মায়ানমার: সাইক্লোনের নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ

সাইক্লোন নার্গিস গত সপ্তাহে পাঁচটি অঞ্চলকে ধ্বংস করে দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালিত প্রচার মাধ্যম জানিয়েছে, ২২,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৪১,০০০ এর মত এখনও নিখোঁজ রয়েছে। লাখ লাখ মানুষ বাস্তুহীন হয়ে পড়েছে।

ব্যাংকক পান্ডিত ক্রমবর্ধমান হতাহতের সংখ্যা দেখেমন্তব্য করেছেন:

শুনলাম ৩৫১, হলো ৪,০০০, তারপরে এক লাফে ১০,০০০। এখন রাষ্ট্র পরিচালিত প্রচার মাধ্যম ২২,০০০ মানুষের নিহত এবং ৪১,০০০ মানুষ নিখোঁজ হয়েছে জানিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে । এখন পর্যন্ত এই হাল, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাওয়া অভাবনীয় হবে না। বার্মা সরকার এই অবস্থা কোন ভাবেই একাকী সামলাতে পারবে না।

বস্তুত: মৃতের সংখ্যা এখনও বাড়তে পারে। দ্য ইরাবতি ব্যাখ্যা করছে:

প্রত্যক্ষদর্শীরা যারা ইরাবতী ব-দ্বীপের লাপুত্তা শহরতলী থেকে কোনভাবে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে, দ্যইরাবতী কে জানিয়েছে প্রায় ২২টি গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে এবং মৃতের সংখ্যা অনেক বেশী হতে পারে। লাপুত্তা শহরের স্থানীয় একটা সূত্র ধারণা করছে সাইক্লোনে নিহতের সংখ্যা ৬০,০০০ এর বেশী হতে পারে। এই সূত্র আলাদাভাবে নিশ্চিত করা যায় নি।

রুল অব লর্ডস প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন:

উড়ন্ত বৃক্ষের আঘাতে, কখনও ঠান্ডায় মানুষ মরেছে। কেউ মারা গেছে আশ্রম ধসে পড়ায় যেখানে সাইক্লোনের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ জন আশ্রয় নিয়েছিল।

সাগরের উচ্চতা ৫ ফুটের মত বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ঝড়ের সময়ে ভাসিয়ে নিয়েছে শহর এবং এতেই অধিকাংশ ক্ষতি সাধিত হয়েছে; ছোট বাড়ীঘর, ভবন সাফ হয়ে গেছে।

ছিল পানি, বৃষ্টি ও বাতাসের তান্ডব। বেলাভূমির রাস্তাঘাট মিশে গেছে এবং উঁচু স্থানেও পানি উঠেছিল হাঁটু অবধি। সারা শহর পানির নীচে তলিয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড স্রোত ও জলসাপের বিচরণ ছিল। সাপের কামড়ে মারা গেছে অনেকে।

রেঙ্গুনের স্থানীয় বাসিন্দা ও ভিক্ষুরা নিজেরাই রাস্তাঘাট পরিষ্কার করার কাজে নেমে পড়েছে সরকারী লোকবলের অভাবে। স্ব-জাগরণের ভিত্তিতে এই কাজ করা হচ্ছে বলে একজন অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন। ভয়াবহ এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মানুষজন তাদের অল্প পানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।

ম্যয়াত থাউরা বর্ণনা করেছেন কিভাবে তার পরিবার এবং প্রতিবেশীরা এই দুঃখজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে:

শনিবার সকাল থেকে রেঙ্গুনে আমার বাড়ীতে ফোন করার চেষ্টা করছি। শুক্রবার বিকালেও কথা বলতে পেরেছিলাম। বাবা জানিয়েছিলেন, ভারী বাতাস বইছে, তবে অবস্থা অনুকূলে। পরের দিন সকালে যখন বাসায় ফোন করতে চেষ্টা করলাম, লাইনগুলো দেখলাম বসে গেছে। পুরো শনিবার কথা বলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। রবিবার সকাল, এখনও আমি যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হইনি।

আমার ফ্লাট ছিল একদম উচু তলায়, সেজন্য আমি বেশী চিন্তিত ছিলাম। দু-তিনটা তলা তো উড়েই গেল, সব স্যাটেলাইট ডিস ধ্বংস হয়ে গেল কিন্তু তারপরেও ভবনটি দাড়িয়ে ছিল। ঘরের মধ্যে পানি ঢুকে পড়েছিল এবং আমার পরিবারকে জিনিসপত্র শুকনো জায়গায় সরাতে হয়েছে।

বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সৌভাগ্য যে প্রতিবেশীদের একজনের বৈদ্যুতিক জেনারেট ছিল, তা দিয়ে আমাদের রুমের পানি পাম্প করতে পেরেছি। কিন্তু যাদের জেনারেটর নেই তাদের জন্য পানি একটা বিশাল সমস্যা। সরকারী সংস্থা থেকে এখনও কোন সাহায্য পৌঁছে নাই। মানুষজন স্বউদ্যেগে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছে।

খাদ্যদ্রবের দাম বেড়ে গেছে এবং বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালসের দামও বর্ধিত। গুটিকয়েক দোকান খুলেছে কিন্তু অজস্র মানুষ কেনার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে। কয়েকটা সুপারমার্কেট আজকে খুলেছে বটে কিন্তু কর্তৃপক্ষকে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।

আমার বন্ধু বলেছে নগরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা ভীষণ কষ্টকর হবে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা যেহেতু পুরো অবকাঠামো মেরামতের জন্য প্রয়োজন হবে কোটি কোটি টাকা।

সামরিক জান্তার কাছে ফিয়ার ফ্রম ফ্রিডম আবেদন করেছে:

অনেকেই এখন ব-দ্বীপের শহরাঞ্চলের আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছে; তাদের গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ধানক্ষেত বন্যায় তলিয়ে গেছে। কেউ কাউকে সাহায্য করার মত অবস্থায় নেই, প্রত্যেকেই বাঁচার জন্য সংগ্রামরত। শহরের মানুষদের চিন্তা হচ্ছে কিভাবে তারা তাদের বাড়ীর ছাদ মেরামত করবে এবং আগত সংকট মোকাবেলা জন্য পানি ও চাল মজুদ করবে; অন্যদিকে বাস্তুচ্যুত গ্রাম্য মানুষগুলো হয়তো ভিক্ষে শুরু করবে যে পর্যন্ত না তারা তাদের ভূখন্ডে ফিরে যেতে পারছে এবং নতুন ভাবে ঘরবাড়ি তুলতে পারছে।

সামরিক বাহিনীর সেনাসদ্যরা রয়েছে শহুরেদের সাহায্য করার জন্য; কিন্তু তাদের নেই অর্থ, জিনিসপত্র বা উপায় যা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্থদের পুন:নির্মাণে সত্যিই কাজে লাগতে পারে। আমার মনে হয় সামরিক সরকার এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অনুমতি দেবে। এমন ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবেলায় তাদের পর্যাপ্ত সম্পদ ও বিশেষজ্ঞ নেই।

সাইক্লোনে একটা জেলখানাও ধ্বংস হয়ে গেছে, সেখানে অনেক রাজনৈতিক বন্দী ছিল। এসিসট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স একটা বক্তব্যের খসড়া উপস্থাপন করেছে কিভাবে গত সপ্তাহে সংগঠিত এক দাঙ্গায় ৩০ জনের বেশী কয়েদী নিহত হয়েছে:

রেঙ্গুনের ইনসেরিন কারাগারে সাইক্লোন ছোবল মেরেছে। তীব্র বায়ুপ্রবাহের ফলে ইনসেরিন জেলখানার অনেক জিঙ্কের ছাদ একটার পর একটা ভেঙে পড়েছে।

জেলখানায় ধ্বংসযজ্ঞের কারনে ১৫০০ এর মত কারাবন্দীকে হল নম্বর ১-এ জোর করে গাদাগাদি করে ঢুকানো হয়েছিল। নিরাপদ জায়গায় যাবার কেউ সুযোগ পায়নি এবং পরের দিন সকাল পর্যন্ত তারা সেখানে তালাবন্দী অবস্থায় বন্দী ছিল। কয়েদীরা ভিজে চুপচুপে শীতার্ত হয়ে পড়েছিল, ক্ষুধার্ত ও ক্ষুব্ধ ছিল। বারংবার রক্ষীদের অনুরোধ করেছিল দরজা খুলে নিরাপদ জায়গায় যেতে দিতে, কিন্তু তারা শোনেনি। কিছু কয়েদী দাবী-দাওয়া নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং কারা অভ্যন্তরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ফলের হলের ভেতর পুড়তে থাকে এবং দাঙ্গা শুরু হয়।

ঘটনা নিয়ন্ত্রণে রক্ষীরা কয়েদীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। সৈন্য ও দাঙ্গা পুলিশও তলব করা হয়। কয়েক দফা গুলি বর্ষণে ৩৬জন কয়েদী তৎক্ষণাৎ নিহত এবং আরো প্রায় ৭০ জন আহত হয়।

কর্তৃপক্ষকে এজন্য দায়ী করতে হয়। যখন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানল তখনই তাদের উচিত ছিল কয়েদীদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া। তাদের অব্যবস্থাপনার ফলে কয়েদীদের দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছে। এমন অমানবিক আচরণের নিন্দা জ্ঞাপন করি; ৩৬ জন কয়েদী তাদের গাফিলতির জন্য জীবন হারিয়েছে।

বার্মা গ্লোবাল এ্যাকশন নেটওয়ার্ক এর সোফি লউইন এর একটা চিটি কাইমেকং তুলে দিয়েছে:

বুধবার রাতেই নাশা পূর্বাভাষ দেয় তাইফুন নার্গিস বার্মায় আঘাত হানবে, তদুপরি শাসকগোষ্ঠী কোন প্রস্তুতি নেয় নি – এটা মারাত্মক অপরাধ যে শাষকরা জনগণকে সতর্ক করার প্রয়োজনটুকু বোধ করে নি।

আগামস গেকোও সামরিক সরকারকে তিরস্কার করেছেন:

ধ্বংসযজ্ঞের ব্যপকতা শেষ পর্যন্ত সামরিক সরকারকে বাধ্য করেছে বহি:বিশ্বের সাহায্য গ্রহণ করতে, অবস্থা এতই ভয়াল যে একাকী সামলানোর চিন্তা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। খুব কম সংখ্যক সৈন্যকেই দেখা গেছে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিতে যদিও রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে দেখা গেছে কতিপয় উর্দিধারীর ডালপালা অপসারণের দৃশ্য। তবে ভিক্ষু এবং অন্যান্য নাগরিকদের স্ব-উদ্যোগে বেশীরভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

মাও কাওয়া হটুন ধ্বংসযজ্ঞের উপরে প্রকাশিত সংবাদ-প্রতিবেদন জড়ো করেছেন। বার্মিজ গোল্ড বুল এবং সিনজিও বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকার ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা মানচিত্র তুলে দিয়েছে।

দি একোর্ন মায়ানমারে সাহায্য বিতরণের সমস্যার কথা বলেছেন:

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত জনসাধারণ যারা দীর্ঘদিন যাবত সামরিক যাতাকলে পিষ্ট তাদের মাঝে সাহায্য বিতরণ করা বেশ সমস্যা সঙ্কুল। বার্মিজ সরকার হচ্ছে রুদ্ধ শাসকগোর্ষ্ঠী। প্রচার মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত। ৪-মাত্রার সাইক্লোনে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো, যোগাযোগের সকল ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা শ থেকে কয়েক হাজারে পৌঁছে গেছে।

বার্মিজ সামরিক সরকারের পক্ষে এই বিপর্যয় মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। রীতিমত ভয়াবহ, প্রশাসনের রুদ্ধতা চলমান বাজে অবস্থাকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা, সাধারণ অবকাঠামো ও পরিচালন পদ্ধতির অপ্রতুলতার কারণে আন্তর্জাতিক সাড়াও বিঘ্নিত হচ্ছে।

নোফিয়ারসিঙ্গাপুর মতামত ব্যক্ত করেছেন, এখন রাজনীতির নয়, কাজের সময়:

একই আসিয়ানের অন্তর্ভূক্ত মানুষ জন আজ দুর্দশাগ্রস্ত। আরেকজন বাবা, ভাই, বোন অথবা শিশু আমাদের দিকে সাহায্যের আশায় চেয়ে আছে। এটা রাজনীতির সময় নয় – এখন কাজের সময়।

জেজি৬৯ তুলে ধরেছেন বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ব্লগের অনুভূতি:

কেবল সামরিক স্বৈরশাসন অপসারণ নয়, বার্মিজদের সাইক্লোন নার্গিসের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথেও মোকাবিলা করতে হবে।

বার্মার জনসাধারণকে বলছি, যদিও মনে হতে পারে এটা ক্ষুদ্র ও ফাঁকা বুলি, তারপরেও বলি, হৃদয়ের আন্তরিক সমবেদনা গ্রহণ করুন, যুগের পরে যুগ এক নিগ্রহের মধ্যে বসবাস করে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পতিত হওয়ায়।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .