ব্লগারদের বিরুদ্ধে ‘ধর্ম অবমাননা'র অভিযোগ, তদন্তে সরকার

এই পোস্ট আমাদের বিশেষ কাভারেজ বাংলাদেশ শাহবাগ প্রতিবাদের অংশ।

ইসলামপন্থীদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ব্যাপক সংঘর্ষের মধ্যেই বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন কর্তৃপক্ষ ইসলামবিদ্বেষী ও রাষ্ট্রবিরোধী ব্লগারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে।

অনলাইন বার্তা সংস্থা টাইমসওয়ার্ল্ড২৪ডটকমের তথ্যমতে, পুরস্কারজয়ী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনসহ আরো তিনজনের ব্লগ বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশন (বিটিআরসি) নিষিদ্ধ করেছে। বিটিআরসি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্লগিং প্লাটফর্ম সামহোয়ারইনব্লগডটনেটের সাথে যোগাযোগ করে এই চারজনের ব্লগ সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। এরপরেই ওই চারজনের ব্লগ সরিয়ে ফেলে ব্লগ কর্তৃপক্ষ।

সামহোয়ারইনব্লগ তাদের ওয়েবসাইটে সরকারি নির্দেশ মেনে ওই চারজনের ব্লগ সরিয়ে ফেলার কথা স্বীকার করে একটা প্রতিবেদেনও প্রকাশ করে।

ফেইসবুক ও ব্লগে ইসলাম ও হযরত মুহম্মদ (সা.) কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যকারীদের শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নয় সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রন কমিশন বিভিন্ন ব্লগিং প্লাটফর্মকে ইসলামবিরোধী ব্লগগুলোকে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ করেছে।

ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরোধী প্রচার শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। এই আন্দোলন চলাকালেই ইসলামপন্থীরা অভিযোগ করেন ইসলামবিরোধী নাস্তিক ব্লগাররা শাহবাগে আন্দোলনের পেছনে রয়েছেন। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামাত-ই-ইসলামীর শীর্ষনেতাদের বিচার হচ্ছে।

ইসলামপন্থী সংগঠনের নেতারা জনসভায় শাহবাগে আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্লগারদের হত্যা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্লগার আহমেদ হায়দার রাজিব নিজ বাসার সামনে খুন হন। রাজিব বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে লেখালিখি করতেন।

মহিউদ্দিন প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী। তিনি শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছেন। ধর্ম ও ধর্মীয় রাজনীতির বিষয় তার লেখায় উঠে আসে। কিন্তু তার ব্লগিং যে ধর্মীয় সহিংসতাকে উস্কে দিয়েছে, তার কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ২০১৩ এর জানুয়ারি মাসে লেখালিখির কারণে তিনি আততায়ীদের হাতে মারাত্মকভাবে আহত। মহিউদ্দিনের ওপর আক্রমণের অভিযোগে পুলিশ ইতোমধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের নির্দেশ পেয়েই তারা মহিউদ্দিনের ওপর আক্রমণ করেছে।

ডয়েচে ভেলের সাথে এক সাক্ষাত্কারে সামহোয়ারইনব্লগের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দা গুলশান ফেরদৌস জানা বলেন:

সামহোয়ারইনব্লগের সাত বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ব্লগারদের শৃঙ্খলার জন্য লিখিত নির্দেশনা দেয়া হলো। ইমেইলে আসিফ মহিউদ্দিনের ব্লগ প্রোফাইলসহ তিনজনের নাম এসেছে। এবং আমাদের কাছে নির্দেশ এসেছে তাদের ব্লগগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়ার।

২০১২ সালে মহিউদ্দিনের ব্লগ ডয়েচে ভ্যালের বেস্ট সোশ্যাল অ্যাক্টিভিজম ব্লগ হিসেবে পুরস্কার জিতে। লেখালিখির কারণে তিনি এর আগেও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। ২০১১ সালে তিনি রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। সে সময়ে পুলিশ তাকে লেখালিখি বন্ধ করার উপদেশ দিয়েছিল।

Blogger Asif Mohiuddin. Image by Siam Sarower Jamil. Copyright Demotix (10/2/2013)

ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন। ছবি সিয়াম সারোয়ার জামিল। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১০/২/২০১৩)

ইসলাম, আল্লাহ এবং মহানবী (সা.)-কে অবমাননার অভিযোগে ২০ মার্চ ২০১৩ তারিখে নাটোরের একজন ব্যক্তি মহিউদ্দিনসহ আরো সাত ব্লগারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ৬ মার্চ ২০১৩ তারিখে একই ব্লগারদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামেও মামলা হয়েছিল। যদিও প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণের অভাবে বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেন।

মহিউদ্দিন তার সাম্প্রতিক ব্যান নিয়ে ফেসবুক নোটে লিখেছেন:

প্রায় প্রতিদিন ধর্মের পক্ষে অসংখ্য ব্লগে অসংখ্য লেখা পোস্ট হয়। অথচ অনলাইনে শুধুমাত্র “আমি প্রচলিত ধর্মে অবিশ্বাসী” এই কথাটুকু বলার অপরাধে অসংখ্য অশ্রাব্য গালিগালাজের সম্মুখীন হয়েছি।

একই পোস্টে কমিশন কর্তৃক ব্লগ বন্ধ করাকে ভয়ংকর নজির হিসেবে উল্লেখ করেন:

কোন ব্লগারের লেখা সেই ব্লগটির নিজস্ব আইন অনুসারে বেআইনী মনে হলে বা শর্তাবলী লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে হলে ব্লগ কর্তৃপক্ষই তার সিদ্ধান্ত নেবে। ব্লগ কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে স্বাধীন এবং কোন লেখা থাকবে আর কোন লেখাটি থাকবে না, তা সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব কোনভাবেই কোন ক্ষমতাশালী মহলকে দেয়া যাবে না। ভেবে দেখুন, আজ এই অজুহাতে কারো ব্লগ সরকার বন্ধ করে দিতে সক্ষম হলে সরকার ভেবে নেবে ব্লগারদের তারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। তাই কাল আরেকজন ব্লগারের ব্লগও তারা বাতিল করার আবদার তুলবে। কোন সরকারই অনন্তকাল থাকবে না, আগামিতে কোন ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ক্ষমতায় চলে আসলে পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে?

ডয়েচে ভেলের সাথে এক রেডিও সাক্ষাত্কারে মহিউদ্দিন জানিয়েছেন, তিনি ব্লগিং ছেড়ে দিবেন না।

Stop authoritarian aggression against bloggers. Blogging is our right. Image courtesy Asif Mohiuddin

“ব্লগারদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারী আগ্রাসন বন্ধ করুন। ব্লগিং আমাদের অধিকার।” ছবি আসিফ মহিউদ্দিনের সৌজন্যে।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বিদ্যমান। এখানে শরিয়া বা ব্লাসফেমি আইন নেই। যদি কেউ নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করেন, তাহলে রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকের মতো একই নাগরিক অধিকার লাভের অধিকারী। বাংলাদেশ পেনাল কোড (১৮৬০) এর ২৯৫এ ধারামতে, কোনো ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অথবা বিদ্বেষপরায়ন হয়ে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

কমিশন জানিয়েছে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তথ্যপ্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে টেলিযোগাযোগ লাইসেন্সধারী, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য পাওয়ার এখতিয়ার তাদের রয়েছে। মার্চের ২২ তারিখে আমার ব্লগ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেখানে তারা জানায়, সরকারের অনুরোধে ব্যক্তিগত তথ্য দিলে ব্লগাররা বিপদগ্রস্ত হবে। ব্লগারদের ব্যক্তিগত তথ্য চাওয়ার আইনগত অধিকার কমিশনের আছে কি না, তারা এও প্রশ্ন করেন। উল্লেখ্য, আমার ব্লগ যুক্তরাজ্য নিবন্ধন করা। এবং দেশের বাইরের সার্ভার থেকে এটি পরিচালিত হয়।

ব্লগাররাও কমিশনের এ ধরনের অনুরোধের আইনগত যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ব্লগার মোহাম্মদ মুনিম মুক্তাঙ্গনে কমিশনের সমালোচনা করে লিখেন:

বাংলাদেশের সংবিধানে মত প্রকাশের পূর্ণ মৌলিক অধিকার সকল নাগরিককেই দেওয়া হয়েছে। [..] BTRC নামের তথাকথিত স্বাধীন এই কমিশনটির হাতে যে-কোন ব্লগ বা ওয়েবসাইট বন্ধের সুইচ থাকলেও সে-সুইচের ব্যবহার দেশের সংবিধান মেনেই করতে হবে, কোন কর্তাব্যক্তির খেয়ালখুশিমতো নয়।

ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট রায়হান রশীদ ফেসবুকে লিখেছেন, ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে সরকার স্বাধীন চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে:

বিটিআরসি'র সাম্প্রতিক এই অপতৎপরতার সাথে কোথায় যেন জামাত-শিবিরের শাহবাগ আন্দোলনকে “নাস্তিকদের আন্দোলন” হিসেবে সুযোগসন্ধানী ব্র্যান্ডিংয়ের মিল আছে। জামাত-শিবিরের দরকার ছিল শাহবাগ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, আর সে লক্ষ্যে তারা ১৯৭১ এর মতোই অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে ধর্মীয় উম্মাদনা, আর বিভাজন-বিদ্বেষকে। সরকার বা বিটিআরসি'রও একটা সুযোগ দরকার ছিল যাকে পূঁজি করে স্বাধীন চিন্তার এই শেষ প্লাটফর্মগুলোকে কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা যায় – এখানেও নাস্তিকতা, ধর্মীয় অনুভুতি ব্যবহৃত হচ্ছে সুযোগসন্ধানীর অস্ত্র হিসেবে।

ব্লগার ফারহানা আহমেদ মুক্তমনা ব্লগে নাস্তিক এবং প্রগতিশীল অনলাইনকর্মীদের টার্গেটে পরিণত হওয়ার পেছনের কারণ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন:

আমার মনে হয়, এই রকম ঘটার পেছনে দুটো বিষয় কাজ করছে। প্রথমটা অনেকটা তাত্ত্বিক, নাস্তিকদের নিয়ে ধর্মব্যবসায়ী বা অ-ব্যবসায়ী দু’শ্রেণীর এস্টাব্লিসমেন্টের পক্ষের লোকজনের মনে সন্দেহ ব্যাপক। এসটাব্লিসমেন্টের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ধর্ম অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, কখনো কখনো তা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী, রাষ্ট্রকেই ধর্মের মদদ নিতে হয়। এসটাব্লিশমেন্টের অন্য স্তম্ভগুলোও ধ্বসে পড়ার উপক্রম হলে মদদ মাঙ্গে ধর্মের। [..] বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া, অতিপ্রাকৃত শক্তির ভয়ে ভীত করে রাখা—এইসব অস্ত্র ব্যবহার করে ধর্ম তার কার্য হাসিল করে। নারী পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠলে, ধর্মই তাকে ঠান্ডা করে; মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিক যেতে পারে না, কারণ আল্লাহ যাকে এই যামানায় কিছু দেননি, আখেরাত তো তারই জন্য। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহজ ব্যবহার্য অস্ত্র হলো ধর্ম।

তিনি আরো বলেন:

দ্বিতীয় দিকটা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত। নাস্তিক মরলে বা মার খেলে তার প্রতি যে ঔদাসীন্য দেখাচ্ছেন আন্দোলনের সহযোদ্ধারা তাতে করে নাস্তিকরা জামাত-শিবির-হি্যবুতের সবথেকে সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছেন।

সর্বশেষ: সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী নয় সদস্য বিশিষ্ট কমিটি দেশের আলেম সমাজের সাথে বৈঠকে বসেছেন। সেখানে আলেমরা ইসলাম ধর্ম ও মুহাম্মদ সা. আপত্তিকর মন্তব্যকারী ব্লগার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী ৮৪ জনের তালিকা কমিটির কাছে হস্তান্তর করে। কমিটি আলেম সমাজের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ চেয়েছে। কমিটি ধর্ম অবমাননার অভিযোগ পেশ করার জন্য একটি ইমেইল অ্যাকাউন্ট খুলেছে।

এই পোস্ট আমাদের বিশেষ কাভারেজ বাংলাদেশ শাহবাগ প্রতিবাদের অংশ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .