দক্ষিন এশিয়া: মধ্যপ্রাচ্যে দাসত্ব

দক্ষিন এশিয়ার প্রবাসী শ্রমিকরা (ভারতীয়, বাংলাদেশী পাকিস্তানী, শ্রীলন্কান ও নেপালী) সৌদি আরব ও পারস্য উপসাগরের অন্যান্য আরব দেশগুলোর উন্নয়নে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখছে। কিন্তু এদের প্রতি নির্যাতন ও এদের শোষনের ঘটনাগুলো খুবই ঘৃনার এবং মারাত্মক সমস্যা। এই বিদেশী শ্রমিকরা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখে কিন্ত এর বদলে তারা পায় পক্ষপাত, দুর্ব্যবহার, শোষন এবং সরকার তাদের রক্ষায় সচেস্ট নয়।

এদের প্রতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রচুর উদাহরন রয়েছে। কিছু উদাহরন এখানে দিচ্ছি:

হাজারো শ্রমিক তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে স্বপ্নের চাকরির জন্যে মধ্যপ্রাচ্যে আসে। দৃষ্টিপাত ব্লগ রিপোর্ট করছে কিভাবে তারা সেখানে শোষিত হচ্ছে এবং সবকিছু হারিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে দেশে ফিরে আসছে।

নিয়োগকর্তাদের কাছে ন্যায্য বেতন চাওয়ায় কাতারের শত শত নেপালী শ্রমিককে সে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ইউনাইটেড উই ব্লগ একটি নেপালী ছাত্রের খুবই চান্চল্যকর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা উপস্থাপন করেছে যে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছিল। সে বর্ণনা করেছে যে বাহরাইন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গাল্ফ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তাদের দ্বারা নির্বাসিত এই নেপালী শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করায় কিভাবে তাকে অমানষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল।

কুয়েতে ৩০ লাখ জনসংখ্যার ৬০% হচ্ছে বিদেশী শ্রমিক। কুয়েতে এক্সপজিশনস অফ এরাবিয়া ব্লগ একজন ভারতীয় শ্রমিকের সাথে আলাপ করেছে যে বলেছে যে তাকে কিভাবে কম বেতন দেয়া হচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিদেশী শ্রমিকদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮৫% (রিপোর্ট করছে ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন)। এই দেশে ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রমিকরা ৪৩ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করে মাত্র ১ ডলার বেতন পায়। তাদের চুক্তিগুলোকে দাসত্বের সাথে তুলনা করা যায়। যে দেশে ধনী লোকেরা ১০০০ ডলার মূল্যের হোটেল কক্ষে থাকে সেদেশে এই বিদেশী শ্রমিকরা ভোরে আর্মি বেইজের মতো পাহারায় ঘেরা ক্যাম্পে ঘুম থেকে উঠেন এবং সপ্তাহে ছয়দিন প্রহরায় থেকে কাজ করেন। একটি মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটিতেই মাসে হাজারেরও বেশী গরমে আক্রান্ত শ্রমিকের চিকিৎসা করা হয়। সরকার চাপের মধ্যে আছেন কাজের পরিবেশের উন্নতির জন্যে এবং সেইসব নিয়োগদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যারা ন্যায্য বেতন দিচ্ছে না।

হিউমান রাইটস ওয়াচ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিদেশী শ্রমিক শোষনের উপর একটি রিপোর্ট বের করেছে যার শিরোনাম হচ্ছে “শ্রমিকদের প্রতারিত করে টাওয়ার নির্মান“।

সৌদি আরবে মোট জনসংখ্যার ৩৫% বিদেশী শ্রমিক রয়েছে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলন্কা ও বাংলাদেশের প্রায় ২০ লাখ শ্রমিক রয়েছে। হিউমান রাইটস ওয়াচ “দু:স্বপ্ন : সৌদি আরবে বিদেশী শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও শোষন” নামে ১৩৫ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট বের করেছে যাতে বর্ণনা করা হয়েছে কিভাবে এইসব শ্রমিকদের সাথে দাসের মত ব্যবহার করা হচ্ছে।

এই রিপোর্টের কিছু ভীতিকর ও সাংঘাতিক আবিস্কার হচ্ছে:

  • বিদেশী নারী শ্রমিকদের উপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষন, কাজের ক্ষেত্র নিয়োগকর্তা দ্বারা এমনকি জেলের ভেতরেও।
  • বাংলাদেশ, ভারত এবং ফিলিপাইনসের শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছে দিনে ১০ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে। এমনকি তাদের দিয়ে ওভারটাইম ছাড়া সারা রাতও কাজ করানো হয়।
  • বেতন খুবই কম (যেমন ১৬ ঘন্টা কাজ করে ১৩৩ ডলার প্রতি মাসে)
  • শতশত মহিলা শ্রমিক জেদ্দাহ হসপিটাল পরিস্কার করার কাজে লিপ্ত হয়েছেন যাদের দিয়ে দিনে বার ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করানো হয়েছে খাবার এবং বিশ্রাম ছাড়া। এবং এর পরে অবসর সময় তাদের তালাবদ্ধ বাসস্থলে বন্দী করে রাখা হয়েছে।
  • সৌদী বিচার ব্যবস্থার অধীনে এইসব শ্রমিক অমানুষিক আচরন পেয়েছেন।
  • আব্দল মোঘসেত বনী কামাল কাউন্টারকারেন্টস ব্লগে লিখছেন প্রবাসী শ্রমিকরা একবিংশ শতাব্দীর দাস। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে (বিশেষ করে সৌদি আরবে) পাকিস্তানী শ্রমিকদের করুন অবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

    আনহার্ড ভয়েসেস: দৃষ্টিপাত ব্লগ জিজ্ঞেস করছে:

    আমরা, সাধারন নাগরিকেরা এর বিরুদ্ধে কি করতে পারি? প্রবাসী শ্রমিকদের এই সমস্যাগুলো অনেকদিন ধরেই বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। এদের নিয়ে ডকুমেন্টারী তৈরি করা হয়েছে, হিউমান রাইটস ওয়াচের রিপোর্ট বের হয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

    এই মানবাধিকার ব্লগ বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্যে কিছু করনীয়র প্রস্তাব করেছে।

    মধ্য প্রাচ্যের নাগরিকরা এ নিয়ে কি ভাবছেন? বাহরাইনি ব্লগার এসরা'আ মিড ইস্ট ইয়থে প্রকাশিত একটি লেখায় নিন্মোক্ত প্রশ্নগুলো করেছেন:

    আমাকে এটাই হতবুদ্ধি করে যে আমরা কেন বুঝতে পারিনা যদি এইসব বিদেশী শ্রমিক না থাকত তবে আমরা…আসলে কিছুই হতে পারতাম না। আমাদের কাজগুলো এদের ছাড়া কাদের দিয়ে করাতাম? আর কেউ কি নির্মান করছে? আমাদের টয়লেট কারা পরিস্কার করছে? আমাদের যখন খারাপ লাগে তখন আর কাদের উপর আমাদের ঝাল ঝাড়ি? এদের ছাড়া কাদের নিয়ে হাসাহাসি করি বা নীচু করে দেখাই? তারা খুবই পরিশ্রমী এবং তাদের শুধু ধন্যবাদই প্রাপ্য আমাদের কাছ থেকে। কিন্তু আমরা তাদের উপর নির্যাতন করি, তাদের নীচু করে দেখি এবং জেলে পুরি। সবচেয়ে জঘন্য হচ্ছে আমরা তাদের নিয়ে ঠাট্টা মসকরা করি এবং “শ্রীলন্কান” এবং “ভারতীয়” শব্দদুটোকে আমরা “বোকা” এবং “মূল্যহীন” এর সমার্থক ভাবি।

    আলোচনা শুরু করুন

    লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

    নীতিমালা

    • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .