বাংলাদেশে অসুস্থ হওয়াটা “ব্যয়বহুল অপরাধ”

A police guards in front of the United Hospital in Dhaka. Image by Firoz Ahmed. Copyright Demotix

ইউনাইটেড হাসপাতালের সম্মুখভাগ। ছবি তুলেছেন ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০৭/০৭/২০১১)।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে একজন রোগীর মৃত্যুর পর চিকিৎসা খরচের টাকা পরিশোধ করতে না পারায় মরদেহ দিতে অস্বীকৃতি জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে এ ব্যাপারে প্রচার মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হবার পর দু'দিন পর শর্তসাপেক্ষে কর্তৃপক্ষ মরদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

উক্ত রোগীকে গত ৩রা জুলাই হৃদযন্ত্রের সমস্যা এবং মাল্টি অর্গান ফেইলিউর এর কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্যে ল্যাব এইড হাসপাতাল থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানের করনারি কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গত ১৫ আগস্ট ২০১৪ রাতে তিনি মারা যান।

মরদেহ জিম্মি রেখে টাকা আদায়ের ঘটনা নিয়ে ফেসবুক এবং গণমাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়। মরদেহ আটকে রাখার ঘটনাকে সবাই অনৈতিক বলে উল্লেখ করেছেন। ব্লগার কৌশিক আহমেদ বিডিনিউজ২৪ ব্লগে লিখেছেন:

কল্পনা করতে পারছি না যে, বিলের জন্য লাশ আটকিয়ে রাখতে পারে চিকিৎসার মত মহান পেশায় জড়িত ঢাকার অতি উন্নত একটা হাসপাতাল। ৩১ লাখ টাকা বিল ছিলো, কেবিন /আইসিইউ ভাড়া ছাড়া এত বিল কিভাবে হয় যদিও সেটা নিয়ে প্রশ্ন থাকছেই, যার ১২ লাখ টাকা মৃতের পরিবার সাথে সাথে পরিশোধও করেছে– বাকী ১৯ লাখ টাকার জন্য হাসপাতালটির এই পৈশাচিক চরিত্র প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।

এরকম অসভ্য আচরণের জন্য ইউনাইটেড হাসপাতালকে ক্ষমা প্রার্থনা আহবান জানিয়েছেন ব্লগার রাসেল পারভেজ:

লাশ জিম্মি রেখে বকেয়া আদায়ের অসভ্য-অন্যায় আচরণের জন্যে আশা করছি আজ রাতেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। প্রতিটি মৃত ব্যক্তির স্বজনের তার লাশ ধর্মীয় বিধান অনুসারের সৎকারের অধিকার রয়েছে। ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাওনা টাকা আদায়ের জন্যে এই অসভ্যতা করে বাংলাদেশে আইনানুগ ব্যবসা করছে কোনো জরিমানা না দিয়ে এমনটা হওয়া উচিত না।

তবে এবারই প্রথম নয়, এর আগেও ইউনাইটেড হাসপাতালে বকেয়া টাকার জন্য লাশ আটকে রেখেছিল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। তারা বলেছে যে তারা রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে জানিয়েছিল খরচের কথা এবং তারা চিকিৎসা চালিয়ে গেছে এই জন্যয়ে যে আত্মীয়-স্বজন বলেছে যে তাদের সামর্থ্য আছে এবং তারা বিল পরিশোধ করবে। হসপিটাল জানাচ্ছে যে বাকি থাকা ২০ লাখ টাকার বেশিরভাগই জীবন রক্ষাকারী ঔষধ ও ব্যবহার্য জিনিষপত্রের মূল্য বাবদ যা পরিশোধ করা না হলে হাসপাতালের অনেক ক্ষতি হবে। তবে হাসপাতাল মৃতদেহ আটকে রাখার ব্যপারে কিছু বলেনি।

২০০৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের ১৬৮৩টি হাসপাতালের ৪০% সরকারি হাসপাতাল, বাকিটা বেসরকারি। সহজলভ্য এবং কার্যকরী স্বাস্থ্য বীমার অভাবে দুরারোগ্য রোগীদের চিকিৎসা যে কোন সাধারণ পরিবারের জন্যে একটি দায় হয়ে দাড়ায়।

বাংলাদেশে ইউনাইটেড হাসপাতালসহ আরো কিছু হাসপাতাল আছে যেখানে চিকিৎসা খরচ অত্যাধিক। তাছাড়া সেখানে নানা ধরনের ভোগান্তিরও শিকার হতে হয়। সচলায়তনের একটি পোস্টে ব্লগার নীড়সন্ধানী বাংলাদেশে অসুস্থ হওয়াটাকে “ব্যয়বহুল অপরাধ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গল্পকার ও সাংবাদিক মাহবুব মোর্শেদ সামর্থ্য না থাকলে বেসরকারি নামী-দামী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন:

দেশে কোটিপতিদের চিকিৎসা-সেবার জন্য কয়েকটি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলো দেখতে ভাল। যে কারো মনে হতে পারে, ভর্তি হয়ে যাই। তবে ভর্তি হওয়ার আগে বা কাউকে ভর্তি করানোর আগে একবার ভাবুন আপনি কি কোটিপতি? যদি না হয়ে থাকেন তবে লাখপতিদের হাসপাতালে যান। লাখপতি না হলে পিজি বা ডিএমসিতে ট্রাই করুন।

এদিকে সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়াকে ফেসবুক ব্যবহারকারী দূর্যোধন দূর্যোধন “ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স” বলে অভিহিত করেছেন:

[…] তারা কিন্তু আমাকে জোর করেনি আসার জন্য, জোর করেছে আমার “ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স”- সরকারী হাসপাতালের মতন বাজারে (!)গিয়ে চিকিৎসা নেব আমি ? আমার মাঝে বাঙ্গালি সমস্যা, অন্যের চোখে ক্ষুদ্র হয়ে যাবার সমস্যা […] আমার সামর্থ্য আর সাধের মাঝে ফারাক বোঝার অক্ষমতা অথবা অনিচ্ছা- এইসবই এই প্রাইভেট হসপিটালগুলোর কাছে আমাকে শিকার বানিয়ে দিচ্ছে, আমার আত্মীয়ের লাশের জন্য এখন তাদের কাছে হাত পেতে থাকতে হচ্ছে ।

স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিককরণ রোধে মানববন্ধন। ছবি তুলেছেন ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০৭/০৪/২০১২)।

স্বাস্থ্যসেবার বাণিজ্যিককরণ রোধে মানববন্ধন। ছবি তুলেছেন ফিরোজ আহমেদ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০৭/০৪/২০১২)।

বাংলাদেশে সরকারি আর বেসরকারি হাসপাতালের খরচের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ – যতটুকু না ডাক্তারদের পারঙ্গমতায়, বেশিরভাগই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও অনুকূল পরিবেশের জন্যে। সরকারি হাসপাতালে এমআই (হার্ট অ্যাটাক) এর রুগির ৭দিন পর এনজিওগ্রাম করে হাসপাতাল ছাড়ার সময় বিল আসে বড়জোর ৪০০০-৫০০০টাকা। সেখানে একই ধরনের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে বিল আসে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটির ওপরে। সেখানে প্রতি ২০০০ জনের জন্য একজন মাত্র ডাক্তার রয়েছেন। আর প্রতি ৩০০০ জন মানুষের জন্য রয়েছে একটি হাসপাতাল বেড। দেশজুড়ে অনেক সরকারি হাসপাতাল ওর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থাকলেও ডাক্তার পদের ৪৮% পর্যন্ত খালি থাকে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা এবং পরিবেশের কারণে অনেক মানুষ বেসরকারি হাসপাতালে যান। সেখানে তাদের গলাকাটা দাম দিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়। তাছাড়া আছে চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা ধরনের হয়রানি। সেরকম এক হয়রানির ঘটনা কথা জানিয়েছেন হেলেন আহমেদ:

[…] বুকে pain হচ্ছে। তাই ডাক্তার একটা আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে দেয়। বিকেলে রিপোর্ট আনে দেখি নিচে লেখা ছিল তার লিভার এ tumar ধরা পড়েছে। রিপোর্ট দেখে কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার কাছে গেলাম, বললাম আপা, ক্যান্সার তো লিভারে আছে, ডাক্তার বলল কাঁদবে না। রিপোর্ট ভুল আসতে পারে। তুমি এখনই ৭ হাজার টাকার লিভার ct স্ক্যান করাও। টাকার সমস্যা সত্তেও ওই দিন আবার লিভার ct স্ক্যান করাই। রিপোর্ট আসে লিভার ক্যান্সার নয়। ৭ দিন পরে আবার রিপোর্ট আসে ফুসফুসে ক্যান্সার। আমার কান্নায় আকাশ বাতাস এক হয়ে যায়। কেন বার বার এত হয়রানি। এই হয়রানির কারণে আমার মাইল্ড heart সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ইউনাইটেড হাসপাতালে মরদেহ আটকে রাখার ঘটনা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাকি ২০ লাখ টাকার মধ্যে ৫ লাখ মওকুফ করে ১৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্যে মৃতের পরিবারকে ৫ মাসের সময় দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে না পারলে মামলা করবে জানিয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .