- Global Voices বাংলা ভার্সন - https://bn.globalvoices.org -

বাংলাদেশ: ফেসবুকের স্ট্যাটাস বিষয়ক জটিলতা

বিষয়বস্তু: দক্ষিণ এশিয়া, বাংলাদেশ, ডিজিটাল অ্যাক্টিভিজম, প্রতিবাদ, রাজনীতি, শিক্ষা

সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও ফেসবুক সামাজিক যোগাযোগের জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে। ফেসবুক এখন বাংলাদেশে কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয় সেই সাথে এটি সংবাদ আদান প্রদান এবং দ্রুত সংবাদ ছড়িয়ে দেবার এক গুরুত্বপুর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচ্য হচ্ছে। একই সাথে এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার অন্যতম এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ফেসবুকের ওয়ালে নাগরিকরা তাদের মনের ক্ষোভ, ভালোলাগা, অধিকার, ঘৃণা, ইত্যাদি আবেগ প্রকাশ করে থাকে। কোন কোন স্ট্যাটাস আবেগপূর্ণ এবং বেশ সমৃদ্ধ হয়। বাংলায় কেউ একজন মজা করে ফেসবুকের ওয়ালে স্ট্যাটাস প্রদান করেছিল: “আমি গরীব হতে পারি, কিন্তু ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাস আছে”। এটি জনপ্রিয় হওয়ায় এখন এই শ্লোগানের একটি ফেসবুক পাতাও [1] আছে।

ফেসবুক স্ট্যাটাস [2]

ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী ক্রিষ্টি শেফিল্ডের সৌজন্যে। সিসি বাই-এনসি ২.০

কিন্তু এখন এই ফেসবুক স্ট্যাটাস মনে হচ্ছে কারও জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রুহুল আমিন নামক এক ফেসবুক ব্যবহারকারী তার স্ট্যাটাসের কারণে এখন বিপদে পড়েছেন। আর এটা মোটেও বাংলাদেশের স্ট্যাটাসকে সমৃদ্ধ করছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশে এক সড়ক দূর্ঘটনায় প্রতিভাবান তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীর [3] এর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবীতে অনেকেই ফেসবুককে প্রতিবাদের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। রুহুল আমিনও তার ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ফেসবুকের ওয়াল বেছে নেন। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে বাংলাদেশ হাইকোর্ট তার বিরুদ্ধে সমন জারী করে।

কি লিখেছিলেন রুহুল আমিন? বিডি নিউজ ২৪ নামক ওয়েব ভিত্তিক সংবাদপত্রে সুত্র উল্লেখ করে বিডি নিউজ ২৪ ব্লগ [4] লিখেছে:

“ফেইসবুক স্ট্যাটাসে প্রধানমন্ত্রীর ‘মৃত্যু কামনা’ করায় মুহাম্মদ রুহুল আমীন খন্দকার নামের এক প্রবাসীর বিরুদ্ধে কেন আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট’।

উক্ত ব্লগ আরো জানায়:

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির খণ্ডকালীন প্রভাষক রুহুল বর্তমানে শিক্ষা ছুটিতে অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘মৃত্যু কামনা করে’ রুহুল শনিবার তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দেন। ওই দিন মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশফাক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুর পর এ স্ট্যাটাস দেন রুহুল। ওই স্ট্যাটাস নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সংবাদ আদালতের নজরে নেওয়ার পর আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে।

এই দিনে রুহুল আমিন তার ওয়ালে দুটি স্ট্যাটাস লিখেছিল। শনিবার ৭.৪০ মিনিটে তিনি লিখেছিলেন: “পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার ফল তারেক ও মিশুক মুনীরসহ নিহত ৫: সবাই মরে, হাসিনা মরে না কেন?” রোববার ভোর ৪টা ৫৯ মিনিটে দেওয়া আরেক স্ট্যাটাসে লেখা ছিলো, “পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স! কোন সভ্য সমাজে কি চিন্তা করা যায়? পুরো পৃথিবী যেখানে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া কঠিন করছে, সেখানে হাসিনা সরকার পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছে!!!”

এই স্ট্যাটাসের প্রদর্শিত ক্ষোভের কারণ হচ্ছে সম্প্রতি নৌ পরিবহণ মন্ত্রী, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে কোন ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই [5] ২১,০০০ (মতান্তরে ২৪, ০০০) ব্যক্তিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করার অনুরোধ জানান [bn] ।

বিডিনিউজ২৪.কম ব্লগের এই পোস্টের [4] মন্তব্যে বিভাগে বেশ কিছু মন্তব্য এসেছে। মন্তব্যে কেউ কেউ তার বক্তব্যের পক্ষে মত দিয়েছে, আবার কেউ কেউ বিরোধিতা করেছে।

রব্বানী (Rabbani) বলেছেন:

রুহুলের এই স্ট্যাটাসকে আমিও সমর্থন করি। এবং হাইকোর্টের এইসব রুলকে মানবাধিকার বিরোধী এবং ক্ষমতা ও আইনের অপপ্রয়োগ বলে সংজ্ঞায়িত করি। রুহুল এই লেখাটার ভেতর দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর ১২০০০ এর ও বেশি মানুষের মৃত্যুর পেছনে রাজনৈতিক দানবদের অবহেলার প্রতি ধিক্কার জানিয়েছেন।

মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম মনে করেন এই মামলা বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ। তিনি মন্তব্য করেছেন:

বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ কি গণতন্ত্রের পরিপন্থী নয় ? বিচার বিভাগের উপর জনগণের আস্থা খুব নাজুক নয় কি? দয়া করে জনগণের শেষ সম্বল টুকু কেড়ে নেয়ার ব্যবস্থা থেকে বিরত থাকুন-মহামান্য বিচারপতিগণ। (শুক্রবার ১৯ অগাষ্ট, ২০১১)

মহসিন রহমান বলেছেন:

জাহাঙ্গীরনগর এর সেই শিক্ষক ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে যে মন্তব্য করেছেন তা দেশের জনগণের মনের ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ। ওই শিক্ষক যা করতে পারেননি হাই কোর্টের ওই দুই বিচারপতি করে দেখিয়েছে। সারা দেশের মানুষের ক্ষোভ কে প্রচারমাধ্যমে তুলে ধরেছে। (শুক্রবার ১৯ অগাষ্ট ২০১১)

হাসান বলেছেন:

কমেন্ট দিতেও ভয় লাগছে, পাছে যদি এটার কারণে আমার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি হয় ? :p (শুক্রবার ১৯ অগাষ্ট ২০১১)

রতন অধিকারী মনে করেন এই ধরনের মন্তব্য অসংযত, তিনি বলেছেন

মশা মারতে কামান দাগা এবং তোষামোদীর আরও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খণ্ডকালীন শিক্ষক মুহাম্মদ রুহুল আমীন খন্দকার যে মন্তব্যটি করেছেন তা সমর্থন যোগ্য নয় কোন ভাবেই। আশা থাকবে রুহুল ও তোষামোদী উভয়েই সংযমী হবেন তাদের লাগামহীন আচরনের ব্যাপারে। (শুক্রবার ১৯ অগাষ্ট ২০১১)

নেটপোকা বলেছেন:

এরকম মন্তব্য অবশ্যই শোভন নয়। তবে তা বাংলাদেশের কোন্‌ আইন অনুসারে বে-আইনী, কেউ বলবেন কি? (শুক্রবার ১৯ অগাষ্ট ২০১১)

অধিক নিয়ন্ত্রন সেন্শরশীপের জন্ম দেয়। [6]

অধিক নিয়ন্ত্রন সেন্শরশীপের জন্ম দেয়। ছবি ফ্লিকার থেকে পাবলিক১৫ এর সৌজন্যে। সিসি বাই ২.০।

অনিক ইকবাল একজন ব্লগার। তাঁর পিতা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের গ্রপ মেইলে অনিকের একটি মন্তব্য প্রকাশ করেছে (অনুমতিক্রমে প্রকাশিত)।

i am interested to see whether government can really strongly build the case and justify their argument. but if they decide to go for it, a lot will be at stake. the government's character as the protector of its citizens’ personal rights will be in question. again, their attitude might be termed as oppression and silencing people's opinions by force. whether or not they win the case, chances are that it will damage their image, which is already in jeopardy.

আমি আগ্রহের সাথে এই মামলার উপর আমার নজর রাখছি। আমি দেখতে চাই সরকার কি ভাবে এই মামলা সাজায় এবং একে যৌক্তিক প্রমাণ করে। কিন্তু যদি তারা এই মামলা চালিয়ে যেতে চায় তাহলে অনেক কিছু ঘটবে। তাহলে নাগরিকদের ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষায় সরকার যে অঙ্গীকারাবদ্ধ, এই বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে। আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তাদের এই মনোভাবকে জোরপূর্বক জনতার মতামত দমন এবং নীরব করিয়ে দেবার এক প্রক্রিয়া বলে বিবেচিত হবে। সরকার এই মামলায় জয়লাভ করুক আর না করুক, এটি তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ করবে, ইতোমধ্যে যা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মেইলের মাধ্যমে বাংলা নিউজকে প্রদান করা এক সাক্ষাৎকারে [7] রুহুল আমিন তার এই লেখার পেছনের বাস্তবতা তুলে ধরেন,

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনিরের অকাল মৃত্যুতে আমরা কি হারালাম তা নতুন করে বলার কিছু নেই। যেদিন তাঁরা নিহত হলেন, সেদিন সেহরী খাবার পর আমি প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে খবরটি প্রথম দেখি। বিস্তারিত জানার জন্য অন্যান্য পত্রিকাও দেখি। দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই, মূল খবরের নিচে পাঠকদের শত শত মন্তব্যও পড়তে থাকি। পরে আবেগের বশবর্তী হয়ে ওইসব মন্তব্য থেকে কোন একটির অংশবিশেষ সংকলন করে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই।

তিনি এর সাথে আরো যোগ করেন।

এখানে আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে চাই, ফেসবুকের উক্ত স্ট্যাটাস দ্বারা আমি মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কোন রুপ ব্যাক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করিনি এবং তার প্রতি আমার হেন কোন ব্যাক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষোভ নেই। আমি শুধু উক্ত দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাধারন মানুষের প্রতিক্রিয়াগুলোই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে চেয়েছি। সুতরাং এটাকে আমার নিজের অভিমত বলে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টা আমার প্রতি অবিচার মাত্র। স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। তারপরও যদি উক্ত স্ট্যাটাস কারও সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত হেনে থাকে তাহলে তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দু:খিত।

তিনি উপসংহার টেনেছেন এভাবে:

ইতিমধ্যে বিষয়টির অপব্যাখ্যার কারণে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। উপরোক্ত ব্যাখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে অনিচ্ছাকৃত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে আমি আশা করি।

তার মন্তব্যে অনীক উপসংহার টানেন এভাবে:

i am keenly following the developments. this case, at the least, will decide the future of the flourishing of electronic media and define people's right to share their opinions over this very modern and powerful medium.

এই ঘটনার উপর আমি গভীর মনোযোগ রাখছি। অন্তত এই মামলা, আজকের এই আধুনিক এবং শক্তিশালী ইলেক্ট্রনিক প্রচার মাধ্যম ভবিষ্যতে কতটা বিস্তার লাভ করবে এবং মানুষকে কতখানি মন্তব্য করার অধিকার প্রদান করতে পারবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে যাচ্ছে।