি জানিয়েছেন এবং কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ১৬ বছরের এক কিশোরী যে মানব পাচারের শিকার তার ঘটনায় তিনি নির্দেশ করেন:

আমি যা বুঝতে পারি না কেন তারা (মিডিয়া) কখনই মানব পাচার শব্দটি ব্যবহার করে না? বছরের পর বছর প্রচার মাধ্যম হন্যে হয়ে বলেছে পতিতা আইনে পরিবর্তন আনা দরকার কারণ এশিয়ার ম্যাসেজ পার্লার বা শরীর দলাই করার এলাকায় মানব পাচার হয়, কিন্তু এখন যখন সত্যিকারের মানব পাচারের শিকার একটি ঘটনা আবিষ্কার হয়েছে তখন উক্ত মেয়েটিকে তারা মানব পাচারের শিকার না বলে ঘর পালানো বলে উল্লেখ করেছে?!?!

যেমনটা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সারা দেশে এর বাইরেও অনেক সম্প্রদায় ও মাঠপর্যায়ের সংগঠন রয়েছে যেমন স্টপ চাইল্ড ট্রাফিকিং নাও -এর মতো প্রতিষ্ঠান যারা সিটিজেন মিডিয়া ব্যবহার করছে, এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য, শব্দ ছড়িয়ে দেওয়া দিচ্ছে। ডিসি স্টপ চাইল্ড ট্রাফিকিং নাও ওয়াক একটি হাঁটার অনুষ্ঠান। এর আয়োজক প্রতিষ্ঠান বলছে, এটা হবে এই শহরের ইতিহাসে সবচেয়ে মানব পাচার বিরোধী এক অনুষ্ঠান। অস্টিন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড ট্রাফিকিং নাও ওয়াক, টুইটার ব্যবহার করছে, যাতে লোকজন ৫কে বা পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।

আরো ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে টিনা ফ্রুনডট কথা বলেছেন। তিনি এক মানব পাচার বিরোধী কর্মী এবং ওয়াশিংটন ডিসি শহরে কাজ করেন। তিনি নিজেই একসময় পাচারের শিকার হয়েছিলেন। তিনি তার সেই ব্যক্তিগত কাহিনী জানাচ্ছেন যেই অভিজ্ঞতা তাকে উৎসাহ যুগিয়েছে তার নিজস্ব মাঠ পর্যায়ের একটা প্রতিষ্ঠান চালু করতে। এই প্রতিষ্ঠানের নাম কান্ট্রি হাউস। এখানে তিনি যে সমস্ত তরুণী মানব পাচারকারীদের জালে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাদের সাহায্য করার কাজে নিয়োজিত।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .