ইথিওপিয়া: দুর্নীতির দুর্নাম

গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে গত এক দশকে অবৈধ অর্থ পাচারের মাধ্যমে ইথিওপিয়ার ১১.৭ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। শুধু ২০০৯ সালেই এই ক্ষতির পরিমাণ ৩.২৬ বিলিয়ন ডলার। এটা ইথিওপিয়ার ওই বছরের মোট রপ্তানি এবং উন্নয়ন সাহায্যের পরিমাণের চেয়েও বেশি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার দিন দিন বাড়ছে।

উক্ত রিপোর্টে অর্থ পাচারের কাহিনি সাদামাটা ভাষার চেয়ে চিত্রে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে:

ইথিওপিয়ার মানুষরা রক্ত শুকিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে। তারা চরম অসহায় অবস্থা পতিত, দারিদ্র্যও সীমাহীন। তারা সেসবের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সেটা ঘটনা না। ঘটনা হলো তাদেরকে মূলধনী অর্থের অবৈধ পাচার হওয়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

মেলিস জেনাউয়ি (ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী)

মেলিস জেনাউয়ি (ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী) মে ২০১০ সালে তানজানিয়ার দার উস সালামে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে। ছবিটি প্রাপ্ত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সৌজন্যে। (সিসি বাই-এসএ ২.০)

দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক জেনিস উইন্টার ডেইলি মাভেরিক -এ একটি মতামতধর্মী লেখা লিখেছেন। লেখার শিরোনাম- ‘ইথিওপিয়ার বিদ্যমান দুর্নীতি‘। সেই লেখার ইথিওপিয়ার নাগরিক এবং বাইরের লোকেরা মন্তব্য করেছেন। জেনিস তার লেখায় ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিকে উপজীব্য করে সবুজ জলবায়ু তহবিল (গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড) অনুমতি দেয়ার আগে মেলিস জেনাউয়ির শাসনকালের তদন্ত চেয়েছেন। ডারবানে অনুষ্ঠিত সিওপি১৭ এ সবুজ জলবায়ু তহবিলের অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।

সবুজ জলবায়ু তহবিল হলো উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অর্থ প্রেরণের একটি প্রক্রিয়া। যাতে এই অর্থ ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি সমূহ মোকাবেলা করতে পারে।

জেনিসের লেখার প্রতিক্রিয়ায় পিটার আউল্ড বলেন:

এটা জানা কথা যে, আপনি যদি একনায়ককে টাকা দেন, সে আরো একনায়ক হয়ে উঠবে এবং একনায়ক থেকে যাবে।

আশার কথা যে সবুজ তহবিল শূন্যের কোঠায় থাকছে। এবং আফ্রিকার ভিক্ষার ঝুলিও আগের অবস্থাতেই থাকছে।

গ্যাবে এ আদামউ জেনিসের প্রশংসা করেছেন:

সঠিক বিবরণী প্রদান করায় মিস উইন্টারকে সম্মান জানাই। খুবই বিরক্ত লাগে যখন দেখি রক্তচোষা স্বৈরশাসকের নির্দেশে শান্তিপূর্ণ বিরোধীদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি করছে, পশ্চিমের আর্শীবাদপুষ্ট স্বৈরশাসনের নিন্দা করায় সাংবাদিক এবং বিরোধী দলীয় নেতাদেরকে জেলে পুরছে। তার আচরণ একনায়ক মুগাবের মতো। যদিও মুগাবের মানবাধিকার লংঘনের রেকর্ড মেলিসের চেয়ে কম। আরো বেশি বিরক্তির উদ্রেক হয় যখন শুনি পশ্চিমা নেতারা এবং কিছু নীতিনির্ধারণী গ্রুপ তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে আসন পেতে দেয়। আর এতে করে স্বাধীন সাংবাদিকরা পশ্চিমা নেতাদের বানানো মিথ থেকেই প্রশ্ন করে। পশ্চিমের অলস সাংবাদিকরাও সেই গ্রুপ থেকে শোনা কথাই তোতাপাখির বুলির মতো উগরে দেয়।

আল মারিয়াম নামের ইথিওপিয়ার বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জেনিসের লেখায় প্রতিক্রিয়ায় ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তার ‘ইথিওপিয়া: দ্য আর্টস অব ব্লিডিং অ্যা কান্ট্রি ড্রাই: ইথিও-করাপশন, ইনকর্পোরেট (আনলিমিটেড)‘ লেখায়। তিনি লিখেছেন:

আমি দীর্ঘ যুক্তি দিয়ে বলেছি যে, আফ্রিকান একনায়কদের ব্যবসাই হলো দুর্নীতি করা। দুর্নীতির প্রভাবে এ মহাদেশের দরিদ্র মানুষেরা ধংস হচ্ছে। স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তা এবং অন্যান্য সরকারি ও কমিউনিটি প্রজেক্টের কাজের টাকা স্পষ্ট ভাবেই রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ইথিওপিয়ার ব্যাপক আকারের দুর্নীতির মধ্যে রয়েছে সরকারি তহবিল থেকে অর্থ চুরি ও আত্মসাৎ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির অপব্যবহার ও আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ নেয়া, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও যথাযথ নিয়োগে ঘুষ দেয়া-নেয়া। ইথিওপিয়ার দুর্নীতির গল্প শুনলে আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তাররা রোগীদের চিকিৎসা করতে পারেন না ঔষধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ব্যক্তি মুনাফা খাতে স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে। দরিদ্র জনগণের জন্য দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্রের ঔষধপত্র ও চিকিৎসা সামগ্রীর ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, বড় অংকের ঘুষ না দিলে অথবা তাদের ব্যবসায়িক অংশীদার না করলে তারা ব্যবসার অনুমতি ও লাইসেন্স পান না।

মূলুগেটা কাসা নামের একজন অবশ্য জেনিস এবং আল মারিয়ামের সাথে একমত নন:

জেনিস এখানে এসেছেন তার উদার চিন্তা থেকে। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আফ্রিকান ইস্যু নিয়ে মেলিস জেনাউয়ির কাছে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জুমা ম্লান হওয়ায় একজন দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে তার পরশ্রীকাতর দৃষ্টিভঙ্গি বের হয়ে পড়েছে। মেলিসকে নিয়ে তার অপপ্রচার এবং বিদ্রুপ উদারনীতি প্রত্যাখান করা একজন অবিচল আফ্রিকান নেতার ওপর নিও-লিবারেলদের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। জেনিস উইন্টার ও তার হতবিহ্বল সমর্থকদের ক্রোধ ও বিরক্তির বেশিরভাগই এসেছে অর্থনৈতিক উদারিকরণে আস্থা না রাখায়। ইথিওপিয়ায় বর্তমানে বহুদলীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। এখানে সীমাহীন স্বাধীনতার নামে গণতন্ত্র বাস্তবায়নকে বাধা দেয়া হয় না। এরপরেও কেউ কেউ মেলিসকে একনায়ক দাবি করে পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য দাবির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

মূলধারার মিডিয়াগুলো এই ইস্যুতে সংবাদ প্রদান অব্যাহত রেখেছে। ইথিওপিয়ার ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এই বিতর্কে যোগ দিয়েছে। ইথিওপিয়ার নির্বাসিত সাংবাদিক আবি টেকেলমারিয়াম সেই গল্প লিখেছেন:

আমাদের উদার উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আমাদের সম্পদ ধনী দেশগুলোর সাথে ভাগ করে নিচ্ছেন।

তাসেমা বিলে নামের আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী আবি’র স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন:

হ্যাঁ, আমরা রক্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছি। দুঃসহ যন্ত্রণার গল্প চলছেই…

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত আরেক সাংবাদিক তার ফেসবুক পাতায় পোস্ট করেছেন:

কিছু ইথিওপিয়ান কর্তৃক নির্মাণ সরঞ্জাম ডাকাতির ঘটনা তদন্ত শেষে চীনা নির্মাণকর্মী বলেন, “ইথিওপিয়ানদের কোথাও একটা দেশ আছে, যাকে বলে ইথিওপিয়া। এখানে আনুমানিক ১১.৭ বিলিয়ন ডলার অর্থ অবৈধ উপায়ে পাচার হয়। ইপিআরডিফিটসকে জিজ্ঞেস করুন। “এটা ইটিভোপিয়া” সত্যিকারভাবে যার ভৌগলিক অবস্থান মালয়েশিয়া এবং আরব দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে?

কাম্পালার মানবাধিকারকর্মী কিফলু হোসাইন তার পোস্টে নিচের মন্তব্য করেন:

উগান্ডার প্রতিদিনের দুর্নীতির সংবাদ আছে, কিন্তু ইথিওপিয়ার দুর্নীতির কোনো সংবাদ নেই। কিন্তু কেন? এই কারণে যে, জোয়াকিম বিউইমবোর মতো সম্প্রতি নিজেকে খোলাখুলি প্রকাশ করেছেন, যা মেলিস অ্যান্ড কোং-কে নিখুঁত করেছে। না কি এই কারণে যে, সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে? সমালোচনা শেষে সম্ভবত আমি শুরু করেছি একটা শব্দ বা দুটো টাইটেল লিপিবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে- “কাম্পালার দুঃখভারাক্রান্ত রাষ্ট্র থেকে এডিস এবং কিগালি দেখছি।” এটা আমাদের ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে যে, সরকারের অস্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে কৌতুককর তুলনা থেকে টিমোথি কালিগিরা সঠিক জায়গায় পাওয়া যাবে কি না!

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক দুর্নীতি ধারণা সূচক (সিপিআই) অনুসারে সারাবিশ্বের ১৮২ দেশের মধ্যে ইথিওপিয়ার অবস্থান ১২০তম।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .