ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ: চল ভালোবাসার কথা বলি

ঐতিহাসিকভাবে ক্যারিবীয় অঞ্চলে ধুমধামের সাথে ভ্যালেন্টাইন্স-ডে পালন করা হয় না। কিন্তু তিনজন ব্লগার (যার মধ্যে দুজন প্রবাসী) প্রেম সমন্ধে তাদের দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

জ্যামাইকার সাহিত্যব্লগার জেফ্রি ফিলিপ বর্তমানে ফ্লোরিডায় বাস করছেন। তিনি উপলদ্ধি করেছেন, ক্যারিবীয় সমাজ ও পরিবারের মধ্যে প্রেমিকা বা বন্ধু এবং বিশেষ করে কালো বর্ণের কাউকে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাগুলো বলা বলা সবেচেয়ে কঠিন। তিনি সন্দেহ করেন এই বাস্তবতার সাথে এই ঘটনার মিল রয়েছে যে, এখন অনেক ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পরিবার কেবল সিঙ্গেল মা বা বাবার পরিবার।

অমাদের অনেকেই একই বাস্তবতা ভাগাভাগি করে নিয়েছি যে আমরা শুধু মায়ের ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছি। এখন আমরা যারা পিতা হয়েছি তারা চেষ্টা করছি কি ভাবে ভালো বাবা হওয়া যায়।

আমাদের বাস্তবতায় আমরা এই তিন শব্দের সাধারণ বাক্য, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ খুব কম শুনে থাকি। যার ফলে আমাদের পক্ষে এই কথাটা উচ্চারণ করা খুব কঠিন।

তিনি আরো জানাচ্ছেন:

একা একজন মা যে তার স্বামীর সাথে থাকে না, তার জন্য ব্যাপারটি আরো কঠিন। তাকে অবশ্যই কঠিন হতে হবে। তার ভেতর একই সঙ্গে যত্ন নেওয়ার গুণ থাকতে হবে এবং একই সঙ্গে তাকে শৃংখলাপরায়ন হতে হবে। কোন বালক বিশেষ করে যখন ছেলেটি কিশোর বয়সে প্রবেশ করে তখন প্রায়শ:ই তার মা তার সাথে কঠিন আচরণ করে, কাজেই সে তার মায়ের স্নেহপরায়নতার দিকটি খুব কমই দেখতে পায়।

কোন কোন সন্তান দ্বৈত গৃহস্থালীতে বড় হয়। এ অবস্থায় যদি তার পিতামাতা চালাক হয়, তাহলে তাদের ভুমিকাও দুই রকম হয় (কিছু ছেলেমেয়ে কখনই বুঝতে পারে না এগুলো আসলে এক ধরনের ভূমিকা)। তখন পিতার ভূমিকা হয় শৃংখলাপরায়ন এবং মায়ের ভূমিকা হয় স্নেহপূর্ণ লালনপালন। অথবা সন্তানের প্রবণতার উপর ভিত্তি করে পিতামাতার ভুমিকা আলাদা আলাদা হয়ে যেতে পারে। তবে এদের মধ্যে কোন একজনকে শাসনকর্তা বা পুলিশের ভূমিকা নিতে হবে।

তবে স্নেহপূর্ণ ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারন, সন্তানকে শৃংখলাপূর্ণ জীবনে নিয়ে আসার পর এমন কাউকে প্রয়োজন যে সন্তানকে বলবে, ‘যিনি তোমাকে শাসন করে তিনি এখনও তোমাকে ভালোবাসে, তিনি সত্যিই তোমারা যত্ন নিতে চায় এবং সকল কিছু এক সময় ঠিক হয়ে যাবে’। সন্তানের পক্ষে অনেক সময় এটা বিশ্বাস করা কঠিন, তাকে যে পেটাতে চায় সে আসলে তাকে ভালোবাসে এবং এখন তাকে আরাম দিতে চায়’।

ক্যারিবীয় অনেক শিশুই এমন এক পরিবেশ পায় যা এক ধরনের পিতামাতার আতিশয্যে (পড়ুন মায়ের আদর ও শাসনে) বেড়ে ওঠা। এই সব বাবা মাকে মনে হতে পারে দুটি আলাদা ব্যাক্তিত্ব। একমুহুর্ত আগেই মা তার সন্তানকে বলবে, আমরা মানিক, আমরা সোনা, পরের মুহর্তে হয়তে সে বলে উঠতে পারে, তোর ছাল ছিলে দেব হারামজাদা।

বেদনাদায়ক সত্যিটি হলো এই ধরনের ঘটনা ক্যারিবিয়া সম্প্রদায়ে লম্বা সময় ধরে ঘটে আসছে। বর্তমান অনেক ক্যারিবীয় গৃহস্থালীতে একজন দৃঢ়চেতা পিতার অনুপস্থিতি পরিবারিক সর্ম্পকের উপর প্রভাব ফেলছে। ফিলিপ এই সর্ম্পক বজায় রাখতে শুরু করছেন, কিন্ত তিনি বিশ্বাস করেন, কোন একটি বিষয় আমাদের মধ্যে শেষ করে আবার তা শুরু করা প্রয়োজন, ঠিক এই মুহুর্তে, আর এর পুরস্কার?

এর পুরস্কার, সেই তিনটি বাক্য, যা আমরা আমাদের সন্তানদের বলতে অপারগ। সেই তিনটি যাদুকরী শব্দ, যা আমাদের অনেকে কখনই আমাদের পিতামাতার কাছে শুনতে পাইনি। সেই তিনটি শব্দ, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’।

আরেকজন প্রবাসী ব্লগার কারেন ওয়ালরন্ড। তিনি বেড়ে উঠেছেন ট্রিনিদাদ ও টোবাগো দ্বীপে। তিনি ব্লগহারে দেয়া এমন একটি লেখা আমাদের সাথে ভাগাভাগি করেছেন যা কিনা ব্লগের অন্য সব লেখা থেকে একেবারে আলাদা। মায়ের ভূমিকা থেকে একেবারে আলাদা, যা খানিকটা দুরের সম্পর্ক। ভদ্রমহিলা খুব আনন্দের মাধ্যমে মনে করতে পারেন তার দাদীর সাথে তার সম্পর্ক। এই সর্ম্পক তাকে ভালোবাসা সমন্ধে কিছু ধারনা দিয়েছিল।

এখন থেকে প্রায় ঠিক সাত বছর আগে, আমি আমার স্বামী মারকাস এর সাথে আমার এনগেজমেন্ট এর ঘোষনা দেই। এর কিছুদিন পরেই আমি ত্রিনিদাদে আমরা পরিবারের সাথে মিলিত হতে যাই। আমরা দাদিমা (তখন তার বয়স ছিল ৯৬ বছর) আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে যায়। তিনি খুব নরম গলায় আমাকে বললেন, ‘কারেন, তুমি উপলদ্ধি করবে যে একজন ভালো বউ হিসেবে সবসময় তুমি নিশ্চিত রাখবে যে তোমার স্বামীকে যেন সুন্দর দেখায়। তার পোশাক সবসময় ইস্ত্রি করে দেবে। প্রতিদিন সেগুলো তুমি তার হাতে তুলে দেবে। তুমি প্রতিদিন সকালে তার জন্য সুন্দর করে নাস্তা টেবিলে তৈরী করে রাখবে। কিন্তু একটা জিনিষ তুমি সবসময় মনে রাখবে, অনেকটা ষড়যন্ত্রকারীর মতো কানের কাছে ঝুকে বললেন, কখনই একজন মানুষের জুতা পালিশ করে দেবে না’।

যখন আমি সেদিনের কথা স্মরণ করি সেদিন আমি হাসিতে বিস্মিত হয়ে যাই। আমার দাদিমা (যার কিনা এখন প্রায় ১০৩ বছর বয়স, তিনি এখনও অনেক সুউপদেশ দেন) যতক্ষণ আমি স্মরন করতে পারি সবসময় তিনি আমাকে ভালোবাসা এবং সর্ম্পকের কথা বলেন। এমনকি তিনি আমাকে যা বলেছেন তার বেশীর ভাগই পুরোন কথা। (আমি বিশ্বাস করি না এই সাতবছরে আমি আমার স্বামীর জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দিয়েছি) তবে তার ভেতরে সবকিছুর জন্য সবসময় একগাদা জ্ঞানপূর্ণ চিন্তা রয়েছে যা তিনি আমাকে বলেছিলেন।
.
এই বিষয়টি নিশ্চিত করো যে তোমার স্বামী তোমাকে ভালোবাসে এবং তোমার যত্ন নেয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার মধ্যে এই ভাবনা তৈরী হবে যে, তুমি তার দাসী অথবা যে কোন ভাবে তুমি তার সামনে মাথা ঝুঁকে রয়েছ।

দাদিমার উদাহরণ কারেনকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে যাদের তুমি ভালোবাসো এবং প্রশংসা কর তাদের তুমি সবচেয়ে গুরুত্ব দাও।

আমি দেখেছি তিনি সেই মানুষটিকে সন্মান জানান যে মানুষটি তাকে তার বাগানে নিয়ে যায়। তিনি সেখানে সেই ব্যাক্তিটিকে আহবান জানান যেন ব্যাক্তিটি বাগানে যতগুলো আম বা নাশপাতির মতো দেখতে যে আভাকাদো ফল রয়েছে তা সে পেড়ে নিয়ে যেতে পারে। এগুলো যেন ব্যাক্তিটি তার বাসায় নিয়ে যায় এবং পরিবারের সাথে মিলেমিশে খায়। আমি সেইদিনগুলোর কথা চিন্তা করতে ভালোবাসি যখন তিনি আমাকে দাওয়াত দিবেন এবং আমি তার পাশে বসে তার বানানো পেয়ারের চীজ উপভোগ করবো (এটি তার সবচেয়ে প্রিয়) এবং আমরা উভয়ে, আমার ভবিষ্যত নিয়ে আলাপ করব। সুখের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কি হতে পারে। ভালো পরিবার এবং ভালো বন্ধুত্ব আসলে টাকার চেয়ে বেশী, যদি পৃথিবীতে একটি মাত্র মহিলা থাকে এবং যে সত্যিই এবং প্রকৃতপক্ষেই তার নিজের মতোই চলতে চায়, সেই মহিলার মাঝে আমি আবিস্কার করি ভালোবাসা আসলে কি? তাহলে আমি বলবো সে মহিলাটি হলো আমার দাদিমা।

এখন অমি নিজেই মা হয়েছি। আমি আমার মেয়ের জন্য সেই মুহুর্তগুলো আবার সৃষ্টি করতে চাই। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলি, কিভাবে সে আর তার বন্ধুরা একে অন্যের সাথে মিশবে এবং তার বন্ধুদের সাথে তার আচরন কি হবে? আমি তাকে বলি তার কাছ থেকে আমি কি আশা করি। যখন সে প্রাপ্তবয়স্ক হবে এবং যখন সে তার নিজের জন্য পরিবার বেছে নেবে সেক্ষেত্রে আমি কি আশা করি। আমি তাকে গল্পচ্ছলে বলি, ‘কিভাবে তার বাবা এবং আমার দেখা হয়েছিল এবং এখন পর্যন্ত আমরা উভয়ে উভয়কে কতটা ভালোবাসি। আমি তাকে বলি, ‘ হাসপাতালে তার ছোট্টমুখ দেখে আমার কেমন অনুভূতি হয়েছিল। যখন আমরা ঘরের বাইরে যাই এবং ফিরে আসি, আমি সবসময় চেষ্টা করি কোন একজন অপরিচিতর জন্য ভালো কিছু করার। সামান্য কিছু, যেমন মিষ্টি করে হাসা এবং তার জন্য দরজা খুলে ধরা। আমরা পেছনে যে ব্যক্তিটি রয়েছে তাকে এক কাপ কফি সাধা। তার ফলে যেন পেছনের মেয়েটি অনুভব করতে পারে ভালোবাসা কি? এই ভালোবাসা হয়তো চারপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে।

সবশেষ আবেনি, যিনি সেন্ট ভিনসেন্ট এন্ড দি গ্রানাডিয়ানস থেকে লিখেন তার হৃদয়ের মানুষের কাছে এক খোলা চিঠি লিখেছেন:

ছয় বছরে এই প্রথম তুমি ভ্যালেন্টাইন্স ডেতে একা। আমি জানি তুমি আসলে কোন ভ্যালেন্টাইন ব্যাক্তিত্ব নও, কিন্তু তোমার মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমাকে তারচেযে বেশী কাছে টানে। এটি তোমার ভেতর কেমন অনুভুতির জন্ম দেয়? আমি তোমাকে শুনতে পাচ্ছি না? তুমি কি দয়া করে আরেকটু জোরে বলতে পারো না?

তুমি ভাবছ তুমি দু:খ পাবে, কিন্তু তুমি তা পাবে না, তুমি হৃদয় অনুভব করেছ, তুমি দেখেছ ঠিক কখন সকলই ভুল দিকে পরিচালিত হতে থাকে।
হঠাৎ করে আবিস্কার করলাম এই নি:সঙ্গতা আদৌও খুব খারাপ কিছু নয়। এই রাস্তাটি পুরোপুরি এক অভিযানে পরিপূর্ণ যা তুমি আবিস্কার করতে চাইছিলে। আমি আবার হাসলাম, সত্যিকারের হাসি, যার আমার সমস্ত মুখমন্ডল জুড়ে বিস্তৃত ছিল, যা তোমার ভেতর থেকে আসছিল। তুমি জানো, এই হাসি আমার সারা পৃথিবীকে এক আন্দদায়ক হাসিতে ভরিয়ে তুললো।

কল্পনা কর, কি বলে আমার হৃদয়? আমি তোমাকে নিয়ে এতটাই গর্বিত যে তার জন্য হৃদয়ের তীব্র গতি গণনা করছি। হৃদয়, আমি ঠিক থাকবো।

সবশেষে বলি সকল কিছুই ভালোবাসার জন্য। অন্যের জন্য ভালোবাসো এবং হ্যা, নিজেকে ভালোবাসো। হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .