পাকিস্তান: আসিয়া আর আফিয়া – দুইজন পাকিস্তানী নারীর গল্প

যখন পুরো বিশ্ব আসিয়া বিবির ধর্মের প্রতি অসম্মান জানানোর ঘটনায় গভীর ভাবে নাড়া খেয়েছে, পাকিস্তানিরাও এই বিতর্কিত বিষয় নিয়ে একই ভাবে বিব্রত। জাতির মনে পড়ছে ডঃ আফিয়ার কথা আর পাকিস্তানী মিডিয়া আর নাগরিকরা এই দুজনের তুলনা করছে যেহেতু দুটো ঘটনাই সাম্য আর ন্যায়ের ধারনাকে অস্বীকার করে।

জানা যাচ্ছে যে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী নিজেদের আসিয়া বিবির কেসে চিন্তিত হয়ে পড়ছেন (পাকিস্তানী একজন খ্রিষ্টান নারী যাকে ধর্মকে অবমাননা করা অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে) একইভাবে যেমন আফিয়া সিদ্দিকির আটকের সময়ে তারা দু:খিত হয়ে পড়েছিলেন (আমেরিকার জেলে ৮৬ বছর ধরে বন্দী)। কিন্তু এটা দু:খজনক যে ঘৃণার বাণী একাত্মতার বাণীর থেকে দ্রুত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

হারিস খালিক তার কলামে লিখেছেন:

“আজকে, পাকিস্তানী মুসলিম যারা অনিরাপদ একটা রাষ্ট্রে আর ভগ্ন সমাজে বাস করছেন এবং আফিয়া সিদ্দিকি আর আসিয়া বিবি – এই দুইটা সীমার মধ্যে দোল খাচ্ছেন। আফিয়া সিদ্দিকির মামলাকে জনগণের সামনে সঠিক ভাবে বিচার করা খুবই কঠিন। কতো জন রাজনীতিবিদ বা মতামত প্রদানকারীর নেতার সাহস আছে এগিয়ে এসে কথা বলার, যখন সবাই যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে তার মুক্তি চাচ্ছে।“

পাকিস্তান অবজারভারে এই ব্যাপারে আমি আগে লিখেছি:

আসিয়া বিবি (৪৫) পাঁচ সন্তানের জননী এবং পাকিস্তানী একজন খ্রিষ্টান। তিনি ধর্মকে অপমান করার জন্য গ্রেপ্তার হন। দেড় বছর ধরে তিনি জেলে আছেন আর নভেম্বর ৮, ২০১০ তারিখে স্থানীয় এক আদালত নবী মোহাম্মদকে অপমান করার জন্য তাকে ফাঁসির সাজা দিয়েছে ধর্মকে অপমান করার আইনের অধীনে।

বৃহষ্পতিবার প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারীকে দেয়া একটা রিপোর্টে সংখ্যালঘুদের ফেডারেল মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি সুপারিশ করেছেন যাতে আসিয়া বিবিকে জেল থেকে মুক্ত বা ক্ষমা করা হয় যদি তার ঝুলন্ত আদালতের আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি না হয়। মন্ত্রী দেশটার বির্তকিত ধর্মকে অবমাননা করা আইনের কিছু সংস্কারও প্রস্তাব করেছেন।

এই রিপোর্টের পরে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট, মানবাধিকার সংস্থা, সংবাদ পত্র আর যে রাজ্যে বিবি অভিযুক্ত হয়েছিলেন তার গভর্নর ক্ষমার আহ্বান জানিয়েছেন,
আর তিনি ধর্মের নামে অপপ্রচারের জন্য ফাঁসি প্রাপ্ত প্রথম নারী হচ্ছেন।

আসিয়া বিবির মামলাকে ডঃ আফিয়া সিদ্দিকির সাথে তুলনা করলেও, একটাকে অন্যটার থেকে একেবারে আলাদা। তবে দেখা যাচ্ছে কিন্তু বেশকিছু পাকিস্তানী নাগরিক আর মানবাধিকারকর্মীরা বিশ্বাস করেন যে এই দুইটা ঘটনা আলাদা না যেহেতু দুইটাই অসামঞ্জস্য, অন্যায় আর সমাজের অবিচার নিয়ে গঠিত।

গন নীতি ব্লগের লেখক আহমেদ কুরেইশি মন্তব্য করেছেন:

“আসিয়া বিবি আমাদের বোন আর ভুল একটা মামলায় তার আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। কিন্তু তার কেসের অগ্রধারীদের মুসলমান পন্ডিত হতে হবে যারা জানেন যে আসলেই ইসলাম কতোটা সহিষ্ণু আর খোলা মনের ।“

তিনি রাষ্ট্রের নীরবতার কথাও বলেছেন আর অনেক সরকারী কর্মকর্তার কথা যারা ধর্মকে অপমান করা ব্লাসফেমি আইন বিলুপ্ত করতে চান এখন কিন্তু ডঃ আফিয়া সিদ্দিকির সাথে করা অন্যায়ের সময়ে তারা কোন কথা বলেননি।

এক্সপ্রেস ট্রিবিউন এর সম্পাদকীয় অনুসারে:

“সংখ্যালঘুরা লাগাতার চাপের মধ্যে আছেন এই গভীর ভুল আইনের কারনে আর কেউ হয়তো এতো কষ্ট প্রকাশ করবেন না আমরা যেভাবে করে থাকি আমেরিকার জেল থেকে আফিয়া সিদ্দিকির মুক্তির জন্য।“

ফারুখ খান পিতাফি ডেইলি টাইমসে লিখেছেন:

“আমি আপনাদের মনে করিয়ে দেই যে আমি সেই কয়েকজন কম লেখকের মধ্যে পড়ি যারা ডঃ আফিয়া সিদ্দিকিকে এই জাতির কন্যা বলেছিলেন। কিভাবে আপনারা মনে করতে পারেন যে আসিয়া বিবি তা নন?”

প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির উপরে চাপ বাড়ছে একজন খ্রিষ্টান নারীর ভাগ্য নির্ধারনের জন্য যাকে সম্প্রতি ধর্মের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। কারন এই মামলা আর্ন্তজাতিক সমাজের দৃষ্টি আকর্ষন করেছে আর দেশে গণবিক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। প্রণয়নের সময় থেকে পাকিস্তানের ধর্ম রক্ষাকারী ব্লাসফেমি আইনকে বিশ্বব্যাপি তিরস্কার করা হয়েছে। গত সপ্তাহে পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট বিবির মুক্তির আহ্বান জানান আর বলেন যে পাকিস্তানে খ্রিষ্টানরা ‘প্রায় পক্ষপাতদুষ্ট তা আর খারাপ আচরনের শিকার’ হন।

বেশ কিছু পাকিস্তানীর মন্তব্য ব্লাসফেমি আইনকে তিরস্কার করে আর আসিয়ার সমর্থনে পাকিস্তানীদের সুস্থির চিন্তার প্রতিফলন।

প্রকট ব্লাসফেমি আইনের তিরস্কার করে, ফারুখ লিখেছেন:

“প্রথমত, এমন কোন আইন যেখানে রাষ্ট্র কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখায় তা বিপরীতমুখী হয় গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের জন্য। দ্বিতীয়ত, আমি অনুরোধ করবো যারা বলেন এটাই ইসলামী আইন তাদেরকে পবিত্র কোরানে এর স্থান দেখাতে। তারা যদি তা না পারেন, তাদের বোঝা উচিত যে এটাই স্লামের আত্মা আর স্বার্থের পরিপন্থী। শেষে, যতদিন ব্লাসফেমি আইন থাকবে, এটা সমাজকে বিভক্ত করবে আর এর ফলে আইনের অপব্যবহার হতে থাকবে।“

আমাদের যেটা জানা দরকার তা হলো ‘মানবিকতা সব আইনের উপরে’ আর যেসব জাতি মানবিকতাকে সম্মান করেনা তারা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে বাধ্য। যেমন পাকিস্তানি সাংবাদিক মাহতাব বশির বলেছেন তার ‘আসিয়া বিবি, ব্লাসফেমি আর প্রধান বিচারপতি’ শীর্ষক পোস্টে:

“সামাজিক মনোভাব, পক্ষপাতিত্বের আইন আর অসহনশীল বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গী যা আমাদের সমাজে বাড়ছে তা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়া দরকার। ব্লাসফেমি আইনকে পালটানো উচিত। পাকিস্তানীদের বুঝতে দেয়া উচিত যে ধর্মীয় উন্মাদনা যা থেকে হত্যা আর অন্যদের বিশ্বাস ও ধর্ম সম্পর্কে অবজ্ঞা তৈরি করে আমাদেরকে অন্ধকার যুগে ঠেলে নিয়ে যাবে যদি না এইসব ভয়ঙ্কর ধারা আমরা না পাল্টাই।“

অনেক পাকিস্তানি ও এটা বিশ্বাস করেন যে ব্লাসফেমি আইন আসলেই ইসলামী মূল্যবোধের সাথে আর হয়রত মহাম্মদ (সাঃ) এর শিক্ষার সাথে এক না যিনি সহনশীলতা, ন্যায় বিচার আর সমতার অগ্র ধারক ছিলেন।

আয়শা সিদ্দিকা তার কলাম ‘ঋণাত্মক ভাবনার বেদীতে বলী’ তে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন:

বাস্তবতা হলো যে আমাদের সমাজে আর সামাজিক প্রতিষ্ঠানে অসহিষ্ণুতা অনেক দূর ঢুকে গেছে। দিনের শেষে, এটা ধর্মের ব্যাপার না বরং ধর্মকে ব্যবহার করে আরো বেশী ক্ষমতা পাওয়া দুর্বলদের অত্যাচার করার জন্য। আমরা ইসলামের নবীর (সঃ) ঐতিহ্য অনেক আগেই ভুলে গেছি যিনি একজন অমুসলিম নারীর প্রতি সহিষ্ণুতা দেখিয়েছিলেন যে পরিচিত ছিল তার দিকে ময়লা ফেলার জন্য। কথিত আছে যে তিনি তার খবর নিতে যান যখন সে তার নিয়মমাফিক কাজ করছিল না। দু:খজনক, যে আমরা একই ধরনের সহনশীলতা দেখাতে পারি না কারন আমাদের পন্ডিত, নেতা, চিন্তাবিদ আর বিচারকরা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব আর ক্ষমতা লোভে অন্ধ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .