যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির রায় ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

১৯৭১ সালে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর দেলওয়ার হোসেন সাইদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রদান করার পর জামাত শিবির ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে প্রায় ৮০ জনের মৃত্যু ঘটেছে

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারায় সাঈদীর বিরুদ্ধে যে ২০টি অভিযোগ গঠন করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা ও বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন এবং সহযোগিতা করা। মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে হত্যা, অপহরণ, আটক রাখা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও ধর্মান্তর করা এবং এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করা।

ট্রাইব্যুনালে ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের ৬০ পৃষ্ঠার সারাংশ পড়ে শোনানো হয়। আনীত ২০ টি অভিযোগের মধ্য তাঁর বিরুদ্ধে ৮ টি অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাইদীকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। এটি ছিল ট্রাইবুনাল কর্তৃক দেয়া তিনটি রায়ের মধ্যে দ্বিতীয় মৃত্যুদন্ডের রায়

ব্লগার্স এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক (বোয়ান) এর আহবানে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ চত্বরে ২৫ দিন ব্যাপী চলমান আন্দোলনের কর্মীরা রায় ঘোষণার পর উল্লাস প্রকাশ করে। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

The Shahbagh protesters burst out into joy after hearing that the three-member International Crimes Tribunal – 1 handed death penalty to the top Jamaat-e-Islami leader Delawar Hossain Sayedee.

সাঈদির রায় ঘোষনার পর শাহবাগের আন্দোলনকারীরা খুশীতে ফেঁটে পড়েন। ছবি রাহাত খান্ স্বর্বস্বত্ব ডেমোটিক্স (২৮/২/২০১৩)

তবে রায়ের প্রতি সংক্ষুব্ধ জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির দেশ ব্যাপী বিভিন্ন স্থানে মন্দির, প্যাগোডায় হামলা চালায়, সংখ্যালঘুসহ সাধারণ মানুষকে আক্রমণ করে, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে ও পুলিশের উপর সশস্ত্র হামলা চালায়। পুলিশও গুলিবর্ষণসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে যার ফলে প্রথম দিনই ৪২ জনের মত মারা যায় দেশজুড়ে

বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি এন পি)- এর চেয়ার পার্সন বেগম খালেদা জিয়া গত ২ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন “সরকার ফ্যাসিবাদি আচরণ করছে। সরকারের এ গণহত্যার বিষয়ে আমরা নিশ্চুপ থাকতে পারিনা।”এ সংবাদ সম্মেলনে তিনি জামাতের হরতালে তার দলের সমর্থন জানান।

অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে দেশের অনেক স্থানে আইন- শ্বৃংখলা রক্ষার্থে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। সহিংস এ হামলায় দেশজুড়ে যে নারকীয় তাণ্ডব চলে তা নিচের ভিডিওগুলোতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছেঃ

অনেক টুইটার ও ফেসবুক ব্যবহারকারী নিচের ভিডিওটি শেয়ার করেনঃ

বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর জামাত- শিবির চড়াও হয়। নোয়াখালীর রাজগঞ্জ ইউনিয়নের আলামপুর ও আলাদীনগর গ্রামে জামাত-শিবিরের তাণ্ডবের শিকার হিন্দু পরিবারগুলোকে নিয়ে ভিডিওচিত্র ব্লগে আপলোড করেন শহীদুল ইসলাম মুকুল (আরও ভিডিও রয়েছে এই পোস্টটিতে)। এ হামলায় ৭৪ টি হিন্দু পরিবারের বসতবাড়ি আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

শাহবাগের প্রতিবাদকারীরা অনলাইনে এ সব হামলার প্রতিবাদ জানায়। এ প্রসঙ্গে হাসিবুল হক বলেনঃ

শংকিত হবার কিছু নাই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নাশকতা ঠেকানো। জামাত-শিবির যত ই তান্ডব চালানোর চেষ্টা করবে, তত ই তারা গণ-বিচ্ছিন্ন ও পরিত্যাক্ত হয়ে যাবে। জনগণ স্বত:স্ফূর্তভাবে জামাত-শিবির প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে।

অন্যান্যরা প্রধান বিরোধী দলের প্রদত্ত বক্তব্যে জামাতকে সমর্থন করা নিয়ে ফেসবুকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ফিরোজ উদ্দীন বলেনঃ

বিএনপি নাকি জনগণকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করছে!!! তাহলে আমরা কারা??

শাফি মাহমুদ লিখেনঃ

মর্মাহত, স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ, হতাশ……
কি করে বিরোধীদলের নেত্রী পারলেন জামাতিদের পক্ষ নিতে?
তিনি তো একজন সেক্টর কমান্ডের স্ত্রী…
একজন স্বাধীনতা ঘোষকের (!!) স্ত্রী……
তাহলে কি স্বাধীনতা মিথ্যা ?
৩০ লক্ষ প্রান মুল্যহীন?
দেশনেত্রী , যত তারাতারি আপনার শূভবুদ্ধির উদয় হয়
দেশের জন্য ততই মঙ্গল……

Rioters in Santinagara set car on fire as riots continue. Image by Mohammad Asad. Copyright Demotix (2/3/2013)

শান্তিনগরে বিশৃঙ্খলাকারীরা গাড়ি পুড়িয়েছে। ছবি মোহাম্মাদ আসাদের। স্বর্বস্বত্ব ডেমোটিক্স (2/3/2013)

সাঈদির বিরুদ্ধে রায়ের পর বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ প্রকাশ করে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। রাশেদ আলমাজি তাঁর ফেসবুকে লিখেনঃ

আমরা শুরু করলাম। শেষ নয়!!!

ফেসবুক ব্যবহারকারী শেখ গিয়াসউদ্দীন আহমেদ শুভ্র প্রত্যাশিত এ রায়ের জন্য শাহবাগের সংগ্রামী জনতাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেনঃ

অভিনন্দন শাহবাগ! জনতা রাস্তায় অতন্দ্র পাহারায়।ন্যায়প্রতিষ্ঠায়, সতর্ক ও সজাগ জনতার বিকল্পনাই। জয় জনতা, জয়বাংলা।

সোহেল জাফর ফেসবুকে বলেনঃ

দেলু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ হলো আজ। বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘৃণ্যতম অপরাধী এই ‘ফ্যানাটিক‘ খুনী-ধর্ষকের ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে কলঙ্কমুক্ত হবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হাঁটবে উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নের পথে।

শাহবাগের প্রজন্ম চত্বর নিয়ে তৈরি হওয়া ফেসবুক পাতা প্রজন্ম চত্বর-এ বলা হয়ঃ

ফাঁসির রায়ের জন্য শাহবাগে অপেক্ষমাণ হাজার হাজার জনতা প্রত্যাশিত সংবাদ পেয়েই শুরু করেন আনন্দ উল্লাস। এ যেনো এক অভাবনীয় দৃশ্য। এ যেনো আরেক যুদ্ধ জয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা আনন্দ মিছিল নিয়ে আসছে শাহবাগের গনজাগরণ চত্বরে। কেউ ঢোল বাজাচ্ছে। কেউ বাজাচ্ছেন বাশি।

 প্রজন্ম চত্বর- আরও  জানায়ঃ

সংগ্রাম এখানে কিন্তু শেষ না, আরো বহু দূর যেতে হবে। আরো ৬টা বাকি, একটা আপিল বাকি…… তারপর বাকিদের ধরতে হবে।

Hundreds of demonstrators converge near historic Bahadurshah Park in Old Dhaka to press their demand of hanging all war criminals.

রাজধানী ঢাকার বাহদুর শাহ পার্কে সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবীতে গণজমায়েত। ছবি ফিরোজ আহমেদ সর্ব স্বত্ব ডেমোটিক্স (৩/৩/২০১৩)

১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সর্ব প্রথম আন্দোলন শুরু করেন ১৯৯২ সালে। তাঁকে স্মরণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, বিশিষ্ট লেখক  এবং তেল, গ্যাস ও জাতীয় সম্পদ রক্ষার্থে গঠিত জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদ তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেনঃ

জাহানারা ইমামকে স্মরণ করি। তাঁর কথাই সত্য প্রমাণিত হলো। যাঁরা যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনে নানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন তাঁদের অভিনন্দন জানাই। গ্লানিমুক্তির সূচনা। এখানেই থামবে না।

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .