এই পোস্ট আমাদের “ভিনেগার বিপ্লব, ব্রাজিল“এর বিশেষ কভারেজের অংশ।

এক সপ্তাহ আগের এই দিন। কালেন্ডারের হিসেবে তারিখটি ছিল ২০ জুন ২০১৩। এই দিন বিকেলে ব্রাজিলে সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদ কর্মসূচী অনুষ্ঠিত হয়। যা পুরো দেশকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। রিও ডি জেনিরো শহরতলির মেয়র অফিসের সামনের এই প্রতিবাদ কর্মসূচী ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ। অল্প সময়েই তা মেয়রের অফিস ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। তবে এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী শেষ হয় পুলিশ আর বিক্ষোভকারীদের ভয়ানক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে [পর্তুগিজ]।

সরকারি হিসেবে রিও ডি জেনিরোর প্রতিবাদ কর্মসূচীতে ৩০০,০০০ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ব্রাজিলের ফটোগ্রাফার ক্যালে। তিনি সেই দিনে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে রাবার বুলেট, কাঁদানো গ্যাস আর মরিচের গুঁড়া নিক্ষেপের ছবি তুলে রেখেছেন।
গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইনের জন্য ক্যালের তোলা পুলিশি নির্যাতনের ছবি দেয়া হলো:

গত রাতে আমি রিও'র বিক্ষোভ কভার করি। সেখানে আমি দেখলাম, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের রাস্তা থেকে তুলে দিতে রাবার বুলেট, কাঁদানো গ্যাস নিক্ষেপ করছে। এটা ক্ষমতার অপব্যবহারের নির্লজ্জ উদাহরণ।

বিক্ষোভের বেশিরভাগ অংশই ছিল শান্তিপূর্ণ, আনন্দ-উদ্দীপনামূলক। তারা উৎসবের গান গাইতেছিল, বিক্ষোভে যোগদানকারী বিভিন্ন বয়সী সবার হাতে ছিল জাতীয় পতাকা আর দাবি-দাওয়ার পোস্টার। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকলে বিক্ষোভ কর্মসূচী নিয়ে সবাই বিভ্রান্ত হতে পারে ভেবে তরুণ'রা বামপন্থী সমর্থকদের সাথে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছিল। এটা বাদে পুরো বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ।

আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশ প্রতিক্রিয়া দেখাতে অনেক দেরি করে। প্রথমে তারা মাত্র তিনটি মোটরবাইক করে এসে দেখে কি হচ্ছে, সম্ভবত রিপোর্টের জন্য। কাউকেই তারা গ্রেফতার করেনি। এমনকি কিছু লোকের তখনও রক্ত ঝরছিল, হামলাকারীরা সামনেও ছিল।

জনতা মেয়র অফিসের সামনে চারদিকে ঘিরে দাঁড়ালে পুলিশ মেয়র অফিস রক্ষায় মনোযোগ দেয়। অশ্বারোহী পুলিশের দল গেটের সামনে দাঁড়ায়। এদিকে সংঘর্ষ এড়াতে বিক্ষোভকারীদের নেতারা পুলিশের সামনে মানববন্ধন রচনা করে। যাতে উচ্ছশৃঙ্খল কেউ চমত্কার এই বিক্ষোভ কর্মসূচীকে বানচাল করতে না পারে।

মেয়র অফিসের সামনের বিক্ষোভকে শান্তিপূর্ণ রাখতে পেরেছিলেন বিক্ষোভকারীরা। কিন্তু ২৯ বছর বয়সী বডিবিল্ডার গ্যাব্রিয়েল ক্যামপোস ঘোড়ার উপর বসে থাকা পুলিশ অফিসারদের অপমানজনক কথাবার্তা বললে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠে। এতে করে জনতা ক্ষেপে গিয়ে তাকে সেখান বের হতে বলে। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে তাকে গ্রেফতার করতে অনুরোধ করে। যদিও ততক্ষণে সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে।

কোনো সাড়া না পেয়ে বিক্ষোভকারীরা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। এবং রণে ভঙ্গ দেয়। আর পুলিশ এটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। বিশৃঙ্খলা শুরু হওয়া মাত্রই তারা বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে কাঁদানো গ্যাস, রাবার বুলেট ছোঁড়ে।

মেয়র অফিস আক্রমণ করার কোনো কারণই ছিল না। জনতা ক্রুদ্ধ হয়ে লাঠি এবং ইট নিয়ে পুলিশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তারপরেই ঘটে গত এক দশকের মধ্যে পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহারের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা। বিক্ষোভকারীদের রিও'র শহরতলীর রাস্তা থেকে হটিয়ে দিতে চোকিউ এবং বোপ-সহ স্পেশাল ফোর্স নামে। উল্লেখ, রিও'র থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে শহরতলী লাপা'য় জনতা বিক্ষোভ করছিল। এর প্রতিবাদে প্রেসিডেন্ট ভারগাস অ্যাভিনিউয়ের দোকানপাট, বাড়িঘর ধ্বংস ও লুটপাট হয়।

সংঘর্ষ থেমে গেলেও মেয়র অফিস থেকে অনেক দূরে যেসব শান্তিপ্রিয় বিক্ষোভকারী বাড়ি ফিরছিলেন, পুলিশ তাদের ওপর কাঁদানো গ্যাস ছোঁড়ে। এসময়ে শান্তিপ্রিয় বিক্ষোভকারীদের বাড়ি ফেরার কোনো রাস্তাই থাকে না। সাবওয়ে স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রত্যেক পায়ে হেঁটে সংঘর্ষস্থল থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে।

একদল জনতা ক্যারিকোয়া স্টেশনে গেট খোলার জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময়ে সেখানে পুলিশের স্পেশাল ফোর্স অ্যাভেনিদা রিও ব্রাঙ্কো সেখানে আসে। স্টেশনটির অবস্থান পেডেস্ট্রেরিয়ান অ্যাভিনিউয়ের পেডেস্ট্রেরিয়ান কড়িডোরে। পুলিশ চলে গেলে জনতা তাদেরকে “কাপুরুষ, …. বেজন্মা” বলে গালি দেয়। গালি শুনেই পুলিশ ফিরে এসেই তাদের ওপর কাঁদানো গ্যাস ছোঁড়ে।

সাবওয়ের একজন কর্মচারী খুব দ্রুত ছোট্ট একটি গেট খুলে দেন। কিন্তু জনতা সেখানে ঢুকে ফাঁদে পড়ে যায় যেন। কারণ সেখানটা ছিল কাঁদানো গ্যাসে পূর্ণ। সবার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সিঁড়ির নিচে গিয়ে অনেকে বমি করেন।

বিক্ষোভে অংশ নেয়া অনেকেই বিক্ষোভস্থল ত্যাগ করে পাশেই লাপায় যায়। সেখানে গিয়ে তারা বিয়ারের খোঁজে রেস্টুরেন্টে ঢোকে। তাদের ভাবনা ছিল, এই জায়গা নিরাপদ। এ সময়ে পুলিশের একটি দল সেখানে ঢুকে পড়ে। তারা রেস্টুরেন্টে এবং বারের মধ্যে রাস্তায় অমন তাণ্ডব চালানোর জন্য জনতার তোপের মুখে পড়ে। পুলিশ এ সময়ে পুলিশ বাছবিচার বিহীন ভাবে ভবনের মধ্যে কাঁদানো গ্যাস ছোঁড়ে।

হ্যাঁ, বিক্ষোভের সময় অনেক ধ্বংসাত্মক কাজকারবার হয়েছে। অনেক ঘরবাড়ি ভাংচুর হয়েছে, পোড়ানো হয়েছে। তবে সেসবের বেশিরভাগই হয়েছে মেয়র অফিসের কাছে প্রেসিডেন্ট ভারগাজ অ্যাভিনিউতে। তাহলে পুলিশ কেন অন্যান্য এলাকার সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণ করছে? বিভিন্ন জমায়েতে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় জনগণ এখন বিক্ষোভে যোগ দিতে ভয় পাওয়া নিয়ে কথা বলছে। আবার অনেকের এর বন্ধ চাইছেন। আমার মাথায় একটাই ভাবনা এসেছে, আমাদের পুলিশ যে ব্যবহার করেছে তা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

এই পোস্টে ব্যবহৃত সব ছবিই তুলেছেন ক্যালে। তার অনুমতি নিয়েই পোস্টে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি কর্মাশিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় শৈল্পিক এবং লেখনী প্রজেক্টে কাজ করেছেন। তার কিছু ছবি নিয়ে একটি সিরিজ আছে। সিরিজটির নাম সিকার্স। রিও ডি জেনিরোর অ্যাটেলিয়া দ্য ইমাজেম-এ তার ছবি দেখতে পারেন। সিকার্স সিরিজের ছবি নিয়ে ডেনমার্ক, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা এবং বলিভিয়ায় একক প্রদর্শনী হয়েছে। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আয়ারল্যান্ডে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।

এই পোস্ট আমাদের “ভিনেগার বিপ্লব, ব্রাজিল“এর বিশেষ কভারেজের অংশ।