মিয়ানমারঃ রাখাইন গ্রাম আক্রান্ত

একজন রাখাইন মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যার সংবাদে মিয়ানমারের রাখাইনের মং তাউ- এ ব্যাপক দাঙ্গা হয়।

গত ২৯ মে সকালে ঘাড়, কান ও গলায় আঘাতের ক্ষত চিহ্নযুক্ত মৃতদেহটি পাওয়া যায় [বার্মীজ]।

দ্রুতই তিনজন সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু অনেকের ধারনা বিচারিক কার্যক্রম শম্ভুক গতিতে চলছে। স্থানীয় প্রশাসনিক কার্যালয় ও থানার সামনে প্রায় ৭০০ রাখাইন বিক্ষোভ [বার্মীজ] করে।

এর কিছুদিন পর নয়জন মুসলিমকে বাস আক্রমনে হত্যা [বার্মীজ] করা হয়। সতর্ক অবস্থায় থাকা লোকজন ভুলক্রমে মনে করেছিল যে শিশুটির ধর্ষণকারী বাসে আছে।

ঘটনার বর্ণনার সময় সরকারি পত্রিকা  ‘কালা’ শব্দ প্রয়োগ করেন। ইয়াঙ্গুনের মুসলিম সম্প্রদায় এ শব্দ ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন। তাঁদের মতে শব্দটি অপমানজনক।

নেটিজেনরা সক্রিয়ভাবে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সহিংসতার ঘটনায় অনেকেই হতাশ, অনেকে প্রতিশোধের নির্বুদ্ধিতার বিষয়ে লিখেছেন, অনেকেই আবার জনগণকে ধর্মীয় বিরোধ ও অভিবাসী ইস্যুকে গুলিয়ে না ফেলার আবেদন জানিয়েছেন।

কিছুদিন আগে, রাখাইনে একদল সন্ত্রাসী উন্মুক্ত এলাকায় হামলা চালায়। এ দাঙ্গা সম্পর্কে নেইং থু অং লিখেন [বার্মীজ]:

শুক্রবারে মুসলিম জনতা খিয়াওউত মসজিদে নামাজের পর  বের হয়ে এসে একটি গেস্ট হাউজ ও বেসরকারি ব্যাংকের ছাদ ধ্বংস করে। দুপুরে তারা আরও অনেকগুলো গেস্ট হাউজ ও খাবারের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ আগুন নিকটস্থ গ্রাম বো মু তে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের দুটি বাড়িও আগুনে ভস্মীভূত হয়। সন্ত্রাসীরা ইয়েই মায়েইং গ্রাম ও শয়ে ইন আয়ে গ্রামের বৌদ্ধ মন্দিরেও আক্রমণ করে।

সরকারি হাসপাতালেও আগুন লাগানো হয়, হাসপাতালের কর্মচারীরা রোগীদের দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে রক্ষা করেন। হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা পালিয়ে [বার্মীজ] বৌদ্ধ মন্দিরে আশ্রয় নেন। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী এ সংঘাতে আট জন প্রাণ হারিয়েছেন

রাখাইন গ্রাম জ্বলছে: ছবি- ইলেভেন মিডিয়া গ্রুপের ফেসবুক পাতা থেকে

সহিংসতা বিষয়ে মিয়ানমারের নেটিজেনরা ব্লগে আলোচনা করেছেন:

উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের জন্য মিয়ানমার সরকার সামরিক বাহিনীকে প্রেরণ করেছেন কিন্তু নেটিজেনদের মতে, পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর মু তাও এ সরকার সামরিক আইন জারি করেন।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা  এ আক্রমণের দ্রুত নিন্দা জানিয়েছেন। বাঙালি অভিবাসনকারী, যাদেরকে এ আক্রমণ শুরু করার জন্য দায়ী করা হয় – তাদের প্রতি বেশিরভাগ ফেসবুক ব্যবহারকারী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ডেমো অয়াইয়ান নামের একজন অনলাইন সক্রিয়তাবাদী  রাখাইন জনগণের আরও নিরাপত্তা প্রদানের দাবি [বার্মীজ] জানিয়েছেন:

আমি মনে করি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থানীয় রাখাইনদের প্রতি এটা একটা অপমান। আশা করি সশস্ত্রবাহিনী আমাদের রাখাইন নৃ গোষ্ঠীকে রক্ষা করবে। এটা করে আপনারা আপনাদের সুনামকে সমুন্নত রাখুন। জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে জনগণ আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। আমি  অনুরোধ করছি রাখাইন জনগণের স্থানীয় নিরাপত্তার জন্য আরও অধিক সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করা হোক।

জনগনের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে খ্যাও ইয় খিনে বলেন:

আত্ম রক্ষার অধিকার আমাদের আছে। আমি আশা করি দাস্ক [দাও অং সান সু চি] বুঝবেন যে বিষয়টা সংখ্যালঘুদের দোষারোপ করার বিষয় নয়। তাঁরা কোনভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য নয়। এটা নিছক সার্বভৌমত্ব ইস্যু, এটা কেবলি সন্ত্রাস এবং তাঁরা আমাদের স্বাধীনতার শত্রু।

গত জানুয়ারিতে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া এইট এইট জেনারেশনের নেতৃবৃন্দ বলেন রোহিঙ্গাদের (বাঙালি অভিবাসী) মিয়ানমারের নৃ জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা উচিত নয়। কো কো গাই নামের একজন রাজনৈতিক নেতা বলেন [বার্মীজ],  তাঁদের নাগরিক অধিকার থাকতে পারে যদি তাঁরা প্রমান করতে পারে যে দীর্ঘ দিন থেকে তাঁরা মিয়ানমারে বসবাস করে, এবং যদি তাঁরা দেশের একমাত্র নৃ গোষ্ঠীর ভাষায় কথা বলতে পারে। [ নোট: এটা মিয়ানমারের বাইরে যারা থাকেন তাঁদের চিন্তার সাথে মিল খুজে পাওয়া যায় যে তারা মনে করেন রোহিঙ্গা জনগণ জগতের অত্যন্ত কষ্টকর অবস্থায় থাকা সংখ্যালঘু।]

অন্যদিকে প্রবাসী প্রচার মাধ্যম ও কিছু  বড় প্রচার মাধ্যম যেমন চ্যানেল নিউজ এশিয়া এ আক্রমণকে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করায় কিছু নেটিজেন এ বিষয়ে মর্মাহত হয়েছেন। মূল ধারার প্রচার মাধ্যমে বেঠিক প্রতিবেদন করায় মোয় সেট সমালোচনা করেন:

 মিয়ানমারের কট্টর জাতীয়তাবাদী এবং সামাজিক সক্রিয়তাবাদীরা এ ধরনের বর্ণ বাদী উত্তেজনার ক্ষেত্রে প্রধান লবিস্টের ভুমিকা পালন করে বলে বিখ্যাত বহিষ্কৃত প্রচার মাধ্যমের  গ্রুপগুলো মনে করে। কো কো কাই সতর্ক করেন যে এ ধরনের গোলমেলে পরিস্থিতিতে বহিঃ শক্তির চাপ নিয়ন্ত্রকের ভুমিকা পালন করতে পারে।  মিয়ানমার সরকারের একজন কর্মকর্তা তাঁর অফিসিয়াল ফেসবুক পাতায় অনুরোধ করেছেন যে প্রবাসী বার্মিজ প্রচারমাধ্যম গুলোর এ দাঙ্গা কে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বলে আখ্যায়িত করা উচিত নয়।

কিছু সংখ্যক  বার্মিজের ফেসবুকে এ ধরনের প্রচার মাধ্যম গ্রুপ ও লবিস্টদের বয়কট করার আহবান দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে।

এ ধরনের আন্তর্জাতিক (transnational) সমস্যা নিছক ধর্মীয় সংঘাত নয় বরং এ সমস্যার সিংহ ভাগ মিয়ানমারের অভিবাসন ব্যুরো কর্তৃক সৃষ্ট মর্মে  রাজনৈতিক সক্রিয়তাবাদীরা গুরুত্ব আরোপ করেন।  তাঁরা বলেন মং দাও এ স্থানীয় রাখাইনরা (আরাকানিজ) দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিবাজ সীমান্ত রক্ষীদের নির্যাতনের শিকার।

যদিও মিয়ানমারের নেটিজেনদের মধ্যে টুইটার কোন জনপ্রিয় অনলাইন প্রচার মাধ্যম না তারপরেও বিস্ময়করভাবে নেটিজেনরা রাখাইনের দাঙ্গার বিষয়ে তাঁদের মতামত,  দৃষ্টি ভঙ্গী আলোচনার জন্য টুইটারের আশ্রয় নিয়েছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য নেটিজেনরা # মিয়ানমার অথবা #বার্মা, #রোহিঙ্গা এবং # রাখাইন হ্যাস্ট্যাগ ব্যবহার করছেন। আক্রমন সম্পর্কে এখানে কিছু টুইট তুলে ধরা হল।

@মেনেইন ঃ #রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হলে কি করে তাঁরা সশস্ত্র হল?? কোথা থেকে তাঁরা  অস্ত্রগুলো পেল?? এটা পরিষ্কারভাবেই # সন্ত্রাসী হামলা।

@নায়ান্থুলিন: আশা করি #মিয়ানমার #বার্মাতে # রাখাইন জনগোষ্ঠী নিরাপদেই আছে ! আমাদের পক্ষে থাকুন #বিবিসি #সি এন এন # আলজাজিরা ! দয়া করে …সঠিক  প্রতিবেদন দিন!

@ফরগেটমিফ্রেড:  @ক্যাপ্টেন_ আমারিতো সত্য হল এই যে হাজারও #বাঙালি যারা #রোহিঙ্গা নামে পরিচিত তাঁরা একত্রিত হয়ে বহু স্থানীয় মানুষের ঘর-বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে, #রাখাইন #মিয়ানমার।

@তেজার৪৪: বিদেশী প্রচার মাধ্যমগুলো কেন বলছে যে #রোহিঙ্গারা আক্রান্ত??? কেন? আসলে তাঁরা বেসামরিক নাগরিকদের আক্রমণ করছে…

@থান্ট: তাঁরা সন্ত্রাসী, প্রতিবাদকারী নয়, বাঙ্গালিদের মদতে তাঁরা সশস্ত্র এবং #রাখাইন উপজাতিরা এখন আক্রমণের শিকার। #বিবিসি মিথ্যা বলেছে। # মিয়ানমার

রাখাইন রাজ্যের মং তাও ও বু শহরের অধিবাসীদের নিরাপত্তার বিষয়ে নেটিজেনরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মিন থিয়েন রাখাইনে আক্রান্তদের বিষয়ে উদ্বিগ্ন [বার্মীজ]:

আমি বলছি যে আমি ঘুমাতে যাব কিন্তু পারছি না। ভয় ও শংকা নিয়ে তাঁরাও ঘুমাতে পারবে না।

সু ম্যাত একই ধরণের বার্তা পোস্ট করেছেন:

আমাদের ভাইবোনেরা যখন নরকের অনুভূতিতে বাস করছেন তখন কি করে আমরা আজকের রাতে ঘুমাবো?

মং তাও ও বু থি থাং শহরে মিয়ানমার সরকার ইতোমধ্যেই সামরিক আইন জারি করেছেন। মু জাউ নামে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা জনগণকে আশ্বস্ত[মিয়ানমার] করেছেন যে সরকারের সশস্ত্র বাহিনী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্থানীয় রাখাইনদের রক্ষা করবে। অসমর্থিত সংবাদে জানা গেছে যে ইয়াঙ্গুনে জনগন বাঙালি দাঙ্গার বিষয়ে বিক্ষোভ করবে। কো জন তাঁদের সতর্ক [বার্মীজ] করে বলেন যে ধর্মীয় বিরোধ সরকারের সাম্প্রতিক সংস্কারকে ব্যহত করতে পারে:

এধরনের প্রতিবাদ ইয়াঙ্গুনের মুসলিমদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তাঁরা বাঙালি/ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে।

মনে হচ্ছে প্রবাসী প্রচার মাধ্যম ধর্মীয়/ নৃ তাত্বিক বিরোধের বিষয়ে বেঠিক সংবাদ ছড়াচ্ছে।

এ ধরণের মাথা গরম করা কাজ দেশের ভালো সংস্কারকে উল্টো পথে পরিচালিত করতে পারে।

দ্রুত আক্রান্ত রাখাইন নৃ গোষ্ঠীকে সাহায্য একতা ধরে রাখার বিষয়ে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন:

কাজেই আমি সবাইকে অনুরোধ করছি এ ধরণের বিক্ষোভ করবেন না। তার পরিবর্তে সেটাই কি ভালো হবে না যদি আমরা রাখাইন নৃ গোষ্ঠীর পাশে দাড়াই?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .