যুক্তরাষ্ট্র: ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ’ এর মিডিয়া কাভারেজ পুনর্নির্মাণ

পার্ক ৫১ এর লোগো

পার্ক ৫১ এর লোগো

বিগত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে একটি খবর লাগাতার মিডিয়ার মনোযোগ ধরে রেখেছে। বিষয়টি হচ্ছে সেপ্টেম্বর ১১, ২০০১ এর হামলার স্থানের (‘গ্রাউন্ড জিরো’) মাত্র কয়েক ব্লক দূরে পরিকল্পিত একটা ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টারের নির্মাণ আর মিডিয়া জগতে এই নিয়ে দ্বিমুখী চরমপন্থী মতামত। কিছু জ্ঞানী আর রাজনীতিবিদ, যেমন সারাহ প্যালিন, বিতর্কিত করেছেন এই কমিউনিটি সেন্টারকে, যাকে পার্ক৫১ বলা হচ্ছে এর অবস্থানের জন্য। ‘গ্রাউন্ড জিরো’ এর কাছে এর নৈকট্যের কারণে অনেকে এই সেন্টার সরানোর কথা বলেছেন আর এটিই মূল বিতর্ক। একই সময়ে, অসংখ্য দল আর ব্যক্তি- যার মধ্যে নিউ ইয়র্ক শহরের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ আছেন – পার্ক৫১ এর সমর্থনে কথা বলেছেন। এরা আমেরিকানদের যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন আর সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর কথা উল্লেখ করেছেন, যেটা স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের আহ্বান জানায়।

কমিউনিটি সেন্টার নিয়ে বিদ্যমান সংকটময় পরিস্থিতির পিছনে মিডিয়া কাভারেজের প্রভাব আছে। অনেক মাস ধরে, আমেরিকার প্রধান ধারার মিডিয়া পার্ক৫১ এর কথা বলেছে ‘গ্রাউন্ড জিরো মসজিদ’ হিসাবে, পরিষ্কারভাবে এটা বলে যে এই প্রকল্প মূল ৯/১১ ভূমিতে নির্মিত হবে (যা আসলে নয়) আর এই সেন্টারের একমাত্র কাজ হবে মসজিদ হিসাবে (আবারো মিথ্যা কথা- সেন্টারে একটি মসজিদ, সুইমিং পুল, থিয়েটার, বাচ্চাদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার আর বিভিন্ন সুবিধা থাকবে)।

ব্লগাররা এই গল্পের বেশ কিছু বিষয়ে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করেছেন, নিউ ইয়র্কে মুসলমানদের ইতিহাস থেকে ইসলাম ভীতি যা পার্ক৫১ এর বিরুদ্ধে তর্কের বিষয়। তাবসির.নেটে লিখতে গিয়ে একজন ব্লগার মিডিয়ার উত্তেজনা নিয়ে লিখেছেন:

বর্তমানে ‘গ্রাউন্ড জিরোর কাছে মসজিদ নির্মানের ব্যাপারে’ মিডিয়া উত্তেজনার স্রোতের সাথে সম্পর্ক আছে আসলে কিছু বন্ধুহীন মানুষের গভীর ইসলাম ভীতির বহি:প্রকাশ যারা ইঞ্জুন, নিগ্রো আর ইহুদিদের ঘৃণা করেছে চিরজীবন আর রাজা জেমস এর বাইবেল সংস্করণের অংশকে ব্যবহার করেছে তাদের ঘৃণাকে ইন্ধন যোগানোর জন্য। আজকের (৮ই আগস্ট, ২০১০) নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লরি গুডস্টাইনের একটা আর্টিকেল ছাপিয়েছে যা দেশব্যাপী মুসলমানদের আরাধনার স্থান নির্মানে বাধা দেয়ার চেষ্টার ব্যাপারে লিখেছে। যদি এটা টি পার্টি ফোরামের আর একটি গণ্ডগোল পাকানোর জিনিষ হিসেবে পরিকল্পিত হওয়া থাকে, এটি মনে হয় মহিলাদের দানের সোসাইটির কাজের বদলে গুন্ডামি করা।

মরোক্কান-আমেরিকান লেখক লায়লা লালামি এতে সম্মতি দিচ্ছেন মনে হয় একটা ব্লগ পোস্টে, তবে তিনি হতাশা জানিয়েছেন মিডিয়া যে মুসলমানদের বাদ দিয়েছে পার্ক৫১ নিয়ে আলোচনার সময়ে সেটা নিয়ে:

লক্ষ্য করুন পার্ক৫১ এর পক্ষ আর বিপক্ষের দুই দল তৈরির সময়ে যেসব মুসলিমদের কথা বলা হচ্ছে তারা ‘ভূতপূর্ব মুসলিম’ আর যেসব মানুষ সাহসের সাথে ধর্মীয় স্বাধীনতার জন্য দাঁড়ায় তার মধ্যে মন্ত্রীও আছেন সকল ধর্মের, কেবল ইসলাম ছাড়া। আমাদের কি এটা বিশ্বাস করতে হবে যে কোন মুসলমান, মন্ত্রী বা না, এই সব ধর্মীয় দলের আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন না, যদিও বিষয়টা ইসলামিক কমিউনিটি সেন্টার নিয়ে?

আমাদের মিডিয়ার সর্বত্র আমি এই ধরনের কণ্ঠরোধ দেখি। রাজনীতিবিদরা লাগাতার ‘সংযত মুসলিমদের’ কথা বলেন এগিয়ে আসার জন্য, আর তারা যখন আসেন, যেমন ইমাম ফায়সাল আব্দেল রাউফ করেছিলেন এই কমিউনিটি সেন্টার স্থাপনের সময়ে, তাদের বাদ দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে যারা চরমপন্থী- ধর্মীয় আর পার্থিব- তারা যথেষ্ট স্থান পান তাদের মতামত জানানোর। যথেষ্ট।

আরব-আমেরিকান ব্লগ কাবোবফেস্টে লেখক সানা ব্যাখ্যা করেছেন ম্যানহ্যাটানের ইতিহাসে মুসলমানদের ভূমিকার ব্যাপারে:

নিম্ন ম্যানহ্যাটন মুসলিম আর আফ্রিকানদের দাসদের শেষ আশ্রয়স্থল, যাদেরকে জোর করে নিউ ইয়র্কে পুনঃস্থাপন করা হয় যখন সেটা নিউ আমস্টারডাম ছিল। ১৯৯১ সালে খুঁজে পাওয়া আফ্রিকানদের কবরস্থান প্রস্তাবিত মুসলিম কমিউনিটি সেন্টার থেকে ছয় ব্লক দূরে। যারা সেখানে শায়িত আছেন তাদের পরিচয় নিয়ে পণ্ডিতরা বির্তক করে যাচ্ছেন, কিন্তু এই বাস্তবতা যে এদের কিছু লাশ ঘোমটা পরিহিত ছিল নীল দানার লহরসহ, যা ইসলামের প্রতীক হিসাবে ব্যবহৃত হয়, এবং এটি ধারণা দেয় যে দাসদের মধ্যে মুসলমানরা ছিল যারা ম্যানহ্যাটনকে বড় শহর হিসাবে নির্মানে সাহায্য করেছে।

অবশ্য, নিম্ন ম্যানহাটনের এই ইতিহাস ৯/১১ এর শিকারদের পরিবারের কাছে খুব কম মূল্য রাখে যারা প্রস্তাবিত কমিউনিটি সেন্টারের বিপক্ষে বিক্ষোভ করছেন। তাদের বিক্ষোভের থেকেও বেশী চিন্তার বিষয় হল কি তাড়াতাড়ি কিছু রাজনৈতিক দল এই বিষয়টাকে ব্যবহার করেছেন তাদের নিজেদের মুসলিম বিরোধী কাজের জন্য। ডান-পন্থীদের বিদ্রূপের মুখে লাজিও আর প্যালিনের মন্তব্য কেবলমাত্র এক ফোটা উস্কানি। একটি পরিষ্কার মিথ্যার মাধ্যমে জাতীয় রিপাব্লিকান ট্রাস্টের ওয়েবসাইট ঘোষণা করেছে যে মসজিদের আয়োজকরা ‘৯/১১ এর হামলার সন্ত্রাসীদের জন্য স্মৃতিসৌধ নির্মান করতে চাচ্ছে'।

এইসব বক্তৃতা মুসলমান-আমেরিকানদের মূলত: ভয়ঙ্কর বিদেশী হিসাবে দেখে- আর ইচ্ছাকৃতভাবে- নিউ ইয়র্ক আর মুসলমান সমাজ নিয়ে গল্প বিকৃত করে।

পার্ক৫১ এর বিরোধীরা একটা কৌশল অবলম্বন করছেন মানহ্যাটনকে মক্কার সাথে তুলনা করে এবং এই বলে যে মক্কার ভিতরে কোন খ্রিষ্টান বা ইহুদিদের উপাসনালয় বানাতে দেয়া হয়না। ব্লগার ডেজার্ট পিস এই বিতর্ককে বাতিল করে দিয়েছেন:

প্রথমত, আমি যতদূর জানি, মক্কাতে একজনও ইহুদি বাসিন্দা নেই, তাই সেখানে কোন সিনাগগ বানানোর কারণ কি? সেখানে একটা আবাসভূমির ব্যবসা শুরুর জন্য? মুসলিমদের সুলহান আরুচ বা চেশ্রনট শাস বা অন্য তাল্মুদিক বার্তা শেখানোর জন্য?

অন্য দিকে, নিউ ইয়র্ক যদি লাখো না হয় তবে বেশ অনেক হাজার মুসলমানদের বাসস্থান। আর এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা মানুষরা আমেরিকার নাগরিক যারা কোন আইন ভঙ্গ করেননি, কোন অপরাধ করেননি আর কাউকে আঘাত করেননি। সত্যি নিউ ইয়র্কের মুসলমানরা যদি হিটলারের মতাদর্শের হতো যেমন এইসব ঘৃণা পূর্ণ আর উস্কানিমূলক চিহ্ন আমাদের বিশ্বাস করাতে চায়, তাহলে নিউ ইয়র্কের ইহুদি মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ, যিনি এই প্রকল্প সমর্থন করেন, একজন নাজি সমর্থক অবশ্যই হবেন।

তবে আরব-আমেরিকান ব্লগ জগতের মধ্যে সকল ব্লগার এই মসজিদ সমর্থন করেন না। ইরাকি মোজো লিখেছেন:

তবে, রক্ষণশীল আমেরিকানদের প্রতি সম্মানার্থে আর ৯/১১ এর শিকারদের জন্য, আর এটা জেনে যে প্রস্তাবিত প্রকল্পের অর্থ সৌদি আরব আর অন্যান্য ওয়াহাবি অধ্যুষিত দেশ থেকে, আমার মনে হয় না গ্রাউন্ড জিরোর কাছে মসজিদ বানানোর জিদ করা মুসলিমদের ঠিক হবে। এটা বলার পরে, নিউ ইয়র্ক বাসী আর মেয়র ব্লুমবার্গের কথা প্রমান করেছে যে আমেরিকানরা বেশ সহনশীল ইসলাম আর মুসলমানদের প্রতি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .