লেবানন: গানে রাষ্ট্রপতিকে উপহাস করার পর গায়ককে গ্রেফতার করা হয়েছে

২০১০ সালের এক গানে রাষ্ট্রপতি মাইকেল সুলেইমানকে নিন্দা করার অভিযোগে লেবাননের গায়ক জেইদ হামদানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

লেবাননের পত্রিকা আসাফির সংবাদ প্রদান করেছে যে, এই ঘটনার পর গায়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে টুইটারকারী এবং ব্লগাররা প্রাথমিক ভাবে তার গ্রেপ্তারের সংবাদে একের পর এক লেখা প্রকাশ করে। এর পরই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
হামদানের গ্রেফতারের ঘটনায় লেবাননের অনলাইন সম্প্রদায় দ্রুত ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই ঘটনায় হামদানের মুক্তির জন্য ফেসবুকের একটি পাতা উৎসর্গ করা হয়, যা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত ২,০০০-এর বেশী ব্যবহারকারীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।

Zeid Hamdan (left) with Mahmoud Radaidah. Image by Flickr user alhussainy (CC BY 2.0).

মাহমোদ রাদাইদাহ এর সাথে জেইদ হামদান(বামে)। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী আলহুসাইনীর (সিসি বাই ২.০)

এছাড়া টুইটারেও এই নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। #ফ্রিজেইদ হ্যাশট্যাগ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা এই গ্রেফতারে বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।

@লেসাকে: @সেলিমানমাইকেল আপনার আরব সহগোত্রীয় শাসক যারা সমালোচনা পছন্দ করত না, তাদের অবস্থা কি হয়েছে তা কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? #

@বিলালহুইরি: লেবাননের সরকার ২০১০ সালের আগস্ট মাসে ইউটিউবে জেইদের গান নামাতে শুরু করে এবং আজ তা নামানো শেষ হয়েছে। #অনটরনেট

@এনমোআওয়াদ: #ফ্রিজেইদ জেইদকে মুক্ত কর এবং মোহাম্মদ ইস্কান্দারকে গ্রেফতার কর!

@তাজাদ্দোদইয়োথ: রাষ্ট্রপতি @সেলেইমানমাইকেল #ফ্রিস্পিচ, বাক স্বাধীনতার উপর আপনার যে প্রতিশ্রুতি ছিল আমরা তা জানি। জেইদ হামদানকে অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা # সেন্সরশীপের জন্য হুমকি। # ফ্রিজেইদ

@হিন্দমেজাইনা: ” শিল্প এবং সঙ্গীতের ভুমিকা, জনতার সামনে অনিশ্চিত নেতার ভঙ্গুর চরিত্রিক আহমের প্রশংসা করা নয়।”http://t.co/SqJXPJy #ফ্রিজেইদ

মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এখন অনেক লেবাননবাসী উদ্বিগ্ন। সরকার, ফরাসীদের শাসনের মাধ্যমে (প্রথম বিশবযুদ্ধের পর) প্রাপ্ত এক আইন জোর করে দেশটির নাগরিকদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। এই আইন তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে, যারা প্রকাশ্যে দেশটির রাষ্ট্রপতির সমালোচনা করছে। হামদানের গ্রেফতার, বাক স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায় এক বিশেষ আইন সংস্কারে দাবীকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

কার্ল রিমার্কস-কার্ল সাহরো, হামদানের গ্রেফতারের সংবাদ জানার পরপরই এর প্রতিক্রিয়ায় একটি লেখা লিখেছিলেন। তিনি এই গ্রফতারের ঘটনাকে “বুদ্ধিবৃত্তিক ভীতি প্রদর্শন” হিসেবে অভিহিত করেছেন।

… এই ঘটনা বর্তমানে লেবাননের দমনের সংস্কৃতির প্রতি এক অতি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং একচ্ছত্র ক্ষমতার ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরেছে। এই গানে, জেনারেল সুলেইমানকে প্রশ্ন করা হয়েছে, এটা হালকা এক রেগে মিউজিক নামক সঙ্গীত। এই গানের কারণে তামাশা বুঝতে অক্ষম সরকার জেইদ হামদানের উপর চড়াও হয়। তারা দেশটির রাষ্ট্রপতি পদটির প্রতি হীনবাক্য ব্যবহারের মত “আঘাত” প্রদান করার কারণে হামদানকে গ্রেফতার করেছিল। ফরাসীদের শাসনামলের সময়কার এই সেকেল আইন কর্তৃপক্ষ প্রায়শ মত প্রকাশের স্বাধীনতা নামক বিষয়টির কণ্ঠরোধ করার কাজে ব্যবহার করে।

একই সাথে জেইদকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বাস্তবতার ভিত্তিতে যে গানটি আসলে আক্রমণাত্মক নয়। আমি মনে করি এটা একটা ভুল প্রক্রিয়া। এখানে আমাদের সে বিষয়টিকে রক্ষা করতে হবে সেটি হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কোন ধরনের যোগ্যতা ছাড়াই এবং এই সেকেলে আইন যা কিনা এই ধরনের গ্রেফতারে অধিকার প্রদান করে তাকে বাতিল করা প্রয়োজন। কোন রাজনীতিবীদ বা কোন পাবলিক চরিত্র সমালোচানার উর্দ্ধে নয়, আর তাদেরকে শ্রদ্ধা আদায়ের জন্য ওই ধরনের কোন আইনের ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া উচিত নয়, তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যা তার অর্জন করতে পারে না। শিল্পকলা এবং সঙ্গীতের ভুমিকা পাবলিক চরিত্রের অনিশ্চিত অহমের চাটুকারিতার জন্য হওয়া উচিত নয়। আসুন আমরা সে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিক দমনকে দৃঢ় ভাবে না বলি এবং আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করি, যেই মন্তব্য এক মুর্খের দলকে আহত করে, আর সেই সব মুর্খেরা আমাদের শাসন করে।

অউসামা হায়েক লেবাননের সেকেলে এই রাজকীয় আইনের উদ্ভট দিকটির কথা উল্লেখ করেছে:

আমাদের প্রিয় মহান নেতা রাষ্ট্রপতি জেনারেল সুলেইমানকে (যে কিনা ডিজিএলপিজিএস বা শাসন ব্যবস্থার অংশ) অপমান করার দায়ে জেইদ হামদানের গ্রেফতারের সংবাদটি বিস্ময়কর নয়, কিন্তু বিষয়টি লেবাননের আইন বিভাগের এক বেদনাদায়ক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিছুদিন পর পর আমরা শুনতে ডিজিএলপিজিএসের যে কাউকে অপমান করার জন্য কাউকে না কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
একটি সাধারণ রাষ্ট্র যেখানে সত্যিকারের “রাজকীয়” কোন ব্যবস্থা বিদ্যমান, যেমন ব্রিটেন, সেখানে ১৮ শতক থেকে রাজা বা রাণীকে অপমান করলে কারো কোন শাস্তি পেতে হয় না। হল্যান্ডে যদি আপনি রাণীকে পতিতা বলে উল্লেখ করেন, তাহলে আপনাকে ৪০০ ইউরো জরিমানা প্রদান করতে হবে। লেবাননকে দেখা যাচ্ছে জরিমানা আদায়কারীদের দলে। দেশটি থাইল্যান্ডের মত বাধ্যতামুলভাবে এক রাজকীয় আইনের প্রয়োগ করছে

তবে এখানে সমস্যা হচ্ছে ডিজিএলপিজিএস, থাই রাজার মত দেবতার আসনে আসীন নয়। সে আসলে এক ক্ষণভঙ্গুর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। এমনকি এই ক্ষণভঙ্গুর গণতন্ত্রও কার্যকর থাকে না, যদি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে কঠোরভাবে সমালোচনা না করা হয়।

এ সেপারেট স্টেটস এ্যাট মাইন্ড-এ এলি ফারেস , যুক্তি প্রদান করছে, যে আইনের বলে হামদানকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা যেমন বিচিত্র, তেমনি একই সময়ে সমালোচকদের নিজের দেশের প্রতি সমালোচনার ক্ষেত্রে শান্ত থাকা উচিত:

আমরা যে ভাবে পারি ডানে এবং বামে, উপরে এবং নীচে সবদিক থেকে দেশকে বাঁশ দিতে চাই। এবং এ সবের মাঝে যে কোন সময় যে কোন দিকে যা ঘটে, আমরা তার সাথে একমত হই না।

বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা যাক।

এর সবচেয়ে সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে আজ জেইদ হামদানকে গ্রেফতার করার ঘটনাটি। লেবাননের রাষ্ট্রপতিকে নিন্দা জানানোর কারণে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এক অর্থহীন গানের কারণে তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়।

যেই মুহূর্তে জেইদকে আটক করা হয়, তখন থেকে লেবাননের টুইটার এবং ফেসবুক ব্যবহারকারীরা এর প্রতিবাদ করতে শুরু করে। জেইদ-কে মুক্ত করার উদ্দেশ্য তৈরি করা ফেসবুক পাতা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ২০০০ অনুসারী লাভ করে। এর সবটাই সকলেই, ভালো, তাই না? আমি বুঝাতে চাইছি এই গ্রেফতারের বিষয়টি এক অদ্ভুত বিষয়। যে আইনের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সে আইনটিকে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। এটি ১৯২৬ সাল নয়, যখন আমাদের সংবিধান ফরাসী সংবিধানের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। ফরাসীরা তাদের সংবিধানের পরিবর্তন সাধন করেছে। এখন সময় এসেছে আমাদের সংবিধান পরিবর্তন করার।

জেইদ হামদানের ঘটানার আরেকটি দিক হচ্ছে, এই ঘটনায় লেবাননের অনেকে এর জন্য রাষ্ট্রকে দোষারোপ করছে। তাদের অনেকে এই দেশটিকে বাজে এক জায়গা হিসেবে বর্ণনা করেছে, অন্যরা একে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছে, এদিকে অন্য অনেকে একে এক নোংরামি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক অবস্থা সবসময় ভঙ্গুর ভারসাম্যপুর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তার মানে এই নয় যে পুরো ব্যবস্থাই ব্যর্থ। যেহেতু ক্ষমতা সহজেই (বদলে যায় ) পরিবর্তিত হয়, তার মানে এই নয় যে এই রাষ্ট্রটি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র।

আর আপনারা কি জানেন যে কোন বিষয়টি সবচেয়ে বিচিত্র, লেবানন সম্পর্কিত বিষয়ে আমাদের আকাঙ্খা এত কম যে আমরা যে কোন গুজব বিশ্বাস করার জন্য তৈরি হয়ে থাকি, যে সব গুজবে সামগ্রিক ভাবে দেশের নিন্দা করা হয়ে থাকে।

দেশের একজন রাজনৈতিক নেতার সমালোচনা করা, তাকে ব্যাঙ্গ করে এবং কোন কাজের জন্য তাকে দায়ী করা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি অন্যতম ভিত্তি। লেবানন যদি সত্যিকারের একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চায়, তাহলে সে বাক এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক বিষয়গুলোকে সত্যিকার ভাবে শ্রদ্ধা জানাতে হবে।

হামদানের গ্রেফতারের ঘটনা আমাদের বাস্তবিক পক্ষে মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবার ক্ষেত্রে আমাদের দেশটি এখনো অনেক পিছনে পড়ে আছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .