বাংলাদেশ : পহেলা বৈশাখকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি চলছে

আর কয়েকদিন পরেই বাঙালির প্রাণের উৎসব- পহেলা বৈশাখ। এ দিন বাংলা নববর্ষ। প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল বাঙালিরা মহাধুমধামে বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকেন। নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠে পুরো বাঙালি জাতি। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি আছেন, সেখান থেকেই তারা নতুন বছরটিকে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেন।

পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সবাই ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরে থাকেন। মেয়েরা পরে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি আর ছেলেরা পাঞ্জাবি, ফতুয়া। শপিং মলগুলোতে কেনাকাটার ধুম পড়ে। তাই দিনটিকে ঘিরে ফ্যাশন হাউজগুলোর বিশেষ আয়োজন চোখে পড়ে।

আলআমিন নব্বই [বাংলা ভাষায়] জানাচ্ছেন তিনি তার প্রিয় মানুষটিকে কী কিনে দিয়েছেন:

পহেলা বৈশাখের জন্য দিনাকে আমি সাদা-লাল রংয়ের জামদানি কাপড় গিফট করলাম। আর হাতের লাল চুড়ি, মাটির গহনা আর লাল টিপ।

বাঙালির বৈশাখের আয়োজনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পান্তা-ইলিশ। এদিন অনেক বাড়িতে পান্তা ভাতের সাথে সর্ষে ইলিশ আর আর কাঁচা লংকা দিয়ে একটি বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বাজারে ইলিশ মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম [বাংলা ভাষায়]বেড়ে গেছে।

চারুকলার অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা।

চারুকলার অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ছবি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া।

প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রা [বাংলা ভাষায়]বের হয়। এই শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে চারুকলাতেই এসে শেষ হয়। শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাতে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই শোভাযাত্রার আয়োজনের প্রস্তুতি ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ব্লগার ভুং ভাং [বাংলা ভাষায়] সেটা ঘুরে এসে জানিয়েছেন:

চারুকলার ঢুকে প্রথমে চোখে পরবে মাটির সরা তারপর এ আছে মুখোশ বানানোর কাজ। মাটির সরায় কাজ করছে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রং বিভিন্ন থিম এর। নির্দ্দিষ্ট কোন থিম নেই, তবে বেশির ভাগ সরার ডিজাইন লোকজ সংস্কৃতির গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলা ঐতিহ্যর উপরে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা যে কয়টি প্রচলিত আইটেম এর মধ্য রয়েছে মুখোশ, সরা আর কিছু প্রাণীর প্রতিলিপি ।

মোগল সম্রাট আকবরের আমল থেকে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হয়। তখন জমিদারি প্রথা চালু ছিল। চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত কৃষকরা জমিদারের খাজনা পরিশোধ করতো। আর পহেলা বৈশাখ জমিদাররা কৃষকদের মিষ্টি খাওয়াতো। তখন এ উপলক্ষে নানা উত্সবের আয়োজন করা হতো, মেলা বসতো। তখন থেকেই মানুষের জীবনের সাথে মিশে যায় পহেলা বৈশাখ। কালক্রমে উৎসবমুখর পরিবেশে আনন্দময় শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে পহেলা বৈশাখ।

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অণুষ্ঠান। তারা গানে গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে। ছবি আবু আলা। স্বত্ব ডেমোটিক্স

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। তারা গানে গানে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে। ছবি আবু আলা। স্বত্ব ডেমোটিক্স

বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের মূল আয়োজন হয় ঢাকায়। রমনার বটমূলে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের [বাংলা ভাষায়]বর্ষবরণের গান, চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। দিনটাকে উদযাপন করতে সবাই এই এলাকাতেই আসেন।

পহেলা বৈশাখ নিয়ে প্রতিটি বাঙালির নানা ধরনের অনুভূতি রয়েছে। বিশেষ করে ছোটবেলার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার স্মৃতি। শেখ জলিল সচলায়তনে [বাংলা ভাষায়]তার ছেলেবেলার পহেলা বৈশাখের স্মৃতিচারণ করেছেন:

বৈশাখ এলেই মনে পড়ে বৈশাখী মেলার কথা। গ্রামের হাট-বাজারে বসতো এ মেলা। নাগরদোলায় চলা, লাঠিখেলা দেখা, বায়স্কোপ দেখা, মেলা থেকে মুড়ি-মুড়কি-বাতাসা-সন্দেশ-মিষ্টি কিনে খাওয়া আমার শৈশব বেলার স্মৃতি। বাবা-মা, বড় ভাই-বোনের হাত ধরে মেলায় যেতাম। তারা কিনে দিতেন বাঁশি চরকী, বেলুনসহ আরো কত কী? সাপুড়েদের সাপ খেলা, বানরের খেলা আর ষাঁড়ের লড়াই দেখতাম এ সময়। সত্যিকারে আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মিলনকেন্দ্র ছিল আমাদের বৈশাখী মেলা। হিন্দু-মুসলমান সবাই মিলে আনন্দ-উল্লাস করে বৈশাখের প্রথম কয়েকটা দিন কেটে যেত।

যারা বিদেশে আছেন, দেশের পহেলা বৈশাখ পালন করতে পারছেন না। তাদের আক্ষেপ আরো বেশি। এক প্রবাসী ব্লগার লিখেছেন [বাংলা ভাষায়]সেটা:

বৈশাখ মানেই গ্রামহারা শহরহারা দেশ ছাড়া হয়ে বিশ্বের কোন এক ব্যাস্ত নগরীতে বসে শুধুই স্মৃতির জাবর কাটা, টেলিভিশনের পর্দায় রমনার বটমূল আর তরুন তরুনীদের গালে রঙের ছটা দেখা। হায়রে বৈশাখ তুই কি কখনোই শহরে আসবিনা? শহরের সাথে কি তোর চিরকালই আড়ি?

নববর্ষের সাজ – কলাপাতার মুকুট মাথায় ছোট ছেলে। ছবি তুলেছেন আবু আলা। সর্বস্বত্ত্ব ডেমোটিক্স।

পহেলা বৈশাখ এখন সর্বজনীন উত্সবে পরিণত হলেও একসময় তা ছিলো মধ্যবিত্ত বাঙালির উৎসব। মূলত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজই এই উত্সবে অংশ নিতেন। ব্লগার একটু [বাংলা ভাষায়] জানাচ্ছেন সে কথা:

বৈশাখের এ উত্সব, মানুষের সর্বজনীন এ অংশগ্রহণ দুই দশক আগেও এরকম ছিল না। বৈশাখের উৎসব আমেজ, ভালো রান্না আর অনুষ্ঠানমালা সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিমনা কিছু মানুষের মধ্যে। ছায়ানটের অনুষ্ঠান হতো বটতলায়। সেখানেও অংশগ্রহণ ছিল সংস্কৃতিকর্মী ও মধ্যবিত্ত একটি শ্রেণীর। গত দুই দশক ধরে বৈশাখ বরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বৈশাখ বরণের রং মধ্যবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। বৈশাখের অনুষ্ঠানে বেড়ে চলেছে সর্বশ্রেণীর মানুষের অংশগ্রহণ। […] নিম্নবিত্ত সাধারণ শ্রমজীবী মানুষও বৈশাখের জন্য আলাদা করে রাখছে তার ঘামে উপার্জিত অর্থের একটি অংশ। সাধ্যমত গায়ে তুলছে বৈশাখের পোশাক। ঘুরতে বের হচ্ছে প্রিয়জনের সঙ্গে। মেলা থেকে কিনে আনছে শৌখিন কিছু।

পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এই দিনে দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মুক্ত তথ্য হিসাবে উইকিপিডিয়ায় [বাংলা ভাষায়]তুলে ধরার জন্য প্রচারণা চালায়।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি। মানুষের মাথাপিছু আয়  ৮২৮ মার্কিন ডলার [বাংলা ভাষায়]। রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও দারিদ্র্য, বেকারত্ব সমস্যা দেশটিতে প্রকট। তবে পহেলা বৈশাখ এলে মানুষ সব ভুলে আনন্দে মেতে উঠে। সবাই মিলেমিশে ভাগ করে নেয় নববর্ষের আনন্দ-আয়োজনটুকু। ব্লগার এ এস এম রাহাত খান সামহোয়ারইন ব্লগে [ছবি-সহ] [বাংলা ভাষায়]সেটাই তুলে ধরেছেন:

লাল-সাদা শাড়িতে……পাঞ্জাবিতে…চারদিক এত বর্ণিল…কে বলবে পৃথিবীর একটি গরিব দেশ বাংলাদেশ? কে বলবে নানা কষ্ট আর না পাওয়ার দেশ বাংলাদেশ? সবাই যেন সব ভুলে একটি দিনের জন্য হলেও সুখের স্বর্গে পরিণত করে বাংলাকে…

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .