বাংলাদেশ: ইসলামপন্থীদের নারীবিরোধী দাবির প্রতিবাদ

বাংলাদেশের এক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম গত ৬ই এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া এক নারী সাংবাদিককে ‘পুরুষদের সমাবেশে নারী কেন’ এই অভিযোগে মারধর করে। তারা দেশে কট্টর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং দাবি তুলেছে নারী-পুরুষ একত্রে চলাফেরা করতে পারবে না ও নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি দিতে হবে।

ঐ লংমার্চ কর্মসূচি থেকে তারা সরকারের কাছে ১৩ দফা দাবি জানায় যার মধ্যে রয়েছে নবী বা আল্লাহকে অবমাননার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড এবং আবশ্যকীয় ইসলামী শিক্ষা। তাদের অন্যতম একটি দাবী হলো ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবীতে গত ৬ই এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম একটি র‍্যালীর আয়োজন করে।

শাহবাগের নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তির দাবীতে গত ৬ই এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম একটি র‍্যালীর আয়োজন করে। ছবি শুভ্র কান্তি দাশ। সর্বসত্ব ডেমোটিক্স (৬/৪/২০১৩)

লংমার্চের দিন হেফাজতে ইসলাম নারীদের তাদের আশে পাশে ঘেঁষতেই দেয়নি শুধু, তারা সেখানে কর্তব্যরত নারী সাংবাদিকদের উপরও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। বিজয়নগরে এই সংগঠনের ৫০-৬০জন লোক একুশে টেলিভিশনের রিপোর্টার নাদিয়া শারমিনের উপর চড়াও হয়। তারা পল্টনে ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সাংবাদিক আরাফাত আরাকেও অফিসে যাবার সময় পথ আটকে গালমন্দ করে। শারমিন নাদিয়ার উপর তারা পানির বোতল ও ইট পাটকেল ছুঁড়ে এবং তাকে মাটিতে ফেলে মারধোর করে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয় এবং তিনদিন পরে সেখান থেকে তিনি ছাড়া পান। ৬০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মামলা হয়েছে। ইউটিউবে প্রফেসর জিয়াউদ্দিনের তোলা এই ভিডিওতে নাদিয়ার উপর হেফাজতের আক্রমণ দৃশ্যমান:

র‍্যালি স্থানে একজন বুড়ি বোতল কুড়াচ্ছিলেন কিন্তু তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয় ‘এখানে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ’ এই বলে।

তবে দেশব্যাপী সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখে, এবং হেফাজতের সমস্ত খবর বর্জনের হুমকি দেয়ায় হেফাজত দু:খ প্রকাশ করে এই বলে যে দুর্বৃত্তরা নারী সাংবাদিকদের উপর হামলা করেছিল।

সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের আক্রমন। ছবি: মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনো ফেসবুক পাতা থেকে নেয়া।

সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের ওপর হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের আক্রমণ। ছবি: সানাউল্লাহ লাবলুর সৌজন্যে।

বাংলাদেশের সরকার তাদের প্রতি প্রথম থেকেই নমনীয় আচরণ করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হেফাজতকে অনুরোধ করেছেন ৪ ও ৫ই মের অবরোধ তুলে নেবার জন্যে যাতে সাভারের বিল্ডিং ধসের শিকার মানুষদের উদ্ধারকার্যে কোন অসুবিধা না হয়। তিনি আরও বলেছেন যে হেফাজতের ১৩টি দাবীর অনেকগুলোই হয় মানা হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে। তিনি অন্যান্য দাবীগুলো নিয়ে আলোচনার আহ্বান করেছেন।

তবে হেফাজতে ইসলাম তাদের দাবীগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনে যাবেন বলেছে

আগামীকাল ৫ই মে এই দল সারা দেশ থেকে ঢাকা শহরকে বিচ্ছিন্ন করার ডাক দিয়েছে। তারা ১৩ দফা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যাখ্যাকে নাকচ করে জানিয়েছে যে শহরে ঢোকার ৬টি পয়েন্টে তাদের লোকেরা অবরোধ করবে। বিরোধী দল বিএনপি এবং জামাত তাদের সমর্থন দিচ্ছে।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই নারীবিরোধী দাবি তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাদের নারী অধিকার বিরোধী বক্তব্যের নিন্দা, প্রতিবাদ এবং নারীবিরোধী তৎপরতারোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সবাই। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদী মিছিল, মানববন্ধন, সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়েছে।

একটি মুসলমান প্রধান ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নারীরা অনেকদুর এগিয়েছে। সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ জন। আর নারী ৭ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৭ জন। এখন শিক্ষায় পুরুষের চেয়েও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে নারী। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশের হার ছিল ৭৮.৬৭%। এর মধ্যে ছাত্রদের পাশের হার ছিল ৭৮.২৩%। আর ছাত্রীদের পাশের হার ছিল ৮৯.১৯%। এছাড়া মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতেও ছাত্র ও ছাত্রীর পাশের হার প্রায় সমান। তাছাড়া দেশের সবচেয়ে বড়ো খাত পোশাকশিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। অন্যান্য ক্ষেত্রেও নারীদের অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে। তাই এ অবস্থায় নারীকে ঘরে বন্দি রাখা মানেই দেশের অগ্রগতিকে পিছনে টেনে ধরা।

Activists of Bangladesh group theater federation took a part of mach against Hifazat-e-Islam long march in the Dhaka. Image by Rehman Asad. Copyright Demotix (5/4/2013)

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ বিরোধী নারীদের মিছিল। ছবি রেহমান আসাদ। স্বত্ব: ডেমোটিক্স। (৫/৪/২০১৩)

এছাড়া দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী এবং নবনির্বাচিত স্পিকারও নারী। অনেকে মনে করে হেফাজতের এই নারী বিদ্বেষ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বাংলাদেশের যা অর্জন তা ব্যহত করবে।

গত এপ্রিল ২৭, ২০১৩ তারিখে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ৬৮টি বেসরকারী এনজিও একটি র‍্যালির আয়োজন করে নারীদের দাবিয়ে রাখার এই নতুন প্রচেষ্টার ব্যাপারে। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন:

বাংলাদেশের জনগণ ধর্মীয়ভাবে সহিষ্ণু এবং অসাম্প্রদায়িক। কতিপয় মৌলবাদীদের আস্ফালনে জাতি বদলে যেতে পারে না।

নারীদের বোরখা পরিয়ে ঘরে বন্দী করে রেখে হেফাজত ইসলাম নামধারী উগ্রবাদী গোষ্ঠী তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় উল্লেখ করে সামহোয়্যারইনব্লগে কাজী মামুন হোসেন লিখেছেন:

হেফাজত তাদের ১৩ দফায় ধর্মের নামে নারীদের চার দেয়ালে বন্দী করতে চায়, চায় পোশাক শ্রমিক নারীদের মাধ্যমে দেশ যে বিদেশী মুদ্রা আয় করছে তা বন্ধ হোক, আমাদের মেয়েরা কাজ না করে স্বামীর পদতলে বাঁধা থাকুক। শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক না করে আমাদেরকে অন্ধকারে বেঁধে রাখতে চায়। ধর্মের নামে আধুনিক বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে চায়।

এদেশ নারী-পুরুষ সবার উল্লেখ করে নায়করাজ লিখেছেন:

বাংলাদেশকে কোনক্রমেই তালিবান আফগান বানাতে দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ কোনো কাঠমোল্লার দেশ না, এই দেশ নারী পুরুষ সবার।

ব্লগার হিমু সচলায়তনে লিখেন, হেফাজতে ইসলামের দাবিতে নারী কখনোই ঘরে অন্তরীণ হয়ে থাকবে না:

যে বাংলাদেশের কৃষি অচল নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া, যে বাংলাদেশের শিল্প অচল নারীর শ্রম ছাড়া, যে বাংলাদেশের পরিবার অচল নারীর নি:শব্দ আত্মবিসর্জন ছাড়া, সে বাংলাদেশে মাথায় ফেট্টি বাঁধা কতগুলি উন্মাদের কথায় নারী অন্তরীণ হয়ে থাকবে?

কখনোই না।

এদিকে লংমার্চের সংবাদ সংগ্রহ করতে আসা নারী সাংবাদিককে আক্রমণ করায় হেফাজতে ইসলামের কাছে সরিফুল ইসলাম রুকুন প্রশ্ন রেখেছেন:

ইসলাম শান্তির ধর্ম। হেফাজতের যে সব কর্মীরা এ মহৎ(!) কাজে অংশ নিয়েছেন তারা কী জানাবেন, একজন মহিলাকে অর্ধশত পুরুষ মিলে এভাবে নির্দয়ভাবে পেটানোর অনুমতি ইসলামের কোথায় উল্লেখ আছে?

নারী সাংবাদিককে মারধরের প্রতিবাদে ইরতেজা সাংবাদিকদেরকে হেফাজতে ইসলামের সকল সংবাদ বর্জন করার আহবান জানিয়ে টুইট করেছেন:

@ইরতেজা: সকল গণমাধ্যমকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি, সাংবাদিক বোনদের ওপর অব্যাহত অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদে হেফাজতে ইসলামীর সকল সংবাদ বর্জন করুন।

বিক্ষিপ্ত ক্ষিতীশ টুইট করেছেন:

@প্রজন্ম১০৬: দু:খিত, হে ধর্মান্ধের দল, নারীকে ঘরে আটকে রাখার দিন এদেশে আর নেই, কোনোদিন আর আসবেও না। sachalayatan.com/dhusor_jolchobi/48746#.UWW3Y3h_1Ns.twitter … #shahbag

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .