ভারত: কৃষকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে

জনসংখ্যার দিক দিয়ে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ভারতের ১২০ কোটি লোকের মধ্যে শতকরা ৭০ জন গ্রামে বাস করে। ৪৫ কোটি ভারতীয় ( জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ) আন্তর্জাতিক দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। তাদের প্রতিদিনের গড় আয় প্রায় ১.২৫ ডলার, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৯২ টাকা । যদিও ভারতের কৃষি খাত জিডিপিতে ২৮ শতাংশ যোগান দেয়, কিন্তু সে দেশের জনসংখ্যার একটা বিশাল অংশ এই খাতের সাথে জড়িত। বিপুল পরিমাণ লোক হয় কৃষক অথবা কৃষি সংক্রান্ত কোন খাতে কাজ করছে। কিন্তু এক মহামারী ভারতের কৃষকদের উপর আঘাত করছে। দিনের পর দিন কৃষকরা চূড়ান্ত এক পন্থা গ্রহণ করছে, যেমন নিজের জীবন নিজে নিয়ে নিচ্ছে। নিজেরা এই আত্মহননে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে, কারণ তারা ঋণের ভারে এবং দারিদ্রের কশাঘাতে জর্জরিত। আর ভারতে এই ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে বছরের পর বছর

খাদ্য এবং বাণিজ্য নীতি বিশ্লেষক দিবেন্দ্র শর্মা তার ব্লগ গ্রাউন্ড রিয়ালিটিতে জানাচ্ছেন:

জুলাই (২০০৯) মাসে ভারতে ৬০ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছে। আগস্টের ১০ তারিখের মধ্যে আরো দশ জন কৃষক নিজের জীবন নিয়ে নেয়। এই ধরনের বেদনাদায়ক অপরাধ মূলক কাজ নিবৃত্ত করার জন্য শহুরে উচ্চবিত্ত ও নীতি নির্ধারকরা যদিও বেশ কিছু কমিটি ও ত্রাণের কথা বলেছে, তা সত্ত্বেও কৃষিতে এই প্রাণঘাতী নাটকীয়তা চলছে। এর দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হচ্ছে কেউ এসে এর কারণটি দূর করার চেষ্টা করছে না, যার কারণে মানব দুর্ভোগের এই শোক গাঁথা কখনই শেষ হচ্ছে না।

কেন এই সমস্ত কৃষকরা আত্মহত্যা করে? ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক নিতা জে, কুলকার্নি বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন, তার ব্লগ এ ওয়াইড এ্যাঙ্গেল ভিউ ফ্রম ইন্ডিয়া-তে

কৃষকরা ঋণের ভারে জর্জরিত হয়, কারণ চাষের খরচ অত্যন্ত বেশী- হাইব্রিড সীড বা উচ্চফলনশীল বীজের মাত্রাতিরিক্ত দাম, (বলা হয় এই বীজ নাকি অনেক বেশি ফলন দেয়) এবং বহুজাতিক কোম্পানীর বিক্রি করা কীটনাশক, যার দামও কম নয়। কিন্তু যখন ফসল উৎপন্ন হয়, সেই ফসলের মোটেও ভালো দাম পাওয়া যায় না। দাম না পাওয়ার একটা আংশিক কারণ হচ্ছে শস্য আমদানি করা হয়। মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আসে খরা, যা তাদের জীবনে আরো দু:খ যোগ করে। জমিতে সেচ অনেক ব্যয়বহুল ব্যাপার। তাদের জন্য এটা আরো খরচের বিষয়, যার জন্যে রাজ্য সরকার কোন ধরনের সাহায্য করে না।

ভারতীয় ব্লগার এস গুপ্তা সরকারের ত্রাণ ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাকে আঘাত করেছেন

ভারতের পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক ও লেখক সোনিয়া ফালেইরো ব্যাখা করেছেন কি ভাবে মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিদর্ভ অঞ্চলের তুলাচাষীরা সরকারের সাহায্য না পেয়ে ঋণের চোরাবালিতে আটকে গেছে:

রোগাক্রান্ত শস্য অথবা ভুল কোন শস্যবীজ কেনার মত নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় তারা বিপদে পড়তে পারে। কারণ এ ভুল শুধরানোর জন্য তাদের ঋণের দরকার হয়। মাত্র পাঁচ শতাংশ কৃষকের সমবায় বা ব্যাংক থেকে ঋণ নেবার যোগ্যতা রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকেই ঋণ খেলাপী, যারা আগের ঋণের টাকা শোধ করতে পারে নি। এখন এই ঋণশোধের ব্যাপারটি ব্যাক্তির হাতে, অনেক সময় কুটিল মহাজন ১০০০ রুপী ঋণ দিয়ে, তার জন্য প্রতি চার মাস অন্তর সুদ নেয় ৫০০ রুপী।

ঋণের বোঝা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, প্রকৃতির সামান্য বিরুপতায় কৃষকরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।

ঋণের বোঝা বহন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, প্রকৃতির সামান্য বিরুপতায় কৃষকরা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়।

ফ্লিকার ব্যবহারকারী চিনোজিপসীর সৌজন্যে এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সের আওতায় ব্যবহৃত।

স্পেন ও ভারতে নিবন্ধনকৃত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানএর ব্লগ এসোসিয়াসিওন প্রভাত এ লেখেন বিকাশ। তিনি সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও অন্যদের অসচেতনতার কারণে ক্ষিপ্ত

যদি সরকার কৃষকদের সমস্যার সমাধান করতে চায় তা হলে কেন তারা খরা বা বন্যার সময় কৃষকদের বিশেষ সুবিধা দেয় না (যা বিহারে প্রায়শ:ই ঘটে)। কেন ভারতের অনেক অংশে বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলো কৃষকদের ঋণ দিতে অস্বীকার করে? অথচ ঋণ পাওয়া তাদের আইনগত অধিকার। কেন ভারতের অনেক অংশে যে অপুষ্টি এবং দুর্ভিক্ষ রয়েছে কেউ তার কথা বলে না (বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ দরিদ্র এবং অনাহারী লোক ভারতের বিভিন্ন অংশে বাস করে)?

কেন ভারতের অনেক এলাকায় ধীরে ধীরে কৃষকদের এক পদ্ধতিতে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে, তার কোন খবর নেই?

আমি ধারণা করি ভারত তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে খুবই ব্যস্ত এবং সে এক স্বপ্নে বাস করেছে যে, সে উন্নত বিশ্বের খুব কাছে চলে এসেছে (এবং যে বিশ্ব ভাবে, ভারতে দারিদ্র সীমার নিচে যে ২৫ শতাংশ লোক বাস করে, তারা আসলে অস্তিত্ব হীন)।

ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিক্ষক, লেখক এবং ব্লগার হরিনি কালামুর দেখাচ্ছেন, কিভাবে প্রচার মাধ্যমে কৃষকদের আত্মহত্যার বেদনাদায়ক খবর উপেক্ষা করা হয় এবং চলচ্চিত্র তারকাদের ব্যাপক প্রচারিত খবরের তুলনায় তাদের খবর সামান্য অংশ জুড়ে থাকে:

যেদিন শাহরুখ খানকে আমেরিকার বিমান বন্দরে দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হয় [..] সেদিন ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের ২১ জন কৃষক আত্মহত্যা করে। তাদের আত্মহত্যার কারণ, তারা ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

কিন্তু কৃষকদের আত্মহত্যার খবর প্রচারের জন্য কেউ টাকা দেয় নি। এটা জনপ্রিয়তার মাত্রা (টিআরপি) কে পরিচালিত করে না এবং তা আমাদের সাংবাদিকদের বিবেচ্য বিষয় হয় না।

একজন আইটি বিশেষজ্ঞ এবং ব্লগার হিমাংশু রাই বের করেছেন যে সমস্যা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের বিশেষ কিছু নির্বাচন রয়েছে। কারণ গ্রাম ও শহর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যে বৈষম্য, তা সামগ্রিক উন্নয়ন ঘটানোর স্থানে এক বড় ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।

দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যে গরিবদের নিয়ে এখানে কেউ এখন আর চিন্তা করে না, অথবা ভাবে না তাদের অবস্থার সত্যিকারের পরিবর্তন দরকার।

শহুরে শ্রেণী যারা মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের কম, তারা প্রচার মাধ্যমে অনেক বড় জায়গা জুড়ে থাকে। বিমান পরিবহণ খাতে চাকুরির বাজার মন্দা, এই খবরটি দেশের গণহারে কৃষকদের আত্মহত্যা করার চেয়ে বড় খবর।

নাভদানিয়া ট্রাস্ট এক ভারতীয় প্রচারণা গ্রুপ যারা সম্প্রতি এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে জানা যাচ্ছে “এখন সাব সাহারান আফ্রিকার চেয়ে ভারতে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেশি। আর ভারতের ক্ষুধার্ত মানুষেরা আর কেউ নয়, যারা খাবার উৎপাদন করে- সেই কৃষকেরা”।

এখন কৃষকরা এর প্রতিবাদ করছে। কিন্তু তাদের প্রতিবাদের একটি মাত্র ভাষা রয়েছে- তা হল আত্মহত্যা। চার বছর অনাবৃষ্টির পর ভারতের ঝারখন্ড রাজ্যের কৃষকরা এক আত্মহত্যার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, এই অভিযোগে যে, সরকার তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য কোন পদক্ষেপ নেয় নি।

ভারতের দার্শনিক, পরিবেশবাদী কর্মী এবং নারীবাদী বিষয়ক লেখিকা বন্দনা শিবা এর জন্য অভিযোগ করেছেন নেতিবাচক অর্থনীতিকে। তার মতে বিশ্বায়ন এবং এই নেতিবাচক অর্থনীতির কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে দেশটির ৭ শতাংশ বেকারত্বের হিসেব মাখায় রাখলে বলা যায়, বেঁচে থাকার জন্য কৃষকরা তাদের পেশা বদলানোরও উপায় নেই।

অপেশাদার চলচ্চিত্র নির্মাতা বিভু মোহান্তে ও আশিশ ধাদাদের তৈরি এক স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র মিট্টি ভারতীয় কৃষকদের যন্ত্রণা তুলে ধরেছে।

ভারতের পুরস্কার প্রাপ্ত উন্নয়ন গবেষক সাংবাদিক পি সাইনাথ কাউন্টারপাউচ ব্লগে দেখাচ্ছেন যে ভারতীয় কৃষকদের মধ্যে দারিদ্র এবং অনাহার দ্রুত গতিতে বাড়ছে।

ভারতে লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীকে দু বেলা আহার জোটাতে খাবার কিনতে হয়। তারা সেই পরিমাণ শস্য জন্মাতে পারে না যা দিয়ে তারা তাদের পরিবারকে খাওয়াতে পারে। তাদের পরের জমিতে কাজ করতে হয় অথবা অন্য কোথাও কাজ করতে হয়, যাতে তারা প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে পারে। কিছু শস্য কেনার জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভর করতে হয়, খাবারের দাম বাড়ার কারণে তারা এখন তীব্র ভাবে আক্রান্ত । ১৯৯১ সালে এ রকম ঘটনা ঘটেছিল এবং বিশেষ ভাবে এ বছর একই ঘটনা ঘটল। যে সমস্ত লোকের খাবার উৎপাদন করে, অনাহার তাদের জন্য খুবই বাস্তব এক ঘটনা। এর সাথে এই তথ্য যোগ করা যেতে পারে, “প্রতি জনে খাবার পাওয়ার পরিমাণ” শস্য প্রতি নাটকীয় ভাবে কমে গেছে, আর এই ঘটনা ঘটে যখন থেকে ভারতে সংস্কার কর্ম সূচী শুরু হয়। ১৯৯১ সালে জনপ্রতি শস্য পাওয়ার পরিমাণ ছিল ৫১০ গ্রাম, ২০০৫ সালে জনপ্রতি শস্য পাওয়ার পরিমাণ কমে আসে ৪২২ গ্রামে (এটা ৮৮ গ্রামের পার্থক্য নয়, ৮৮ গ্রামকে ৩৬৫ দিয়ে গুণ করে, তাকে আবার ১০০ কোটি ভারতীয়কে দিয়ে গুণ করে যে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে সেই পরিমাণ শস্য)। অধ্যাপক উৎস পাটনায়েক ভারতের সেরা কৃষি অর্থনীতিবিদ। তিনি ক্রমাগত ভাবে নির্দেশ করছেন যে, ভারতের গড় দরিদ্র পরিবারগুলো দশ বছর আগে যে পরিমাণ খাবার পেত, আজকে তার তুলনায় ১০০ কিলোগ্রাম কম পায়।

গরিব কৃষকরা এরকম ভুগতেই থাকবে যদি সঠিক ভাবে ভুগর্ভস্থ্য পানি ব্যবস্থাপনা না তৈরি হয়। যেমনটা ভুতাত্বিক সুব্রত খের ব্যাখ্যা করেন, সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া এবং বিভিন্ন বৈচিত্র্য পূর্ণ শস্য উৎপাদনের সুযোগ না থাকা, কিংবা অন্য কোন খাত থেকে আয় করার সুযোগ না থাকার কারনে তাদের দুর্ভোগ বাড়ে। দারিদ্রের দুষ্ট চক্র এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যেমন খরা, তাদের ধ্বংস করে ফেলে। অর্থনীতিবিদ এবং পরিবেশবাদী সঞ্জীব স্যান্যাল মতামত প্রদর্শন করেছেন যে, ভারতকে তার কৃষিখাত নিয়ে এক বড় আকারে বৈপ্লবিক চিন্তা করতে হবে, কৃষকদের এ ধরনের আত্মহত্যা ঠেকানোর জন্য।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .