এ বছর বাজারে আমের সরবরাহ কম হবার কারন ফরমালিন বিরোধী অভিযান

ফলের দোকানে চলছে ফরমালিন পরীক্ষা।

ফলের দোকানে চলছে ফরমালিন পরীক্ষা। ছবি তুলেছেন রেজা সুমন। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০৩/০৬/২০১৪)

বাংলাদেশে এখন গ্রীষ্ম পেরিয়ে বর্ষাকাল। এই সময়টা ফলের মৌসুম হিসেবে পরিচিত। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, তরমুজসহ নানা ধরনের ফল পাওয়া যায়। বাজারে মেলেও প্রচুর পরিমাণে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্রেতা এই ফলগুলো কিনতে ভয় পান। কারণ, এই ফলগুলোতে নানা ধরনের রাসায়নিক মিশানো হয়।

বাংলাদেশে সবচে’ জনপ্রিয় ফল হলো আম। কিন্তু এবছর বাজারে তা পাওয়া যাচ্ছে না এবং বিভিন্ন ফলের বিক্রি কমে গেছে বলে পত্রিকায় খবর এসেছে। এর কারন বিষাক্ত ফরমালিনযুক্ত ভেজাল খাদ্যপণ্যের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে ফরমালিনযুক্ত মৌসুমী ফলমূল শনাক্ত করে সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে

থাদ্যদ্রব্যে প্রাকৃতিকভাবে ০.০৩-০.১৫ পিপিএম ফরমালিন থাকতে পারে, কিন্তু রাজধানী ঢাকার ফলের আড়তে পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন ফলে এই হার ৩.৫ থেকে ৪৬ পিপিএম পর্যন্ত পাওয়া গেছে। ঢাকায় ঢোকার প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে, যাতে ফরমালিন মিশানো ফল ঢাকায় ঢুকতে না পারে।

ফরমালিনের মূল উপকরণ হচ্ছে ফরমালডিহাইড যা খুবই বিষাক্ত। সাধারণত মৃত প্রাণির দেহের পচন রোধে এটি ব্যবহার করা হয়। শুধু ৩০ মিলিলিটার ফরমালডিহাইড (৩৭% ঘন) খেলেই মানুষ মারা পর্যন্ত যেতে পারে। বাংলাদেশে বেশ কয়েক বছর ধরে শুধু মৌসুমি ফল নয়, মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ রপ্তানি করা আঙুর, আপেল, কমলা, মাল্টা, খেজুরে মাত্রারিক্ত ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। খাদ্যপণ্যে নির্বিচারে ফরমালিন ব্যবহার নিয়ে ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের কারণে সরকার গত ৩০ জুন ২০১৪-এ ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৪’ নামের খসড়া আইনের অনুমোদন দিয়েছে। খসড়া আইনে লাইন্সেস ছাড়া কেউ ফরমালিন আমদানি, বিক্রয় কিংবা পরিবহন করলে যাবজ্জীবন সাজার পাশাপাশি ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

আমে কীভাবে ফরমালিন মিশানো হয় তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন ব্লগার ও সাংবাদিক আনিস রায়হান:

আম যখন গাছ থেকে পাড়া হয় তখনই একদফা ফরমালিন দেয়া হয়। এরপর এগুলো প্যাকেট হয়ে শহরে আসে। শহরে এসে পৌঁছাতে দেরি হলেও যাতে পচন না ধরে তাই প্রথম দফায় ওই ফরমালিন দেয়া হয়। পাইকাররা আমের ঝুড়ির মুখ খুলে কিংবা যদি দেখেন আম নরম তাহলে সব বের করে আরেক দফা ফরমালিন স্প্রে করেন। যাতে খুচরা দোকানগুলোতে পৌঁছানো পর্যন্ত আমের কোনো ক্ষতি না হয়। খুচরা দোকানিরা ওই অবস্থায় আম বিক্রি শুরু করেন। আম নরম হলে খুচরা দোকানেও ফরমালিন স্প্রে করা হয় আরও কিছুদিন আম রক্ষা করার জন্য।

ফল বিক্রেতারা এই অভিযানে খুশি না। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ফলমূল বিক্রেতারা আন্দোলন ও কর্মবিরতি করেছেন। তাদের অভিযোগ পুলিশ ভুল মেশিনের দ্বারা মনগড়া রিডিং নিয়ে তাদের হেনস্থা করছেন।

খাবারে রাসায়নিক মেশানো এ দেশে নতুন নয় এবং এটি মরণঘাতী। ২০১২ সালে লিচুতে মিশানো কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় শিকার হয়ে দিনাজপুরে ১৪ জন শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা’র (এফএও) যৌথ উদ্যোগে ৮২টি খাদ্যপণ্যের ওপরে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেই গবেষণায় গড়ে ৪০ শতাংশ খাদ্যেই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৩ থেকে ২০ গুণ বেশি বিষাক্ত উপাদান শনাক্ত হয়েছে। তাছাড়া একই গবেষণায় ৩৫ শতাংশ ফল ও ৫০ শতাংশ শাকসবজির নমুনাতেই বিষাক্ত বিভিন্ন কীটনাশকের উপস্থিতি মিলেছে। আম ও মাছের ৬৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে ফরমালিন।

পুলিশ ফরমালিন মিশ্রিত ফল ধ্বংস করছে। ছবি তুলেছেন রেজা সুমন।

পুলিশ ফরমালিন মিশ্রিত ফল ধ্বংস করছে। ছবি তুলেছেন রেজা সুমন। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (০৩/০৬/২০১৪)

এদিকে সকলের স্বাস্থ্যের উদ্বেগ থেকে একদল তরুণ ‘আমাদের বিষাক্ত করা বন্ধ করুন’ স্লোগান নিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচী দিয়েছে। বিষমুক্ত খাদ্যের দাবিতে সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আহবান জানিয়েছে। ডা. শফিক ফরমালিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে কঠিন আইনের দাবি করে ফেসবুকে লিখেছেন।

ফরমালিন বা রাসায়নিক মিশ্রিত ভেজাল খাবার খেয়ে প্রতিবছর কী পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন ব্লগার কোবিদ:

ভেজাল খাদ্যগ্রহণে ডায়রিয়ায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে শারীরিকভাবে অযোগ্য হয়ে পড়ছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর সর্বশেষ তথ্য অনুসারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভেজাল খাদ্যগ্রহণ জনিত কারণে ২০১০ সালে মৃত্যুহার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশে।

খাদ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভেজাল নিয়ে দেশজুড়ে মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শেষ নেই। কেন না, এক শ্রেণির ব্যবসায়ীদের লোভের কাছে তারা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ব্লগার শাহাদাত উদরাজী ফরমালিনের অপকারবারীদেরকে ‘পশু’ হিসেবে উল্লেখ করে লিখেছেন:

শুধু মানুষের খাদ্যে নয়, যে কোন প্রানীর খাদ্যে ভেজাল দেয়া মানুষের কাজ হতে পারে না, যারা সামান্যতমও খাদ্যে ভেজাল সমর্থন করবে, তারাও মানুষ হতে পারে না! মানুষরূপী পশুই!

তবে ব্যপারটি আরেকটু জটিল। লেখক এবং কলামিস্ট তাহমিনা আনাম নিউ ইয়র্ক টাইমসে বর্ণনা করেছেন যে গ্রামের গরীব ফল উৎপাদনকারীরা শহরের মানুষের কাছে তাদের ফল পৌছাতে ট্রাকের উচ্চমূল্য এবং পরিবহনে দেরী ইত্যাদি অনেক চ্যালেন্জ মোকাবেলা করে থাকেন। এসব ছাপিয়ে ভোক্তাদের কাছে ফলকে আকর্ষণীয়ভাবে পরিবেশন এবং ফল না পঁচিয়ে ন্যায্য লাভ করার জন্যেই ফরমালিনের ব্যবহার হয়।

শুধু ফরমালিন নিষিদ্ধ করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .