বাংলাদেশ: প্রশ্নবিদ্ধ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান, ভাড়া খাটার অভিযোগ

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক র‌্যাব অফিসার। ছবি: ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১৭/০৫/২০১৪)

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে আটক র‌্যাব অফিসার। ছবি: ইন্দ্রজিৎ ঘোষ। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (১৭/০৫/২০১৪)

বাংলাদেশে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের (র‌্যাব) কার্যক্রম ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে “কালো পোষাকের” এই দুর্ধর্ষ বাহিনী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কার্যকর দেশের সেরা একটি নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে না কি এর কতিপয় সদস্য গুম, হত্যা ও ক্রশফায়ারের মত মানবতাবিরোধী কাজে জড়িয়ে পরেছে।

২০০৪ সালে পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী থেকে সেরা জনবল নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয় তৎকালীন ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস ও অপরাধকে সামাল দেবার জন্যে। অচিরেই এটি বাংলাদেশের এলিট ফোর্স নামে পরিচিতি পায়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাবের মানবতাবিরোধী কাজগুলোর সমালোচনা করে চলেছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার সাথে র‌্যাবের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তিনজন অফিসারকে বরখাস্ত এবং গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর একটি ঘটনায় এক ব্যবসায়ীকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে ৯জন র‌্যাব সদস্যকে। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার এক আদালত পুলিশকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা গ্রহণ করতে বলেছে।

গত ২৭ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে ব্যবসায়ী ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামকে তার ৪ সহযোগীসহ অপহরণ করা হয়। কার পেছনের গাড়িতে আসা প্রবীণ আইনজীবি চন্দন সরকার ও তার ড্রাইভারকেও তুলে নেওয়া হয়। কিছু প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন, র‌্যাবের পোশাক পরা লোক তাদের অপহরণ করেছে। তবে র‌্যাব তাদের আটকের কথা অস্বীকার করে। অপহরণের তিনদিন পর জেলার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়।

নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, র‌্যাব ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। র‌্যাবের বিরুদ্ধে এর আগেও মানবাধিকার লংঘন এবং বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছিল। বিশেষ করে, লিমনের পায়ে গুলি করার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল।

সাংবাদিক আনিস আলমগীর একটি ঘটনার কথা শেয়ার করেছেন তার কলামে:

র‌্যাবের বিরুদ্ধে যখন হত্যা এবং ভাড়ায় খাটার অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় সারা দেশ তখন পুরনো এক গল্প শেয়ার করি পাঠকদের সঙ্গে। তখন বিএনপি তার শেষ দিনগুলো গুণছে। ২০০৬ সাল। ঢাকার এক তরুণকে রাজপথ থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোষাকের লোক। তাকে পরিচিত এক ব্যক্তি দিয়ে ফোনে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার সূত্রে আবিস্কৃত হয়েছিল এটা র‌্যাবের কাজ। কিন্তু র‌্যাবের অস্বীকার। কিংবা বলা যায় র‌্যাব কাউকে ধরে নিয়ে যেভাবে কোথায় রেখেছে হদিস পাওয়া যায় না- সে রকম পরিস্থিতি চলাকালে একরাতে তাকে নিয়ে তার বাসায় আসে কয়েকজন র‌্যাব সদস্য। খবর পেয়ে আমি ছুটে গেলাম। কারণ তরুণটি আমার পরিচিত। গিয়ে দেখি তরুণটি র‌্যাব সদস্যদের জেরায় বলছে, অস্ত্রটা এই ড্রয়ারে ছিল। আর র‌্যাব বার বার এটা সেটা বলে হুংকার দিচ্ছে। বাসায় স্বজনদের কান্নাকাটি, র‌্যাবের হুংকার- সবকিছুতে মনে হচ্ছিল কেয়ামত নেমে এসেছে। ছেলেটির মা আড়ালে ডেকে নিয়ে আমাকে বললেন, ৫ লাখ টাকা চাচ্ছে, নতুবা আজ রাতেই মেরে ফেলবে বলছে ওরা।

আনিস আলমগীর অবশ্য জনমনে র‌্যাবের ইতিবাচক প্রভাবের কথাও তুলে ধরেছেন:

২১ জুন ২০০৪ সাল থেকে র‌্যাব ফোর্সেস পূর্ণাঙ্গভাবে অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করে। জন্ম থেকে গত ১০ বছর ধরে র‌্যাব নামের এই এলিট বাহিনীটির বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত হত্যার মতো অভিযোগ ছিল। তাদের বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেকটাই প্রকাশ্যই ছিল রাষ্ট্রের কাছে। সরকারের পাশাপাশি কিছু সাধারণ মানুষও তাদের এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নিয়েছিল কারণ তারা বিশ্বাস করতো র‌্যাব আসলেই জনগণের বৃহত্তর কল্যাণেই বেআইনি কাজ করছে।

বাংলাদেশে প্রায় দেড় দশক সামরিক শাসন ছিল। তখন সামরিক বাহিনীকে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যই রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করতে হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সেই প্রভাব এখনো প্রশাসনের মধ্যে রয়ে গেছে। তাই, র‌্যাবের এ ধরনের কার্যক্রমের পিছনে গণতন্ত্র সুসংহত না হওয়াকেই দায়ী করেছেন সুলতান মুহাম্মদ জাকারিয়া:

এরশাদ সরকারের [সামরিক শাসক] পতনের পর ১৯৯০-পরবর্তী গণতন্ত্রে আশা করা হয়েছিল যে রাষ্ট্রে বেসামরিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং বেসামরিক প্রশাসন ও নিয়মিত শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে থাকা সামরিক প্রভাব ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে। […] কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে সম্ভবত এর উল্টোটি হয়েছে। এখানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় না থাকলেও তাদের ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে জোরদার হয়েছে। ক্ষমতার পালাবদল করা রাজনৈতিক দলগুলো স্বীয় ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে নিজেদের সামরিক নির্ভরশীলতা বাড়িয়েছে এবং যার পরিণতিতে বেসামরিক প্রশাসন ও শৃঙ্খলা বাহিনীতে আরো বেশি করে সামরিকীকরণের দিকে ঝুঁকছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ২৬৮টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ৪৩ জনের। অপহরণের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ২৪ জনকে, আর পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে ১৪ জনকে। বাকি ১৮৭ জনের কোনো খোঁজই নেই।

তবে র‌্যাবের এ ধরনের কাজের পিছনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাত রয়েছে বলে মনে করেন সাংবাদিক মাসুদ কামাল:

রাজনৈতিক গুম-খুনগুলোর পেছনে যদি আসলেই র‌্যাবের হাত থেকে থাকে, তাহলে এরও পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হাত। তাদের প্রশ্রয়ে কিংবা চাপে পড়েই হয়ত এ ধরনের অপকর্ম করতে হয়েছে। রাজনীতিবিদদের হয়ে অন্যায় কাজ করতে করতে এক পর্যায়ে সশস্ত্র কোনো বাহিনীর সদস্যরা যদি নিজেদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে একই ধরনের অপকর্ম করতে শুরু করে, সেটাকেও কিন্তু খুব বেশি অস্বাভাবিক বলা যাবে না। হয়ত নারায়ণগঞ্জের ঘটনাটি সে রকমই কিছু।

র‌্যাবের সাথে রাজনৈতিক দলের লোকদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ নিয়ে অধ্যাপক আলী রিয়াজ লিখেছেন:

র‌্যাবের বিষয়ে এই ঘটনায় আমরা গণমাধ্যমের সূত্রে যা দেখতে পেয়েছি, তাতে মনে হচ্ছে যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল। সেটা কেবল নারায়ণগঞ্জেই ছিল বা আছে, তা মনে করা কি ঠিক হবে? রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের এই সম্পর্ক কি বাহিনীর কাঠামোগতভাবেই গ্রহণযোগ্য এবং কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আচরণ? এই বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জানা দরকার। এটা সরকারের পক্ষ থেকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। কেননা যদি এটা প্রাতিষ্ঠানিক এবং অনুমোদিত না হয়, তবে তা আর কোথায় কোথায় ঘটেছে এবং ঘটছে, সেটা খুঁজে বের করার জন্যও তদন্ত হওয়া দরকার।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত থাকার অভিযোগে অনেকেই র‌্যাবের বিলুপ্তি দাবি করেছেন।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস র‌্যাবের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার তদন্ত চেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে আগামী ৬ মাসের মধ্যে র‌্যাব বিলুপ্তির আহবান জানানো হয়েছে। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার জন্য র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত র‌্যাবের এক হাজার ৯৪৯ জন সদস্যকে বিভিন্ন অপরাধে চাকরিচ্যুত করাসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। সরকারের ভাষ্যমতে সন্ত্রাস দমণে র‌্যাবের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে এবং সুধী-সমাজকে র‌্যাবের বিকল্পের কথা ভাবতে এ জানাতে বলা হয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .