বাংলাদেশ: অলিম্পিকে আছি আমরাও

বিজয় মহান কিন্তু বিজয়ের জন্য সংগ্রাম মহত্তর- বলেছিলেন আধুনিক অলিম্পিকের প্রবর্তক ব্যারেন পিয়েরা দ্য কুবার্তা। আর বাংলাদেশ তাঁর নীতি সার্থক ভাবে অনুসরণ করে চলেছে। ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলাদেশ অলিম্পিকে অংশ গ্রহণ করে আসছে। তবে বরাবরের মত এবারও বাংলাদেশীরা আশা করে না যে দেশটি অলিম্পিকে কোন পদক লাভ করবে।

বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার ক্রীড়া আসর অলিম্পিকে এবারো সরাসরি অংশ নেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ। ‘ওয়াইল্ড কার্ড’-এর দাক্ষিণ্য নিয়ে লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নিতে বাংলাদেশ দল লণ্ডন গিয়েছে। ২৭ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া অলিম্পিকে বাংলাদেশ পাঁচটি খেলার জন্য ওয়াইল্ড কার্ড পেয়েছে। সেগুলো হলো অ্যাথলেটিক্স, শূটিং, সাতাঁর, জিমন্যাস্টিক্স ও আরচারি। চার বছর আগের বেইজিং অলিম্পিকে বাংলাদেশ তিনটি খেলায় অংশ নিয়েছিলো। এবার তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আর্চারি ও জিমন্যাস্টিক্স।

লন্ডন ২০১২ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। টাওয়ার ব্রীজে আলো ও আতসবাজীর প্রদর্শন।

লন্ডন ২০১২ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। টাওয়ার ব্রীজে আলো ও আতসবাজীর প্রদর্শন। ছবি জাকি নর্থের। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স (২৭/৭/২০১২)।

বাংলাদেশের প্রায় সবাই জানে যে বাংলাদেশের কেউ কোন ইভেন্টে কোন পদক অর্জন করবে না। তবে ক্রীড়া কর্মকর্তা এবং খেলোয়াড়দের আশা, অলিম্পিকে তাঁরা তাদের সেরা নৈপুন্য প্রদর্শন করবে।

যদি আপনারা ভেবে থাকেন বাংলাদেশের অলিম্পিক সংবাদ এখানে শেষ তাহলে মস্ত বড় ভুল হবে। অলিম্পিকে বাংলাদেশের আসল চমক খেলার মাঠে নয়, মাঠের বাইরে। কি সেই চমক?

সামহয়ারইন নামক গ্রুপ ব্লগে রেজাউল করিম ফেসবুকে প্রকাশিত একটি লেখা পুন:প্রকাশ করেছেন, যার শিরোনাম “উদ্বোধনের আগেই লন্ডন অলিম্পিক বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে বিরল সম্মান”। এই প্রবন্ধে তিনি জানাচ্ছেন:

এবারের অলিম্পিক আয়োজনে বিভিন্নভাবে জড়িয়ে আছেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশিরা ।

রোকসানার হাতে মশাল:

আট হাজার সৌভাগ্যবান মশালবাহীর হাত হয়ে যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্তে ছুটে চলেছে অলিম্পিকের শান্তির মশাল। যে কেউ চাইলেই অলিম্পিকের ঐতিহ্যবাহী মশাল বাহক হতে পারেন না। বাহকের থাকতে হয় বিশেষত্ব। যুক্তরাজ্যের নানা প্রান্তে আলোচিত নয়জন ব্রিটিশ বাংলাদেশি অলিম্পিক টর্চ বহনে সম্পৃক্ত হয়ে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। এদেরই একজন রোকসানা। ২১ জুলাই লন্ডনের গ্রিনউইচ এলাকায় অলিম্পিক মশাল হাতে দৌড়াবেন ব্রিটিশ কিকবক্সিং চ্যাম্পিয়ন বাঙালি তরুণী রোকসানা বেগম।

অলিম্পিক স্মারক মুদ্রার নকশাকার সায়মান মিয়া:

লন্ডন অলিম্পিক নিয়ে পাঁচ পাউন্ড সমমানের স্মারকমুদ্রা বের করার প্রস্তুতি নেয় ব্রিটিশ মুদ্রা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান দ্য রয়েল মিন্ট। স্মারক মুদ্রার নকশার জন্য যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আয়োজন করা হয় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার। বিজয়ী হয়ে ব্যাপক আলোচিত হন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি তরুণ সায়মান মিয়া। কয়েক হাজার নকশার মধ্য থেকে নির্বাচিত হয় তাঁর নকশাটি। সায়মান বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী। তাঁর নকশা করা অলিম্পিক ২০১২ সালের স্মারকমুদ্রাটি এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে।

সৌগত প্রিয়ম, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খুদে শিল্পীদের একজন:

নয় বছর বয়সের চঞ্চলপ্রাণ সৌগত প্রিয়ম, যাকে অলিম্পিকের বিশালত্ব বোঝাতেই পারছেন না তার মা মিনাক্ষী দাশ। এ নিয়ে কথা হয় প্রিয়মের সঙ্গে। সে বলে, ‘আমাদের স্কুল থেকে ৩০ জন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছি। অনেক বন্ধু বেড়ে গেছে, তাই রিহার্সেল করতে ভালো লাগছে ।’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল, ‘নিজের ইচ্ছামতো কিছু করতে পারলে আরও ভালো লাগত ।

উজ্জ্বল আয়েশা:

২০০৫ সালের ৬ জুলাই। সিঙ্গাপুরে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক আয়োজক কমিটির সভা – কে হবে ২০১২ সালের অলিম্পিক আয়োজক? সেই ফয়সালা হবে এই সভাতেই। শেষ লড়াইটা লন্ডন আর প্যারিসের মধ্যে। যাকে বলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। লন্ডনের ১১ জনের প্রতিনিধিদলে আছেন বাঙালি নারী আয়েশা কোরেশী। পিনপতন নীরবতা ভেঙে হঠাৎ মিলনায়তনে ঢুকে পড়ল ৩৩ জন শিশু-কিশোর, যাদের পূর্বপুরুষের শিকড় পৃথিবীর নানা প্রান্তের ৩৩টি দেশ। বহুজাতি, নানা ভাষাভাষীর মানুষের শহর লন্ডনের জাতিগত বৈচিত্র্য তুলে ধরতেই তাদের নিয়ে আসা। এ ব্যাপারটা বেশ নাড়া দিল সভার অতিথিদের। আর এরই সুবাদে শেষতক চতুর্থ রাউন্ডে চার ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ীর হাসি হাসে লন্ডন। আর এই ৩৩টি দেশের ৩৩ জন শিশু-কিশোরকে হঠাৎ সভায় উপস্থাপন করার আইডিয়া বিবিসির কমিউনিটি বিভাগের আয়েশা কোরেশীর।

সবারব্লগ জানাচ্ছে আরেকজন বাঙ্গালীর কথা যিনি তাঁর নৃত্য দিয়ে অলিম্পিক মাতাবেন।

এবার জানা গেল বাংলাদেশের আরেক প্রাপ্তির কথা। যা এনে দিলেন বৃটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী ছেলে আকরাম খান। যার ঈশারায় এখন নাচবে বিশ্বের সব খ্যাতনামা তারকারা। অলিম্পিক আসরের কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করছেন তিনি। প্রবাসী বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান আকরাম খান। তার নির্দেশনাতেই ২৭ জুলাইয়ের অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবেন ১২ হাজার কলাকুশলী।

অলিম্পিকের খাবারে থাকবে বাংলার স্বাদ। সিলেটেরআলাপ নামক নেট পত্রিকা জানাচ্ছে:

অলিম্পিকে খাবার সরবরাহকারীর তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশী মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্ট লি রাজ। সারের এপসমে অবস্থিত লি রাজ বৃটেনের জনপ্রিয় কারি ডিশ সরবরাহের পাশাপাশি অলিম্পিকে আসা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমান অতিধিদের উপযোগী প্রিয় ইফতার আইটেম প্রস্তুত ও সরবরাহ করবে। 

লি রাজ অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিত্বকারী উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সরকার প্রধান, মন্ত্রী, সাংসদ সদস্য সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের খাবার সরবরাহ করবে।  [..] এশিয়ার বিভিন্ন দেশের খাবার সরবরাহের পাশাপাশি বাংলাদেশের জনপ্রিয় খাবারগুলো অতিথিদের নিকট পরিবেশন করা হবে।

কেবল মাঠের বাইরে নয়, মাঠেও থাকবে বাংলাদেশের উপস্থিতি। খেলোয়াড়দের ঘামের সাথে মিশে। কি ভাবে?

ইন্টারনেট ভিত্তিক আরেকটি পত্রিকা বিডিনিউজ জানাচ্ছে অলিম্পিক গেমসে প্রধান পোশাক সরবরাহকারী হচ্ছে বাংলাদেশ।

খেলার সামগ্রী এবং পোশাক তৈরিকারী বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান অ্যাডিডাস, পুমা এবং নাইক এবারের অলিম্পিকের মূল পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। যারা বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা এবং ইন্দোনেশিয়ায় তাদের সাপ্লায়ার ফ্যাক্টরি থেকে পোশাক তৈরি করাচ্ছে। তবে, এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশের নাম।

অলিম্পিক গেমসের অফিসিয়াল পোশাক সরবরাহকারী অ্যাডিডাস স্পনসর করছে বৃটিশ টিমের পোশাক। অন্যদিকে নাইক দায়িত্ব নিয়েছে আমেরিকা, চীন, জার্মান এবং রাশিয়ার টিমের পোশাক তৈরি। আর জ্যামাইকান স্পোর্টস স্টার উসাইন বোল্টের পোশাকসহ আরো কয়েকটি দেশের পোশাক তৈরি করছে পুমা। এবং সেইসব পোশাকের তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশী শ্রমিকদের হাতেই”।

কেউ যদি পদক তালিকায় বাংলাদেশের নাম খোঁজে তাহলে সে হতাশ হবে বটে কিন্তু যদি কেউ অলিম্পিক গেমসকে সুন্দর করার তালিকায় এদেশের নামটি খোঁজে, তাহলে দেখবে সেখানে জ্বলজ্বল করছে বাংলাদেশের নাম।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .