আফগানিস্তান: ফাঁস হওয়া ছবিতে উন্মোচিত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের “নিষ্ঠুরতা”

২১ মার্চ, ২০১১ তারিখে জার্মান সাপ্তাহিক সংবাদ সাময়িকী ডের স্পেইগেল আফগান সাধারণ নাগরিকের উপর তোলা তিনটি বীভৎস ছবি প্রকাশ করে যাদের, মার্কিন যুক্তরাষ্টের একদল সেনা খুন করেছে। তিনটি ছবির মধ্যে দুটিতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের দুজন সৈনিক, আংশিক নগ্ন এবং রক্তে মাখা একটি মৃতদেহের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। নিহত উক্ত ব্যক্তির নাম গুল মুদ্দিন। ডের স্পেইগেল-এর সংবাদ অনুসারে তাকে ১৫ জানুয়ারি, ২০১০-এ, লা মোহাম্মেদ কালাই নামক গ্রামে খুন করা হয়। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুইজন সৈনিকের মধ্যে একজন গুল মুদ্দিনের খণ্ডিত মস্তক হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তৃতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত দুই আফগান যোদ্ধাকে পিঠমোড়া করে বসিয়ে রাখা হয়েছে, যাদের হাত পরস্পরের সাথে বাঁধা।

ব্লগাররা এক প্রচণ্ড মানসিক আঘাত এবং ক্রোধের মধ্যে দিয়ে এই সব ছবির প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেছে। টুইটার ব্যবহারকারী @তানিয়াচৌধুরী টুইট করেছে:

আনন্দিত এই কারণে যে, ডের স্পেইগেল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হাসি মাখা মুখ ও আফগান নাগরিকদের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে তোলা, এইসব বীভৎস ছবি প্রকাশ করেছে।

United States Army soldiers in Afghanistan back in June 2007. Image by Flickr user The U.S. Army (CC BY 2.0).

জুন ২০০৭-এ আফগানিস্তানে অবস্থান করা যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিক। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বিভাগের (সিসি বাই ২.০)

গ্রেগ মারে প্রাক্তন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, যার কার্যালয় ছিল উজবেকিস্তানে এবং বর্তমানে তিনি একজন মানবাধিকার একটিভিস্ট। তিনি লিখেছেন:

যুক্তরাষ্ট্রের সেনা সংস্কৃতিতে খুব খারাপ কিছু একটা রয়েছে, এটি তার এক লক্ষণ। আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না, যেহেতু এখন আমি যতটা ক্ষুব্ধ তার চেয়ে বেশি শোকার্ত। কিন্তু আমি আপনাদের এই সব সত্যের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকদের মধ্যে এটা খুব সাধারণ ঘটনা যে, এ ধরনের বিজয়ী বেশে দাঁড়িয়ে থাকা ছবির জন্য তারা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ায়, এরপর ট্রফি ফটো নামে পরিচিত এইসব বিজয়ী বেশে ধারণ করা ছবির দৃশ্য আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে ছাপা হয়। সাধারণের প্রতিদিনের জীবন ও মৃত্যুর উপর যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকদের যে সুনির্দিষ্ট ক্ষমতা রয়েছে, সেই ক্ষেত্রে এটি খুব সাধারণ বিষয় যে, তারা কেবল আনন্দের জন্য খুন করে থাকে, এবং এরপর এই ঘটনার দৃশ্য ধারণ করার মধ্যে দিয়ে নিজেরা নিজেদের অভিযুক্ত করে।

এটি খারাপ ঘটনা সমূহের সামান্য অংশ মাত্র।

একই দিনে ডের স্পেইগেলের প্রকাশনার কাছে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্রুত আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার কপি এসে হাজির হয়

মঙ্গলবারে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী একটি ক্ষমা প্রার্থনা প্রকাশ করে এবং বলে যে, ছবিতে যে সব কর্মকাণ্ডের দৃশ্য ধরা পড়েছে, তা মানুষের জন্য এক নিন্দনীয় কাজ এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আদর্শ এবং মূল্যবোধের বিপরীত এক কর্ম”।

অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর এই রকম ক্ষমা প্রার্থনাকে অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে।

@তাভলেশ টুইট করেছে:

মৃত আফগান নাগরিকের পাশে দাঁড়িয়ে তোলা যুক্তরাষ্টের সেনাদের প্রচণ্ড বীভৎস ছবি প্রদর্শিত হবার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ক্ষমা প্রার্থনা করেছে।http://bit.ly/fxWiK9,#পি২,#টক্ট,#আফগানিস্তান-তারা ছবির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, কৃতকর্মের জন্য নয়।

@ক্রুয়েলএজনেচার, ক্রোধের সাথে উক্তি করছে::

আপনাদের ক্ষমা প্রার্থনার কোন মানে নেই!

আফগানিস্তানস্টাডিগ্রপ.অর্গ (এএসজি)-এর বিশ্লেষণ মোতাবেক, এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনী শঙ্কিত এই কারণে যে, বীভৎস এইসব ছবি হয়ত আফগানিস্তানে যৌথ বাহিনীর ভাবমূর্তি আরো ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এএসজি ব্লগে, উইলি কোয়েলা থমাস তার এক লেখা, যার শিরোনাম, “খুনীর দল” ছবি: সম্ভাব্য ফলাফল এবং যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতা-তে, যুক্তি প্রদান করেছে,

এই ঘটনা, এই বিষয়টি উন্মোচন করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা নিরস্ত্র আফগানদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার পরিকল্পনা করেছে, যা তাদের নিজেদের প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। তবে ডের স্পেইগেলের সম্প্রতি প্রকাশিত তিনটি ছবি, যেখানে দেখা যাচ্ছে অভিযুক্ত সেনারা মৃত আফগানদের মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে, তা সেখানে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং আফগান সরকারের সম্পর্কে টানা-পোড়েন দেখা দিয়েছে। সেখানে গণসংযোগের ক্ষেত্রে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ঠিক করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কমকর্তারা হোঁচট খাচ্ছে, বিশেষ করে আফগানিস্তানে ব্যাপক বিক্ষোভের সম্ভাবনার প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে। অভিযুক্ত সেনাদের মধ্যে একজন হচ্ছে আর্মি স্পেশালিস্ট (কর্পোরাল সম মর্যাদা সম্পন্ন পদ) জেরেমি মোরলক। সে তিনজনকে খুন করার কথা স্বীকার করেছে এবং এই সপ্তাহে কোর্ট মার্শাল বা সামরিক আদালতের মাধ্যমে তার অভিযোগের বিষয়ে শুনানী হতে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিক জেরেমি মোরলক খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন এবং তাকে ২৪ বছরের জেল প্রদান করা হয়েছে। টুইটারে, টুইটারকারীরা জেরেমি মোরলকের অপরাধের সাথে উইকিলিকসে প্রদান করা যুক্তরাষ্ট্রের সেরা সব গুপ্ত তথ্য প্রদানকারী ব্রাডলি মানিং-এর অপরাধের তুলনা করেছে। টুইটাপিকের মাধ্যমে হেজেমোনিক নীচের ছবিটি প্রকাশ করেছে:

Bradley Manning vs. Jeremey Morlock. Image by Twitpic user @hegemonik.

ব্রাডলি মানিং বনাম জেরেমি মোরলকে। ছবি টুইটপিক ব্যবহারকারী @হেজেমোনিক।

@বাকীটুরকো টুইট করেছে:

পরিহাসের বিষয়: জেরেমি মোরলক এমন এক সৈনিক যে সাধারণ আফগান নাগরিকদের খুন করেছে, সে ব্রাডলি মানিং এর চেয়ে ভালো ব্যবহার পাচ্ছে, যে সৈনিকের বিরুদ্ধে এখনো অভিযোগ গঠন করা হয়নি।

@এক্সোএক্সোডেইজিভো টুইট করেছে:

জেরেমি মোরলক আফগান সাধারণ নাগরিককে খুন করার অভিযোগে ২৪ বছরের জন্য জেলে গেছে। এদিকে ব্রাডলি মানিং যুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দলিল প্রকাশের দায়ে শাস্তি হিসেবে হয়ত মৃত্যুদণ্ড পেতে পারেন।

যেমনটা সংবাদ প্রদান করা হয়েছে, ডের স্পেইগেল ৪০০০ ছবি ও ভিডিওর মধ্য মাত্র তিনটি প্রকাশ করেছে, যেগুলো তার কাছে আছে বলে পত্রিকাটি দাবি করেছে। এই সকল উপাদান, যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকরা যে সব ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে সব ঘটনা ঘটিয়েছে তার দৃশ্য উন্মোচন করেছে।@সাইমনমোয়েলি টুইট করেছে:

যদি ডের স্পেইগেল কেবল তার কাছে থাকা ৪০০০ ছবির মধ্যে ৩টি ছবি প্রকাশ করে, তাহলে আমি কল্পনা করতে পারছি না, বাকি ৩৯৯৭টি ছবি কতটা বীভৎস হতে পারে।

@হাম্পজোনস টুইট করেছে:

ডের স্পেইগেলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের খুনী দলের বিজয়ী পদকের (ট্রফি বা নিহত নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি, নিহত নাগরিকদের বেশির ভাগই সে দেশের সাধারণ নাগরিক) সাথে তোলা ৪০০০ ছবি রয়েছে, এবং পত্রিকাটি কেবল তার একটি মাত্র প্রকাশ করেছে। এটাই সাংবাদিকতা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .